লকডাউনের দিনলিপি

মন ভাল নেই শিলচরের 

শতদল আচার্য


একা একা রেল গাড়িতে বসে আছি, এই দীর্ঘ রেল পথে কখন গাড়ি পোঁছে যাবে, তার কোনও  নিশ্চিয়তা  নেই। যদি ও আমরা জানি ১৪ এপ্রিল এই রেলগাড়ি পোঁছে যাবে।  রেলের আমি একা যাত্রী নই, এদেশ শুধু নয়— এ পৃথিবীময় যাত্রী।
পাশের মানুষ থেকে দূরে থাকার মন্ত্র নিয়ে, সবাই একা একা যাচ্ছে তবু ও মানুষ দূরে দূরে থেকে মানুষের মানবিক মুখ মন দেখতে যাচ্ছে। রেলের কামরা থেকে কোথা ও যাওয়া যাবে না। শুধু একা একা জানলা দিয়ে আকাশ দেখা আর গান শোনা, হাত ধোওয়া আর সব কিছুর পরে একা থাকা, আসলে মানুষ তো একাই। আসা যাওয়া সব কিছুই তো একাই করতে হয়। এই কথাগুলি জেনেছে পৃথিবীর মানুষ।
কোনও আগাম নোটিশ ছাড়াই এতদিন ধরে কাজ ছাড়া। আমার মতো এ পৃথিবীর অজস্র মানুষ কাজ ছাড়া হয়ে আছে। শহর বন্ধ ,জেলা বন্ধ, দেশ বন্ধ শুনে আসা শব্দগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পৃথিবী বন্ধ। আকাশে উড়বে না কোনও উড়োজাহাজ। সমস্ত পৃথিবীর রেল স্তব্ধ হয়ে আছে। এই বন্ধ কোন দল ডাকেনি, কিন্তু দেশ, জাত, বর্ণ, ধর্ম, সম্প্রদায় সব কিছুকে একাকার করে দিয়েছে। মানুষের দীর্ঘদিনের লোভ, লালসা, প্রকৃতির উপর মানুষের অত্যাচার সব কিছুই হিসাব হয়ে যাচ্ছে। করোনার কারণে এই বন্ধে সমস্ত দেশ কাল এর সীমারেখা ভেঙেছে। করোনার দীর্ঘ সময়কালে কতো মানুষ কাজ হারাবে। করোনার পর হয়তো পৃথিবী বদলে যাবে।
এই সময়ে পিডিএফ  বই whatsapp এ বন্ধুদেরকে বই উপহার দিচ্ছি। নিজেও পড়ছি। তারপর এক দুইজনের কাছ থেকে নিজে ও উপহার পেয়েছি। আবার তেমনি অনেক বন্ধুদের চাহিদা পূরণ করতে কিছু কিছু নতুন বই উপহার দিতে হচ্ছে। বই খেলায় কিছু সময় কেটে যাচ্ছে। কোনও কোনও বই আবার পড়ছি, কয়েক বছর ব্যবধানে বইগুলি পড়ে আবার নতুন স্বাদ পাচ্ছি। এছাড়া কিছু তো একেবারে নতুন করে পড়ছি আর ভাবছি। আর প্রতিটি বিকাল ছোটবেলার মতো জানলা দিয়ে আকাশ দেখা আর বই আর গানে হারিয়ে যাওয়া সময় আবার ফিরে এলো। বারবার মনে এলো জীবন যেমন আবার অনেক পিছনে ছুটে চললো। আবার অনেক কিছু ফিরে দেখার সময় পেলাম। আবার আকাশ দেখার সময়ও খুঁজে নিলাম। সেই কিশোরবেলায় বিকালবেলা কোনও কোনও বন্ধু বাড়িতে এসে বলতো— চলো ঘুরে আসি। এই লকডাইনে কোনও বন্ধু পরিচিত –অপরিচিত কেউ আসে না। আমার কাছে বই গান জুড়ে সমস্ত আকাশ ছড়িয়ে আছে আর বিস্তৃত সময় আর কিছু স্মৃতি। কত বই জুড়ে আছে স্মৃতির বিকালবেলা। লা নুই বেঙ্গলী বইটা আবার পড়লাম আর নিজের পুরানো স্মৃতির জগতে হারিয়ে গেলাম। এই বইটা আরও দশটা বই এর মত যে উপহার দিয়েছিল, সে কি জানতো? একদিন বইটার মতো আমাদের ভাগ্য আকাশে লিখবে আর এক গল্প। আর আমি বসে বসে শুনছি ‘কী দ্বিধা রেখে চলে গেলে’ আসলে জীবনে কত ছোট ছোট ভুল শুধরে হিসাব করে চলে লক ডাউনের বিকাল। তার সঙ্গে আছে পরিচিত বন্ধুদের ফোনে আলাপচারিতা। সব কথার শেষে কথা, লক ডাইন কবে শেষ হবে!
প্রতিদিন বেড়ে চলছে ভারতে-আসামে করোনা সংক্রামিত রোগীর সংখ্যা। এখন আমার শহর শিলচর-বরাকে ও করোনা রোগী খুজে পাওয়া গেল। মন ভাল নেই শহরের। তাই সবার মনেই ভয় আর ভয়। আর আমি তো সব ভয়েই রবি ঠাকুরের কাছে চলে আসি। সুখ দু;খ-বিষাদে  রবি ঠাকুরের গানেই আশ্রয় খুঁজি পাই আর বলি—
বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা—
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়॥

Post a Comment

1 Comments