লকডাউনের দিনলিপি

খেলা বন্ধ, ভিড় নেই

কনকলতা সাহা


ওদেরও এখন জানা। বাইরে বেড়োনোর প্রতি সরকারি নিষেধাজ্ঞা যখন, তখন ওদের এই তেতলার ছাদই ভরসা। এখানেই সকাল সন্ধ্যে ইনডোর গেমস্। পাখিদের খেতে দেওয়ার জন্য ছোট ছোট পাতিলে জল রাখা। খাবার দেওয়া দুবেলাতেই। গরমের শুরুতেই এসে ভিড় করে ছাতারে, বুলবুল, মৌটুসি, পায়রা, ঘুঘু, ছিটকোকিল, বেনে বউ আর দূরে সোনালি ডানার চিল। হরেক রঙের প্রজাপতিদের সঙ্গে চলে দোলনায় দোল খেতে গান গাওয়া। তারপর বিকাল হতেই জমে ওঠে গল্পের আসর।
বুবুইয়ের পছন্দ হাসির ফোয়ারা, রুশদেশের উপকথা, টিনটিন, অ্যাসটেরিক্স, ঘনাদা, ব্যোমকেশ, শরদিন্দু, পান্ডব গোয়েন্দার গল্প। আর টুবুইয়ের রামায়ণ, মহাভারত, পঞ্চতন্ত্র, পপুলার ফেয়ারি টেলস্, মাই ভেরি ফার্স্ট মাদার গুজ, জাস্ট এ জোক্! আর সঙ্গে ছড়া, কবিতা ও গানের লড়াই চলতে থাকে যতক্ষণ না বেলাশেষের সূর্য ঢলে পড়ে পশ্চিমে নারকেল গাছতলার পেছনে ইউক্যালিপটাসের ও সোনাঝুড়ির বনে। ওদিকে নীচের বাগানে দেবদারু, বকফুলের গাছে, আম, কাঁঠাল, বেল, পেয়ারা, শিরিষের কিংবা শিশু গাছের ডালে কাঠবেড়ালির উঁকিঝুঁকি চলে অনবরত। সামনে ঢেউখেলানো তরঙ্গায়িত কাঁকুরে বর্গিডাঙার মাঠে ছোট ছোট ঘাসফুলেরা ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চুপে। এখন ওখানে ছোটদের খেলা বন্ধ। তাই সঙ্গীসাথীদের ভিড় নেই। নেই জনপ্রাণী যেন!
এদিকে তেতলার ছাদের বাগানে চায়ের আসর জমে উঠে। শুকতারা দেখা দিয়েছে ততক্ষণে। একফালি চাঁদ জানায় তার আগমন বার্তা। রাতের আকাশের অপরূপ শোভায় তারা গোনার গল্প শোনে দাদুর কাছে। এভাবেই ছোটরা চিনে নিতে শিখেছে কালপুরুষ, লুব্ধক, সপ্তর্ষিমন্ডল। ঘরে এসে পড়াশোনার ফাঁকে খেলার আশ মিটে যায় ছাদের খেলায়। লুডো, ক্যারাম, দাবা, ব্যাডমিন্টন আর ক্রিকেট— সবের মধ্যে বয়ে চলে দিন। কখনও কখনও সাইকেল চালানোর অবকাশ ও মেলে কিছুটা। ফলে কুরুক্ষেত্রের রণনীতিও শেখা হয়ে গেছে এসবের মধ্যে। কিন্তু বেচারাদের এখন এই মারণরোগের চক্রবূহ্য থেকে উদ্ধার পাওয়ার আগে পর্যন্ত এই মালঞ্চ’ই ভরসা। রঙতুলিতে দুজনেই এঁকে নিচ্ছে লকডাউনের দিন-যাপনের গল্প আর ঘরকন্নার টুকিটাকি।
কেক, চকলেট, কুকিজপর ডিমের ডেভিল আর স্পানিশ অমলেটের পালা আর তার সঙ্গে সন্দেশের সেরা গল্প। যদিও অসময়ের দিনের খাবারের পাতে ওরা জানে নুন, আলু সেদ্ধ, পান্তা ভাতের গল্প। দেশ-বিদেশের ভয়াবহ অবস্হা ও ভেতরের ভয় থেকে দূরে রাখে এই মালঞ্চ।

Post a Comment

0 Comments