লকডাউনের দিনলিপি

করোনার দিনগুলোতে প্রেম

অজিতেশ নাগ


সমীর রক্ষিতের একটা বই পড়েছিলাম। নাম ‘কলেরার দিনগুলোতে প্রেম’। লকডাউনের সময়কালে ‘করোনার দিনগুলোতে প্রেম’ নামেও একটা কবিতার পাণ্ডুলিপি নামিয়ে দেবো কিনা ভাবতে ভাবতে ভাবলাম, একবার সব্বাইকে ফোন করে দেখি কে কেমন আছে। সত্যি বলতে কী, দিনগুলো আচমকাই কেমন যেন হয়ে গেলো। এই নববর্ষের সময়ে কলকাতার এবং পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে নানান সাহিত্যসভার ঢল নেমে যায়। দিন নেই, দুপুর নেই, এমনকি রাত বারোটার পরেও ফোন এসেছে, ‘দাদা অমুক দিনে ফ্রি আছেন?’। তারপর কত কবিতা পাঠ, কত চেনাজানা সাহিত্যিকদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ, কত সাহিত্য-আলোচনা, মত বিনিময় – সব যেন এক লহমায় থেমে গেলো। কে যেন আঙুল উঁচিয়ে নিদান দিলো, ‘স্ট্যাচু’। অমনি রাস্তা শুনশান, গলিগুলো নির্জন। সবাই সবাইকে দেখছে ইতিউতি, তবে ভয়ের দৃষ্টিতে। যে চায়ের দোকানে সকাল হলেই খবরের কাগজের এক পৃষ্ঠা হাতে নিয়ে, ‘দাদা, বাজারে নাকি? একটু গলা ভিজিয়ে নিন’ অথবা ‘দে তো, কাউন্টারটা দে, বাড়িতে বৌয়ের জ্বালায়....’ ইত্যাদির স্রোত বয়ে যেত, সেখানে কচ্চিৎ-কদাচিৎ দেখা হয়ে গেলেই এক মিটার দূরত্ব, কাউন্টার তো দূরস্থান। অতএব ফোন ভরসা।
ফোন করে যাচ্ছিলাম একের পর এক। সবাই ক্লান্ত, সবাই বিষণ্ণ, সবাই উদ্বিগ্ন। একমাত্র সাহিত্যিকরাই, যারা আমার মত শখের নয়, রীতিমতো আঙুল ব্যথা করে পাণ্ডুলিপি বেচে সংসার চালায়, তারাই খুশি, বলা যায় ‘বেহতর’ আছেন। তারা আগেও ঘরে ঘাড় গুঁজে লিখতেন, এখনও তাই, বরং আরও স্বচ্ছন্দ। আগে হয়তো উপন্যাসের চরম ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে গেছেন, অমনি সাংসারিক হওয়ার সুবাদে, ‘ওগো, শুনছ? চা-পাতা এনে দাও’, ‘ফ্রিজ খালি, আজ সব্জি বেশি করে এনো’, ‘বাপ্পাটা মাছ খেতে চাইছে না, আজ মুরগী এনো শ’পাঁচেক, সাথে কাঁচালংকা আর ক্যাপসিকাম’ বলে কানের কাছে ভিনভিন করা নেই। দিস্তা দিস্তা কাগজ কিনে লেখার বদলে ল্যাপটপ খুলে বসা মডার্ন সাহিত্যিকরা আক্ষরিক অর্থেই মডার্ন। তিনবারের বেশি আরেকবার ‘এক কাপ চা দিও’ বলে বৌয়ের মুখঝামটার পরোয়া করেনা। দু মিনিটে ইলেকট্রিক কেটলিতে জল গরম করে একটা টি-ব্যাগ চুবিয়ে দিলেই কেল্লাফতে।
ফোন রেখে দিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে পড়লাম। মনে পড়ল বিধানের কথা। বিধান আমার ছেলেবেলার বন্ধু। বছর পচিশ আগে কী এক জটিল রোগে মারা গেছে। রোগশয্যায় শুয়ে বিমান বলতো, ‘দ্যাখ, কাগজ খুললে অথবা টিভি খুললেও চারদিকে শুধু মৃত্যুর খবর। হয়তো দুর্ঘটনায় মৃত্যু, নয় পিটিয়ে খুন, নয় রোগে-ভোগে মৃত্যু অথবা সাপের কামড় আর নয়ত আত্মহত্যা। অথচ প্রতিদিন কত শিশু জন্ম নিচ্ছে পৃথিবীর সব প্রসূতি-হাসপাতালে। কোনওদিন কোনও মিডিয়ায় দেখেছিস সেই নিয়ে দুটো লাইন?’
বাইরের ঝাঁঝাঁ রোদে ফাঁকা রাস্তার দিকে চেয়ে ভাবলাম পঁচিশ বছর পেরিয়ে গেছে, অথচ কথাটা কত সত্যি, হয়তো পঞ্চাশ বছর পরেও তা-ই থাকবে। শ্মশানে গেলে যেমন শ্মশান বৈরাগ্য জাগে, তেমন মৃত্যুর খবরে জাগে মৃত্যুভয়। কাল কী হবে ভেবে কী লাভ? প্রতিদিন নিয়ম করে খবরের চ্যালেনগুলো সার্ফিং করা মানেই তো মরার আগে মরা। এ যেন ফাঁসির আসামি, যে জানে সামনেই তার মৃত্যু, ভয়ে-আতঙ্কে শরীর শুকিয়ে কাঠ। ক’জন আর শরৎবাবুর ইন্দ্রনাথের মতো বলতে পারে, ‘মরতে তো একদিন হবেই ভাই।’
তাই বিন্দাস আছি। একেবারে অফিস না গেলে চাকরিটা থাকতে নাও পারে, বিশেষ করে ‘সেমি-ইমারজেন্সি সার্ভিস’-এর সাথে যুক্ত বলে হপ্তায় চারদিন অফিস যাচ্ছি। যেদিন যাচ্ছি না, সেদিন বাড়িতে। নাহ বেশি ঘুমোচ্ছি না, নিউজ-চ্যানেল একদম দেখছি না, কাগজ পড়ছি না, ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ নামমাত্র। তার জায়গায় অনামী লেখকদের বই পড়ছি, নিজে সামান্য লিখছি, বাগানে গিয়ে গাছ দেখছি, ফুলেদের সাথে তুমুল প্রেমালাপ চালাচ্ছি, ফ্রেস বাতাস গিলছি আর হাহাহা করে হাসছি। হাসতে হাসতে চোখে হল চলে এলে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করে চোখ মুছে ফেলছি। আসলে আনন্দ আর সুখ তো কোনও বাস্তব বস্তু নয়, তাকে আহরণ করতে হয়। এ ধরে রাখা বালতির জলে কাক-স্নান নয়, স্নিগ্ধ পুষ্করিণীতে নির্ভেজাল অবগাহন।
চরৈবেতি।

Post a Comment

0 Comments