রবিবার

বইওয়ালার রবিবার/

আবীর মুখোপাধ্যায়


‘...শক্তি চট্টোপাধ্যায় কত বড়ো কবি ছিল, সে কথা বলবার লোক আজ ও ভাবীকালে অনেক পাওয়া যাবে। কিন্তু শক্তি কেমন মানুষ ছিল, কত অন্য রকম মানুষ ছিল, সে কথা বলার লোক আর পাওয়া যাবে না- যদি আমরা, তার বন্ধুরা বলে রেখে না যাই। সেই রকমই কিছু কথা বলার চেষ্টা রইল এই বইতে।’
কোন বই? পরম্পরা প্রকাশিত বই ‘আমার বন্ধু শক্তি’।
বইয়ের ‘স্বগত’- থেকে উদ্ধৃত অংশের হকদার-বক্তা তথা, গ্রন্থের লেখক, কবি শক্তির অভিন্ন হৃদয় বন্ধু সমীর সেনগুপ্ত। শক্তিকে নিয়ে যাঁরা বলবার, কিছু লেখবার হক রাখেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন সমীর সেনগুপ্ত। কেন? সমীর সেনগুপ্ত-ই কেন? কেনই বা দরকার পড়ল শক্তিকে নিয়ে তাঁর এমন একটি গ্রন্থের? বিশদে বলার আগে, সমালোচ্য গ্রন্থের ব্লার্ব থেকে বক্তব্যের সমর্থনে উদ্ধৃতি টানি। একটু দীর্ঘ। তবু অসতর্ক পাঠকদের উদ্দেশ্যে এখানে খানিকটা তুলে দিই। ‘শক্তি চট্টোপাধ্যায়। আমাদের এই সময়ের অন্যতম আশ্চর্য এই কবি- যাঁর সময় থেকে বাংলা কবিতা নতুন ভাবে লেখা হচ্ছে- মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন আশ্চর্য। সত্যিমিথ্যে বহু গল্প প্রচলিত আছে তাঁর সম্পর্কে, এত অদ্ভূত সেসব গল্প যে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, কিন্তু তার চরিত্রের সঙ্গে সেগুলো আবার মানিয়েও যায় বেশ। ... মানুষ শক্তি কেমন ছিলেন, এই বইতে তার স্মৃতিচারণা করেছেন তাঁর বহু বছরের বন্ধু, তাঁর প্রথমতম আলোচকদের অন্যতম, তাঁর অজস্র কবিতার ভাষ্যকার ও বহু গ্রন্থের সম্পাদক, সমীর সেনগুপ্ত’।
পরম্পরা থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থে শক্তিকে নিয়ে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণার আগে, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ ও ইংরেজি সাহিত্য আকাদেমি থেকে এর আগে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের দুটি প্রামাণ্য জীবনী লিখেছেন সমীরবাবু। তাঁর সম্পাদনাতেই ১৯৭৯-তে শক্তির কবিতার পান্ডুলিপি সংকলন ‘কুড়ি বছরের কুড়িটি’ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৮৫ তে তাঁর অনূদিত শক্তির কবিতা প্রকাশিত হয়েছে ইংরেজিতে, ‘ফিফটি পোয়েমস অব শক্তি চট্টোপাধ্যায়’। হারিয়ে যাওয়া কবিতা নিয়ে, শক্তির প্রায় সাড়ে চারশো কবিতার সংকলন করেছেন সমীরবাবু ‘অগ্রন্থিত শক্তি চট্টোপাধ্যায়’ শীর্ষকে। এছাড়া, সম্পাদনা করেছেন বন্ধুর এলেজি সংগ্রহ, পদ্যসমগ্র-৩, পদ্যসমগ্র-৪, ১৯৬৬ তে প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে ‘শক্তি চট্টোপাধ্যায়’, এবং কবির মৃত্যুর আট বছর পরে ‘অগ্রন্থিত পদ্য-গদ্য’। সমালোচিত বইটিই শক্তিকে নিয়ে সম্ভবত সমীরবাবুর শেষ বই। এর আগে, অর্থাৎ ২০১০-এ পত্রলেখা থেকে শক্তিকে নিয়ে তাঁর ‘কবি শক্তি’ প্রকাশিত হয়। এবং বিভিন্ন পত্রিকায় অজস্র লেখা ছড়িয়ে রয়েছে। তাই সমালোচ্য গ্রন্থের ‘স্বগত’-তে সমীর সেনগুপ্ত যে দাবিটি তুলেছেন, তা সংগত ও সু-শোভন।
কবি শক্তি নয়, মানুষ শক্তিকে নিয়ে সমীরবাবুর ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণামূলক ন’টি লেখা নিয়ে ‘আমার বন্ধু শক্তি’। লেখাগুলির মধ্যে একটি ছাড়া বাকিগুলি নানা সময় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত। সেই অর্থে ‘সংকলন’— এ নতুন লেখা চতুর্থ লেখাটি। শীর্ষক, ‘শক্তির সঙ্গে বেড়াতে’। আটত্রিশ বছর যে বন্ধুর সঙ্গে লেখক তথা সংকলকের সম্পর্ক তাঁকে নিয়ে সমীরবাবুর লেখা পড়তে গিয়ে কোথাও মনে হয় না বাড়িয়ে বলা বা, বানিয়ে বলেছেন। বরং তাঁর ঋজু গদ্যের গায়ে ভর করেছে শক্তিকে ঘিরে থাকা নানা চরিত্রের মুখ। কবির ব্যক্তি জীবনের নানা ছোট-খাটো অনুষঙ্গ। যা দিয়ে খুব সহজেই মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অথচ নিঃসঙ্গ শক্তিকে চেনা যায়। সেই শক্তি কেমন? ‘স্বগত’-তে সংকলক লিখছেন, ‘হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দেবে, ওর বিরোধ সব শুধু নিজের সঙ্গে; ও পালাতে চায় শুধুমাত্র নিজের কাছ থেকে- নিজে ছাড়া আর সকলেই ওর বন্ধু। সমস্ত মানুষের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠতা, অথচ ভিতরে ভিতরে এত সুদূর, এমন মানুষ আর দেখব না। সামাজিকতার সম্পর্ক পার হয়ে, বাক্ ও অর্থের হানাহানি শেষ হবার পর একটা জায়গায় শক্তির মতো নিঃসঙ্গ কেউ ছিল না, অমন অনুপস্থিত মানুষ আর কখনো দেখিনি’।
বাংলা ভাষার যে দু’জন কবির চলে যাওয়ার স্মৃতিকথন আমাকে কাঁদায়, এখনও মনখারাপে দিনমান ভাসায় তাঁরা দু’জন হলেন রবীন্দ্রনাথ ও শক্তি। সংকলনের প্রথম লেখা, শীর্ষক ‘শক্তি নেই’-এ সমীরের গদ্যে তেমন মনখারাপের আয়োজন। শান্তিনিকেতন থেকে এ শহরের পীস হাভেন- শক্তির শান্তি যাত্রা টুকুর রিপোর্টাজ। যত বার পড়েছি, চোখের জলে পাতা ভিজেছে। ১৯৯৫-এ শক্তির মৃত্যুর কয়েক দিন পর, অর্থাৎ ৩ এপ্রিল লেখাটি প্রকাশিত হয় ‘বিনোদন বিচিত্রা’ পত্রিকায়। পরের পাঁচটি লেখায় সমীরবাবু শক্তির বোহেমিয়ান জীবনযাপনের নানা প্রসঙ্গ যেমন এনেছেন, কবিতার জন্য একজন কবির নিবেদনের ছবি এঁকেছেন নিটোল ফ্রেমে। দ্বিতীয় রচনা, ‘শক্তি নেই, বইমেলা হচ্ছে’-তে বইমেলায় শক্তির প্রকাশিত বইয়ের নানা তথ্য যেমন পাই, তাঁর কবিতার নিবিড়পাঠও আছে। একইরকম ভাবে পরের লেখা ‘স্পর্ধিত কিন্তু প্রেমিক’-এ শক্তির রহস্যময়তা, ভালবাসা ও স্পর্ধার রূপটি ধরেছেন লেখক।
‘শক্তির সঙ্গে বেড়াতে’ লেখাটিতে শক্তির সঙ্গে লেখকের ভ্রমণকাহিনি। মধ্যপ্রদেশের বস্তার জেলায় ‘উদ্দেশ্যহীনভাবে’ সে যাত্রায় সফর সঙ্গী ছিলেন সদ্য প্রয়াত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও। অথচ, কী আশ্চর্য পাঠক পড়তে গিয়ে একসময় ওঁদের সহযাত্রী হয়ে যান! এ লেখায় নেশাতুর শক্তিকে ঘিরে যেমন রোমাঞ্চ আছে, আছে জঙ্গলের নিজস্ব রূপ, রস, গন্ধ। পরের লেখা ‘আটত্রিশ বছর শক্তির সঙ্গে’। এই লেখাটিতে নানা চরিত্র ভিড় করে আছে। শক্তির প্রথম জীবনের গল্প, কফিহাউস, কৃত্তিবাস পর্ব। সাধারণের সঙ্গে সম্পর্কের দিকটি লেখায় ঘুরে ফিরে এসেছে নানা ভাবে। সমীরবাবু তাই লিখছেন, ‘অসম্ভব একটা ক্ষমতা ছিল শক্তির- ভালোবাসা পাবার ক্ষমতা’। একটু অন্য ধরনের, তবু এই পর্বে ভালো লাগে ব্রজেন্দ্রনাথ মন্ডলের বয়ানে ‘কে অবনী, কার বাড়ি, কেনই বা আছে’। লেখাটি ‘পোয়েট্রি রিভিউ’ পত্রিকায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ২০০০ সালে।
এ গ্রন্থের শেষ পর্বের দুটি লেখা নিয়ে বলার আগে ‘বন্ধু শক্তি’ শীর্ষক একটি লেখার কথা বলি। এ লেখায় পাঠক প্রেমিক শক্তিকে দেখে ফেলে, চিনে নেয় তার প্রেমানুরাগ। অনুরাগ পর্ব থেকে বিয়ে। সমীরবাবুর লেখায় উঠে এসেছে শক্তির সাদামাটা ও সহজিয়া সংসার জীবনের চিত্রলিপি। লেখকের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্কের দিকটিও এ লেখায় ধরা পড়েছে। তবু লেখকের নিজের সুবিনয় খেদ, ‘আমি সামান্য মরণশীল, সরস্বতীর পদতল থেকে খসে পড়া শুকনো পাপড়ি বুকপকেটে রেখে জীবন কাটাই। সরস্বতীর মথিত চুম্বনে যার ওষ্ঠ ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তাকে কেমন করে চিনব’?
পঞ্চাশের দশকে যে সব কবিরা কবিতা লিখতে এলেন, তাঁদের অনেকে রবীন্দ্রনাথের কবিতা তেমন পছন্দ করেননি। কিন্তু গান? প্রায় সকলেই। সকলেই ছিলেন তাঁর গানের ভক্ত। এ গ্রন্থের ‘শক্তির গান গাওয়া’ লেখায় লেখক লিখছেন, ‘অতিকথনের ঝুঁকি না নিয়েও বলা যায় যে তাঁরা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের গানের ভক্ত সকলেই, সত্যিকারের ভক্ত, এমনকি পাগলের মতো ভক্ত’। এই পর্যন্ত পড়ে মনে হয়, কেমন ভক্ত? পঞ্চাশের কবিরা কি রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন? অন্তত, রবীন্দ্রনাথের গান শক্তির গলায় শোনার সৌভাগ্য আমার হয়নি। সুনীলদাকে গাইতে শুনেছি। কিন্তু শক্তি? সমীরবাবুর স্মৃতিলিখন পড়ি। উত্তর মিলে যায়। বিশ্বাস দৃঢ় হয় জানার স্বপক্ষে। বুঝি, কেন শক্তির পদ্যের বাঁকে রবিঠাকুরের গানের চরণ চিহ্ন পাই! বুঝতে পারেন লেখকও। তাই সমীরবাবু লিখছেন, ‘বুঝতে পারি শক্তি কেন বছরের পর বছর ধরে চলে যেত কেঁদুলির মেলায়, নদীর ধারের ওই খোলা মাঠে বীরভূমের জানুয়ারি মাসের ঠান্ডায় রাতের পর রাত কাটিয়ে দিত বাউলদের আখড়ায়। শক্তির গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গানকে বুঝতে গিয়ে আমাদের মনে পড়বে, নবনীদাস বাউলকে নিয়ে লেখা শক্তির এলেজি, ‘কবি মোর, রেখে গেলে ছিন্ন হতে স্মারক, মর্মর.../ নীরবে কেমন আছি ভালোবেসে আমৃত্যু সংযত!’
এ গ্রন্থের শেষ লেখাটি পড়তে গিয়ে শিহরণ জাগে। চমক লাগে বুকে। লেখা যতো এগোয়, মনে হয় আশ্চর্য স্বপ্ন-উড়ান। শক্তির সঙ্গচারিতায় লেখক এ লেখায় হাজির হয়েছেন শান্তিনিকেতনে প্রথিতযশা এক ভাস্করের কুটিরে। ভাস্করের নাম রামকিঙ্কর! শক্তির সঙ্গে রামকিঙ্করের সম্পর্ক যেমন এ লেখায় প্রতিভাত, লেখক ভাস্করের নিমগ্নতা এঁকেছেন অক্ষীন শব্দচিত্রে। শক্তির কবিতা বাঙালির চিরদিনের ধন হয়ে থাকবে, শক্তির বোহো জীবন ও তার বয়ে চলাও রয়ে যাবে বাঙালি পাঠকের স্মরণে। যার প্রামাণ্য টেক্সস্ট সমীর সেনগুপ্তের নিজের করা শোভন মলাটে পরম্পরার এ গ্রন্থ, উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।

আমার বন্ধু শক্তি/ সমীর সেনগুপ্ত
প্রকাশক- পরম্পরা

Post a Comment

0 Comments