লকডাউনের দিনলিপি


এত মুক্তির আনন্দ রাখব কোথায়

দীপ দত্ত

এই তো আজকের মনোরম নরম সকালে লাল টুকটুকে সূর্য একরাশ আবীর ছড়িয়ে দিল সারা আকাশ জুড়ে। এক চিলতে বাগানে একফালি রাঙা রোদে আড়মোড়া ভাঙা পাখির দল সেই কখন থেকে ডানা মেলে ভেসে বেড়াচ্ছে, জটলা করে কিচিরমিচির করেই যাচ্ছে। ওরে সাতভাই ছাতার তোদের কি ঝগড়া চলতেই থাকবে? আজ দেখি অনেক বুলবুলি এসেছে। সে তো আবার সকালের সব কাজ সেরেসুরে স্নানে যাবে। চল জল তুলে রাখি তোর জন‍্য। কোণের ওই শিউলি ছায়ায় তোর স্নানপাত্রটা খুব পচ্ছন্দের তাই না!  জানি রে জানি।
‘ওরে রামু,শামু,যদু... তোদের সঙ্গে মধু এলো কই? সিজনটা ভালো নয়, কে জানে কাশছে কি না খুকখুক করে।’ পারি না সামাল দিতে ওই চার কাঠবিড়ালি কে। এই জানালা দিয়ে উঁকি মারছে, তো কখনও আবার সরসর করে নিম আমলকির ডালে ডালে ছুটছে। লম্বা লেজ ছড়িয়ে হাত জড়ো করে জুলজুল করে তাকিয়ে আছিস। কি ভাবছিস রে? চল চল, ছোলা, বাদাম, মুড়ি, গম,  শুকনো নারকেল... দিয়ে আসি তোদের। যার যেটা পছন্দ, নিয়ে নিস। পাখিদের সঙ্গে তোদের খুব ভাব জানি। দেখি তো তোরা কাড়াকাড়িও করিস না। কিন্তু এত তাড়াহুড়ো কেন বল দেখি! এই তোদের জন‍্যই তো বাগানের এ মাথা থেকে ও মাথা জুড়ে পরিবেশন করতে হয়...। যত ছোটই হোক না এই ঝোপঝাড় বাগান, আমার যে বয়স হচ্ছে রে। কোমরে ব‍্যথা হয়, বুঝিস কি? হ‍্যাঁ রে চড়াই, কুটুস করে একটা মুড়ি খাবি আর সঙ্গে সঙ্গে এক ঠোঁটো জল খেতেই হবে তোকে? জানিস তো খাওয়ার সময় জল খেতে নেই‌‌। আমার মা আমাকে পই পই করে এটা বলতো সেই ছোটবেলায়। এখন আর বলে না রে। চোখে ভালো দেখতেই পায় না যে। ঠিক আছে চড়াই ... দুপুরে যখন আবার আসবি, ভেজা ভাত কয়েকটা রেখে দেব তোর জন‍্য। বাকিটা লালু ভুলু দাদাদের দিতে হবে যে। হ‍্যাঁ রে ঘুঘু, খেয়ে নে বাবা। তোর তো আবার পছন্দ সেই সোনালি গম।শান্ত দুপুরে ডাকবি তো সেই উদাসী ডাক! আমি চলে যাব সেই তেপান্তরে...। ওখানেই তো আকাশ কিনারা দিয়ে বাবা চলে গেছে তারাদের দেশে। শুকতারা তো আড়ালে চলে গেল, এত দেরি করিস কেন রে টুনটুনি? মৌটুসি না হয় লম্বা ঠোঁটে পোকা ধরে। তুই এত ছটফটে। একটু সবুর কর, ভালো করে খোঁজ কর পালং, বিনস, টমেটো, কুন্দ ডাল পাতার খাঁজে ঠিক পাবি মুখরোচক কিছু। আমার দেওয়া খাবার তো আবার তোর না পসন্দ। তবে চড়াই এর মতো তুই যে লুকিয়ে জল পান করিস সেটা কিন্তু কালকে আমি দেখে ফেলেছি। কালো পিঁপড়ে লাল পিঁপড়ে তোরা খুব খাটুরে। ঠিক আছে গন্ধরাজ, করবীতলায় যেখানে তোদের বাসা আছে কাছাকাছি রেখে আসবো মুড়ি, চাল, বিস্কুট গুড়ো। দেখিস তোদের যা স্বভাব। অতো মজুত করিস না এই লকডাউন সময়ে। সবাই নজর রাখছে কিন্তু!
কোকিলটা খুব বোকা। নাগাড়ে ডেকেই চলেছে। একটু লাজুক আছে, আড়ালে থাকতে ভালো বাসিস। সেজন্যই কি বেলা পড়ে যাওয়ার সময় আসিস! হ‍্যাঁ রে তোর জন‍্য তো পেঁপেটা পাকতে দিয়েছি গাছেই। দেখিস নি? অতো লজ্জা করিস না রে আমার কাছে।কাক... তোদের জ্বালাতে তটস্থ, তা লম্বা লেজের হাড়িচাঁচা কই গেল? কাঠঠোকরার মতোই সে আর এক খেয়ালী। দেখাই দিচ্ছে না। আর দেবেই বা কি করে? গোটা শালবাগানই তো ইঁট পাথরের বস্তি হয়ে গেল। হ‍্যাঁ রে রূপসী কাঠঠোকরা, তোর সেই ছবি যেটা তুলেছিলাম সেই কবে। তুই ফটো হয়েই থাকবি? আসবি না শিউলি গাছে ঠুকঠুক করতে? জলাভূমি তো নেই আর এ তল্লাটে। তবুও পথ ভুলে এই ‘গরীবে'র পাষাণবাড়িতে পানকৌড়ি তুই তো মাঝেমধ‍্যে আসিস। লেজ ঝোলা- এদিক ওদিক তাকাস, চলেও যাস আনমনা। ব‍্যথা পাই রে।তোর কষ্টের মতো টিয়ার ও খুব কষ্ট রে। ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া থাকতো এজমালি ওই ঝাঁকরা গাছে। কি সুন্দর গেরস্থালি, কলকাকলি। তা ওই গাছ উপড়িয়ে ঠিকাদার বাবুদের গ‍্যারেজ হয়ে গেল। তোরাও চলে গেলি কোথায় যেন। তবুও চৈত্রের বিষন্ন বিকেলে এখনও আসিস, উড়িস, গাছে বসে সবুজে মিশে ডাক দিস সন্তর্পণে। পাছে জল্লাদরা শুনে না ফেলে ভিটেছাড়া তোর আর্তনাদ... তাই না? কি করি বল। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি শুধু। সকাল সন্ধ‍্যা জুড়ে তোদের সঙ্গেই তো সহবাস আমার। এখন শুনশান দুপুরও জুড়ে গেছে। চার প্রহরের সারাদিনই মিশে গেল তোদের সঙ্গসুখের সাথে। অন্তরীন সময় আমাকে থামার সুযোগ দিল রে। ছোট ছোট অবোধ প্রাণ, প্রাণবন্ত রঙিন খুদের দল, তোরা আমাকে সবুজ করে দিলি জীবনের এই বিকেলবেলায়। এত নিরবচ্ছিন্ন সুখের ভ্রমণ, এত মুক্তির আনন্দ কোথায় রাখব রে? ভালো আছি। ভালো আছি এই লকডাউন পিরিয়ডে, এই ধূসর উপত‍্যকায়।

Post a Comment

0 Comments