লকডাউনের দিনলিপি

স্মৃতিদের আঁকড়ে অপেক্ষা করছি

সংঘমিত্রা ঘোষ


জনশূন্য বিশাল লবটুলিয়ার দিগন্তব্যাপী অসীম সৌন্দর্যে ডুবে যেতে যেতে আরণ্যক উপন্যাসের কথকের অনুভূতির জগতে এক বিরাট আলোড়ন হচ্ছিল। তখনই প্রকৃতির রূপ সম্বন্ধে তিনি তার উপলব্ধি ব্যক্ত করলেন এইভাবে, ‘‘সে রূপ তাহার না দেখাই ভাল যাহাকে ঘর-দুয়ার বাঁধিয়া সংসার করিতে হইবে। প্রকৃতির সে মোহিনীরূপের মায়া মানুষকে ঘরছাড়া করে,...গৃহস্থ সাজিয়া ঘরকন্না করিতে দেয় না-অসম্ভব তাহার পক্ষে ঘরকন্না করা একবার সে ডাক যে শুনিয়াছে...।’’
আরণ্যক উপন্যাসে কথকের এই ভাবনাটি জীবনের নানা মুহূর্তে আমি অনুভব করেছি এবং বিশ্বাস করেছি। আমি ঘরের বাইরের আলো, হাওয়া আদিগন্ত মাঠ না শেষ হওয়া রাস্তা খোলা আকাশ বেশি ভালবাসি। নিভৃত, গহন, গভীর, নিস্তব্ধ প্রকৃতির বুকের ভিতর ঢুকে পড়লেই আমার ভিতর একটা তীরতীরে আনন্দ বইতে থাকে। সে আনন্দ ঘর আমাকে কখনোই দিতে পারে না। এই কয়দিনে আমি ঘরবন্দি হয়েছি। পৃথিবীর গভীর অসুখে ঘর আমাকে নিরাপত্তা দিয়েছে নিশ্চয়। এই অপ্রত্যাশিত অনন্ত ছুটিতে একটা দারুণ অবসর যাপন হতে পারতো ঘরের ভিতর। কত বই, কত গান, কত না দেখা, না শোনা ছবি আমাকে ঘিরে রেখেছে, এইতো অবসর তাদের সঙ্গে নিরুপদ্রব যাপনের। আমার মুঠোয় গোটা বিশ্ব ধরা আছে তবু আমি পারিনি পারছি না এভাবে যাপন করতে।
আমি এই কয়দিনে ধুলো ঝেড়ে ঝকঝকে করে ফেলেছি বইয়ের তাক। ফেলে রাখা শাড়ি জামাদের বিশ্রাম নিতে পাঠিয়েছি আলমারিতে। আবার চৌকি পাতা হয়েছে বারান্দায়। ঘনঘন যাতায়াতও বেড়েছে ছাদের কোণে। পুরনো হারমনিয়াম সিডির উপর আঙুল পড়েছে আবার। এতকিছু করার পর আমার ভিতর আর এক দিনলিপি তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন। আমি এই কয়দিন নিয়ম করে পুরনো জীবনটাকে দেখার চেষ্টা করছি। পুরনো চিঠির থলি উবুর করে পড়ে ফেলছি এক এক করে স্মৃতির অক্ষরগুলো। আমি জড়ো করছি আমার গোটা জীবনের সঙ্গে জড়ানো মানুষ, পাখি, গাছ, নদী পাহাড়দের। আর আমার দিনলিপিতে এই অস্থির সময়ে ফুটে উঠেছে এক নতুন ভাবনা।
আমি এই কদিনে এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে আছি যার আগে আর পরের জীবনের হিসাবটা আলাদা হবে। হতেই হবে। এই অবসর এই বন্দিত্ব আমাকে আমার এত বছরের জীবনের সামনে দাঁড়াবার সুযোগ করে দিয়েছে, আর বলছে আমি সুস্থ-স্বাভাবিক একটা মানুষ, আমি চাইলে ঘর থেকে বেরোতে পারি, চাইলে ঘরে থাকতে পারি আমার ঘরে খাবার অভাব নেই। আমার মাটি, জল, হাওয়া, পাহাড়, নদীতে লুটোপুটি করার স্বাধীনতা আছে। এরচেয়ে বড় পাওয়া আর তো কিছু নেই। তাই প্রতিদিন আমি আমার অতীতের পাওয়াগুলোকে বুঝছি।
আমার প্রিয় বইয়ের মতো করে, প্রিয় মানুষের দেওয়া উপহার এর মতো করে, আমার প্রিয় কবিতার মত করে এই অবসরে প্রতিদিন নিয়ম করে মনে করছি, এই পৃথিবীতে আমার যাপনের দিনগুলো। এত বছর যাদের সঙ্গে অবাধে দেখা করেছি, পাশাপাশি হেঁটেছি সুখে, দুঃখে, ঝগড়ায়, ঘৃণায় অভিমানে তাদের সঙ্গে আবার দেখা হবার প্রার্থনা করছি। এই অসুখ এই অস্থিরতা আর এই বন্দিত্ব আমার জীবনের দিনলিপি পাল্টে দিচ্ছে প্রতিদিন একটু একটু করে।
আর আমি অনুভব করছি বড় বেশি চাইতাম জীবনের কাছে। এই অনন্ত উদার বিরাট প্রকৃতির মাঝে চেনা-অচেনা প্রিয় মুখ গুলোর সঙ্গে স্বাধীনভাবে কাটিয়ে দিতে পারাটাই অনেক বড় পাওয়া। তাই যা কিছু না পাওয়া যাকিছু না হওয়া নিয়ে ভিতরে আগুন জ্বলতো এই কদিনে সে আগুন নিভেছে। আমি প্রতিদিন তাই নিয়ম করে যে জীবন কাটিয়েছি, সেই স্মৃতিদের আঁকড়ে ধরছি, যত্ন করছি, অপেক্ষা করছি, স্বাধীন, সুস্থ, মুক্ত, পৃথিবীর উপর আবার গড়াগড়ি দেওয়ার জন্য।

Post a Comment

3 Comments

  1. Aha... Ki shundoriii na likhecho Guludi! Sottyi monta bhore gelo❤️ Onek bhalobasha ❤️

    ReplyDelete
  2. "সে রূপ তাহার না দেখাই ভাল যাহাকে ঘর-দুয়ার বাঁধিয়া সংসার করিতে হইবে" এটা তো আমারও মনের কথা। কিন্ত পারি না তো ছুটে ছুটে দৌড়ে পালাই। তোমার সব সময় খুবই ভাল। এটা বড় ভাল লাগলো।

    ReplyDelete
  3. এই সংকটের অবসরে আরেকবার তাহলে পড়ে ফেলি আরণ্যক। লেখা, লেখিকা, কুর্নিশ।

    ReplyDelete