স্মৃতির সখ্য

অন্তরঙ্গ সতীনাথ/ পর্ব ২

আলো রায়


একবার বিভূতিভূষণ (মুখো) এসেছেন পাড়ায় আত্মীয়ের বাড়িতে। আমরা আধপাকা ছেলের দল উঁকিঝুঁকি মারছি। বিকেল চারটেয় ফিরে যাবেন দ্বারভাঙ্গায়। দুপুরে বললেন, ‘অমূল্যবাবু(বেয়াই), পূর্ণিয়ায় এলাম। সতীনাথ দর্শন হবে না? একটু খবর দিন, দেখা করে আসি।’
অমূল্যজ্যাঠা আমাদের দিকে তাকাবার আগেই দে দৌড়। সতুদার বিরাট বাগানঘেরা বাড়িতে ঢুকতে গেলে অনেকটা ঘুরে বড়ো গেট দিয়ে যেতে হয়। অথচ পাশেই একটা ছোট মাপের পাঁচিল আছে। অনায়াসে টপকানো যায়। গণেশদার বাড়ির লাগোয়া। অমূল্যজ্যাঠার বাড়ি থেকে এক মিনিটের রাস্তা।
সতুদা শৃঙ্খলার ভক্ত। তাড়াতাড়ির জন্য ছোট পাঁচিল টপকে গেলে রাগ করবেনই। তাই হাঁফাতে হাঁফাতে দূর দিয়েই গেলাম। এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললাম, ‘বিভূতিভূষণ আসছেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে।’
সতীনাথ শান্ত ভাবে শুনলেন। একটা ফুলের লতা তুলে নিলেন। তারপর অবাক কান্ড! গটগট করে সেই ছোট পাঁচিলটা অনায়াসে ডিঙিয়ে চলে এলেন অমূল্যজ্যাঠার বাড়ি। বিভূতিভূষণ রওনা হবার আগেই।
তারপর ওঁদের মধ্যে আলাপ তো বাংলা সাহিত্যে সুপরিচিত। পুনরাবৃত্তিতে যাব না। তবে এই ঘটনা ততটা উল্লেখযোগ্য নয়। পুনশ্চ যেটুকু, সেটুকুই তাঁর মুখে তখনকার দিনে আমাদের সস্নেহ পরিচয় বলে জানিয়েই দিই।
পরে কোনও একদিন উনি ভর্ৎসনার সুরে আমাদের বলেছিলেন, ‘অত ঘুরে দেরি করে এলি কেন?’
আমরা আশঙ্কার কথা বললাম। বললাম, ‘পাছে আপনি পাঁচিল টপকালে রাগ করেন...।’ ইত্যাদি। উনি চুপ করে ঠোঁট টিপে ধরলেন। তারপর সামান্য হেসে বললেন, ‘আরে পাঁচিলটা তো ছাগলদের জন্য।’
বরাহত্ব সম্বন্ধে সামান্য সন্দেহ ছিল। ছাগলত্ব সম্বন্ধে রইল না। বিভূতিভূষণ আর সতীনাথ যখন মিলিত হবেন তখন ছাগলরাই পাঁচিলের অজুহাতে দেরি করিয়ে দেয়!
এক শনিবার আমাদের হাতে লেখা পত্রিকা ‘বৈকালী’র বৈঠক। বোধ হয় ১৯৬১ সাল। সতুদাকে অনেক করে রাজি করিয়েছি সম্পাদনা করতে। প্রথমেই অবশ্য বকুনি খেয়েছি ‘ঠালপালা’ শব্দটি ব্যবহার করে। উনি বললেন, ‘উঁহু। ঠালপালা নয়, ডালপালা বল্।’
যথারীতি নাকের ডগায় রক্তাভা। গালেও ছোপ লালচে রঙের। বোঝা গেল বিরক্ত হয়েছেন। তারপরেই নিমেষে উধাও সব বিরক্তি। সস্নেহে পিঠে রাখলেন হাত। বোঝাতে বসলেন ডাল আর ঠালের বিভেদ। অনেক পরে দ্বারিক জেঠু একবার বলেছিলেন, ‘তোরা নাকি সতুর গাছের ডালপালা ভেঙেছিস? আর তোদের ঢুকতে দেবে না সতু।’
দুটি ব্যাপারে কোনও মিল ছিল না। তা জাম খেতে হলে দুটি একটি শাখা প্রশাখা তো ভাঙেই। সতুদা জানতেন না জামগাছের ক্ষতির কথা। পরে জেনেছিলেন।
আবার ধরলেন পরে একদিন। সঙ্গে বাচ্চুদা (অমূল্য লাহিড়ী) আমতা আমতা করে জবাব দিলেন, ‘না সতুদা, আমরা ডাল ভাঙিনি।’
‘তা হলে কি ভেঙেছিস সেদিন? বাবাজী বলছিল তোরাই করেছিস ওই অপকর্ম!’
দেখছি এবার আস্তে আস্তে আবার লাল হয়ে যাচ্ছে মুখ। ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি বলে বসলাম, ‘না না, ডাল নয়। দু’ একটা ঠাল ভেঙে গেছে। ছোট ছোট। খুব নরম আর পাতলা হয়তো।’
মুখমন্ডল আবার প্রসন্ন। একটু অবাক চাহনি। রক্তাভা উধাও। পাতলা ঠোঁটে হালকা হাসির ঝিলিক।
‘বাচ্চু তো দেখছি শক্ত বাঁশ। সোজা বলে দিল ডাল ভাঙিনি! তুই তো বললি ডাল ভাঙিনি, ঠাল ভেঙেছি। তাহলে বুঝেছিস ডাল আর ঠালের পার্থক্য কোথায়?’
একবার স্বীকার করে ফেলেছি, আর তো ফেরানো যায় না কথা। মাথা নিচু করে এমন ভঙ্গি করলাম যে দুটোই হয়। ডাল ভাঙিনি, ভেঙেছি ঠাল, সরু, পাতলা, নরম! আর কাজটি অপকর্ম তো বটেই। তবে জাম চুরি করাটা অন্যায় কিনা সেটা উহ্য রয়ে গেল।
ওঁর মুখে চোখে কৌতুকের ছটা। বললেন, ‘বাচ্চুটা বাঁশ। শক্ত সোজা। তুই কি জানিস? তুই কঞ্চি! বাঁশের চেয়ে দড়। যা, এখন তোরা যা। আমার লেখার সময় হয়েছে...।’
বাচ্চুদা আমৃত্যু এ ব্যাপারে আমাকে ঈর্ষা করে গেছেন। আর আমি আজও কঞ্চি। সরু  পাতলা— অকিঞ্চিৎকর। বাচ্চুদার রাগি ভাষায়— ‘অকিঞ্চিৎকর কঞ্চি!’


(ক্রমশ)

Post a Comment

2 Comments