লকডাউনের দিন‌লিপি

গাছতলায় টাইপ থেমে আছে

মলয় মণ্ডল


এক বন্ধু কতগুলো ছবি পাঠিয়ে বলল— আদালতে আজকে স্যানেটাইজ করা হচ্ছে। দেখে ভাল লাগলো।
কোভিড করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে আমরা দিশেহারা! যেদিন থেকে এই আতঙ্ক সারা দেশে ছড়াল তখন থেকেই ত্রাহি ত্রাহি রব উঠল। সবাই আতঙ্কে। রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্র সরকার দু’দফায় ৩ মে পর্যন্ত লকডাউন ডাকল। একে আটকাতে গেলে ঘরবন্দিই একমাত্র পথ। স্লোগান হল সোস্যাল ডিসটেন্স। এছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। তখন থেকেই গৃহবন্দি— আদালতের গাছতলায় খটাখট টাইপও থেমে আছে!
দীর্ঘ দিন কোর্টে কাজ করছি। জীবনে এরকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি। বাড়ি, কোর্ট, বন্ধু বান্ধব নিয়ে বেশ চলে যাচ্ছিল। কোথা থেকে হঠাৎ করোনা এসে সবকিছুই ওলট পালট করে দিল। জানি না কবে সব মিটবে?
প্রতিদিনই একই রুটিন। সকালে কিছুটা কাজ এগিয়ে রাখা। তারপরই খেয়েদেয়ে আদালতে পৌঁছে খটাখট শব্দে কিছু রোজগার। এই ভাবেই পেরিয়ে এলাম কয়েকটা দশক। সবাই প্রায় গায়ে গায়েই বসা। একজন অন্যকে কিছু বললে কানে আসে সে সব কথা। যা দীর্ঘ দিন শুনে শুনে কান ঝালাপালা হয়ে আছে। করোনার দৌলতে এখন সব কিছুই বন্ধ। লকডাউনে থাকতে থাকতে কতো সংলাপ কানে ভেসে আসছে!
‘‘এই মান্না তুই এখুনি ফাস্ট কোর্টে একবার যা তো, স্যার ডাকলে ওকে দিয়ে পুট আপটা এ্যালাও করিয়ে জিআরও-তে তদ্বির করে আসিস। না হলে খুব সমস্যা হয়ে যাবে। আজকে তুই শুধু ওটাকে নিয়ে থাকিস। জামিনটা না হলে মানসম্মান থাকবে না। টাকা পয়সা নিয়ে ভাববি না।’’
‘‘ওই অরি, তোকে সেকেন্ড কোর্টে এখুনি ডাকছে। আর শোন কটা বেলবন্ড আছে, করে দিস। আছে তো পাওয়ার?’’
‘‘এ্যাডিশন্যাল কোর্টের স্টেপসটা নিয়েছিস? ওটা আগে নিয়ে আয়। নাহলে সাহেব নেবে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আর শোন মন্টুবাবু ওই কেসটার টাকা পয়সা কিছু দিল?’’
‘‘না দেয়নি। শোন চারশোর কম দিলে নিবি না।’’
রঞ্জন একটা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-এর অ্যাফিডেবিট পেয়েছে। শেষ মুহূর্তে এসে রবীনকে বলল, ‘‘এই অ্যাফিডেবিটটা এখুনি করে দাও না, না হলে পার্টির অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। আজকেই শেষ দিন। করে দিন, যা লাগে দেব খন।’’
দিলীপ হঠাৎ হাতে এক বান্ডিল কাগজ নিয়ে এসে বলছে, ‘‘এই সব রাখো তো, পরে হবে। আমারটা এখনই রেজিস্ট্রি হবে, আগে করে দাও। বিকেলেই গাড়ি, পার্টি বিহার চলে যাবে। না হলে অনেক টাকার ক্ষতি হয়ে যাবে। মাক্কালির দিব্যি দিয়ে বলছি, আমারটা আগে করে দাও। তুমি যা চাইবে তাই দেব।’’
এক মক্কেল এসেছে একজনের কাছে। মক্কেলকে দোকানটা দেখিয়ে বলে— ‘‘একটা চা আর বিস্কুট বলে আসুন, সব করে দিচ্ছি।’’ মক্কেল মাঝপথে চলে গেছে, তখন আবার ডাক, ‘‘শুনুন একটা গোল্ডফ্লেক আনবেন। পয়সাটা দিয়ে আসবেন।’’
ভোমলা এই সুযোগে দোকানের সামনে অনেকক্ষণ মাটিতে পড়ে থাকা বিস্কুটটা কুড়িয়ে এনে দিলে সানন্দে খেতে খেতে বলে— ‘‘দারুন, আর একটা হবে না? তখন সবাই দূর থেকে হেসে লুটোপুটি করতে থাকে।’’
এসবের মাঝখানেই চলে অমুকের বাচ্ছা, তমুকের বাচ্ছা আরও কত কী। মাঝখান থেকে একজন ফুটকেটে বলল— এই যে দাদা, দিদি কি করছে? পাল্টা উত্তরে— হ্যাঁরে তোর দাদা এতদিন কি করলো? এই নিয়ে চলে চাপানউতোর। শুধু মারপিটটাই হয় না। বাকি সবই চলে। একজন বলছে, আজকের দিনটা ভাল গেল না। পয়সাই পেলাম না। অন্যজন বলল, আজ ওই মক্কেলটা এসেছিল পুশিয়ে দিয়েছে, না হলে তোর মতনই হাল হতো। চায়ের দোকানদার হিসেব নিকেষ করতেই ব্যস্ত। না হলে সব গোলমাল হয়ে যাবে। না হলে কেউ বলবে, এই আমি তো তোকে কালকে দিয়ে গেলাম, আবার চাইছিস? এই নিয়ে চলবে অনেকক্ষণ। দিনের শেষে, টাইপিস্ট কাউকে ডেকে বলছে— ওই সকালে কাজটা করালি টাকাটা দে। আর একজন বলল— আরে কষ্ট করে করে দিলাম, মালটা দাও?
চলল দড়ি টানাটানি। এ বলে এত তো, ও বলে এত। টানাহেঁচড়া চলল কে কতটা বের করতে পারে। বিপরীতে সেও চায় কতটা কম দিতে হয়। এসব করতে করতে সারাটা দিন কি ভাবে কেটে যেত। এরকমও হয়েছে আজ ঝগড়া তো, কাল সকালে এক ভাঁড় চা খেয়েই সব সমস্যার সমাধান। সারাটা দিন চলে এভাবেই। এরই মাঝে কেউ বলল আমারটা আছে তো? আজ কিন্তু কম নেবো না। অনেক কষ্টে ম্যানেজ করেছি। তিনজনে ভাগ হবে, বুঝেশুনে দিও।
এসবের মাঝে কোথা থেকে চলে এলো করোনা। সব এলোমেলো করে দিল অনির্দিষ্টকালের জন্য। জানি না কবে খুলবে?
জানি না সেই একইভাবে সারাদিন খুনসুটি চলবে কিনা? জানি না মুখের হাসিটা আগের মতো থাকবে কিনা? জানি না এর রোষানলে কেউ পড়বে কিনা? আমাদের মধ্যে অনেকেই বহু কষ্টের মধ্যে আছে। তাই চাই করোনাটা যত তাড়াতাড়ি পারে যাক। তাড়াতাড়ি কাজে ফিরতে পারলে অন্তত সমস্যাটা মেটে। কাজে ফিরেই সেই চেনা মুখগুলো থেকে শুনতে চাই— এই আমারটা আগে করে দাও, না হলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। এই ওই ঘরে যারে একটু তদ্বিরটা করে আয়। মান্না বেলবন্ডটা তাড়াতাড়ি ফিট করে আন। না হলে আটকে যাবে।
প্রকৃতির ওপর অনেক অত্যাচার করেছি। বেড়ে গিয়েছিলাম অনেক খানিই। তাই বোধ হয় এভাবেই প্রতিশোধ নিল। ভালো থাকবেন সবাই!

Post a Comment

1 Comments