রবিবার

এভাবে কারও ভাল হয়

বিশাখা রায়


স্কুলের চৌকাঠ পেরিয়ে সবেমাত্র কলেজের দোরগোড়ায় পা রেখেছি। প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই এক আত্মীয়া— আমার ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের সংসার করাকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। কিন্তু তাতে আমায় ভালবাসায় কোন কার্পণ‍্য করেননি তিনি। ওঁর ইচ্ছে হতো পুজোপাঠের সময় স্নান সেরে, পাটভাঙা শাড়ি পরে মালা গাঁথতে গাঁথতে ওঁর পাশে বসি... একটু গান নিবেদন করি ওঁর ইষ্টদেবতার উদ্দেশে‌।
সবেমাত্র ঊনিশ বছর। দেখতে শিখছি তখন। তথাকথিত কমিউনিস্টদের চিনছি। দারুণ বিপ্লববাজির অন্তর্গত অদৃশ‍্য কাঁটাতার আর নিকষকালো হাতগুলোকে সনাক্ত করছি। দ্বিধা দ্বন্দ্ব থেকে নিজের মতো করে, একেবারে নিজের মতো করে সবটা বোঝার চেষ্টা করছি। তাই ওই সময়ে বৃদ্ধা আমার কাছে ঠিক কী চেয়েছিলেন তা বুঝিনি।
আজ ওঁর কথা মনে এল হঠাৎই। ধবধবে দুধ-সাদা গায়ে সাদা থানটি বড় মলিন দেখাত। নিজের বলতে মানে রক্তের সম্পর্কে তাঁর কেউ ছিল না। স্বামীর কেনা জমিতে একটা বাড়ি, কিছু গাছপালা আর বিধবা-পেনশনটুকু নিয়েই তিনি দিব‍্যি চলতেন। অবসরপ্রাপ্ত দিদির ছেলেকে পূর্ণ সংসারসমেত আশ্রয় দেওয়ার মত বড় মন ছিল ওঁর। আমার ঈশ্বরসেবায় মন নেই বলে কখনও জোর করেননি আমায়। একটু মিষ্টি রহস‍্যময় হাসি হেসে বলতেন— কখন যে গভীর ভক্তিতে ডুবে যাবি নিজেও টের পাবি না। আমিও হেসেই উড়িয়ে দিয়েছি সেকথা। কেবল গোধুলির শেষ আলো আকাশ বেয়ে দুধেল ধানের ক্ষেতে আলতো ছোঁয়া রাখলে— দূর থেকে শঙ্খধ্বনি ভেসে এলে― বাসায় ফেরা পাখির ডানায় ভর করে করে আজানের সুর ফিরে এলে― কি জানি কি হারানোর ব‍্যথায় কেন যে চোখ ঝাপসা হয়ে আসতো― তখন সেই অচেনা স্রষ্টার পায়ে সত‍্যিই কি মাথা নুইয়ে পড়ত না! সেসব কথা ওঁকে বলিনি কখনও। একটু বয়স বাড়তে ভাবতাম কি আর এমন চেয়েছেন উনি! কেবলমাত্র পুজোর সময় আমার সঙ্গ, প্রদীপ জ্বালানো আর কিছু গান শোনানো― এইটুকুই তো চাওয়া।
অনেকেই বেড়াতে গিয়ে নানান দেবদেবীর মূর্তি উপহার দিয়ে বলেছেন― কিচ্ছু করতে হবে না। শুধু সঙ্গে রাখ। আজও কোনও কোনও বন্ধুজন বলে― সন্ধেবেলায় সব ঘরের আলো জ্বেলে রেখো তো কিছুক্ষণ। এই সাঁঝবাতির মাধ‍্যমে সারাজীবন আমার সঙ্গে তারা জুড়ে রইল। এখন বুঝি আসলে সবটুকুই ভালবাসা। প্রত‍্যেকেই নিজের বিশ্বাসে থেকে আমার জন‍্য কেবলই নিরন্তর মঙ্গল চেয়েছেন। আমার সেই আশি ছুঁই ছুঁই বন্ধুটি তো কবেই চলে গেছেন। ওঁর পুত্রকন‍্যাসম ঠাকুরের সংসার আমার ঘরের সিংহাসনে আছেন কোনমতে কষ্টেসৃষ্টে। মাঝেমাঝে তাদের ধুলো ঝেড়ে ফুল জল দিই। তবে ওঁর মত রোজ হয় না।
গতকাল পঁচাত্তর পেরিয়ে যাওয়া এক উদারমনা ভক্তিমতী বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বর্ধিষ্ণু উচ্চশিক্ষিত পরিবারের মেয়ে তিনি। বিয়েও হয়েছিল তেমনি আরেক পরিবারে। দান ধ‍্যানেই তাঁর পরম প্রীতি। জীবনের নানা ওঠাপড়ায় তিনি একমাত্র তাঁর ঈশ্বরকেই বিশ্বাসের জায়গায় পেয়েছেন। সমস্ত জীবন ধরেই তাঁর অন্বেষণ বিশ্বাস আর শান্তি। সেই বিশ্বাসেই ঈশ্বর তাঁকে দেখা দেন। ঈশ্বর এভাবেই তাঁর ঘরের ছেলে। এখন সমস্ত বিশ্ব করোনা-আক্রান্ত। সবাই ঘরবন্দি লকডাউনে। তার মধ‍্যেই নীল ষষ্ঠী পুজোর যৎসামান‍্য ব‍্যবস্হা করেছেন। মঙ্গলকামনায় সকল প্রিয় মানুষের নামে মোমবাতি জ্বেলেছেন তিনি–আমার নামেও। ফোন করে বললেন সেই মোমবাতি শেষপর্যন্ত সোজা হয়ে জ্বলেছে। এই বন্ধুটি কিন্তু আমাকে এখনও দেখেননি। কেবল কথায় কথায় এমন ভালবাসা জন্মেছে!
অনেকে বলেন, যতদিন বাঁচি ততদিন শিখি। আমার মনে হয় যতদিন চলি ততদিন বাঁচি। এই চলনের তো নানান ধাঁচ ধরন। ইদানিংকালে লকডাউনের দৌলতে তো শারীরিক চলন পুরোপুরি বন্ধ। বারবার মন চলে যাচ্ছে জঙ্গলে-পাহাড়ে-নদীতে-সমুদ্রে। স্মৃতির পাতায় আগলে রাখা ছবিগুলো উল্টেপাল্টে দেখছি আর ভাবছি লকডাউন খুললেই―দে দৌড়! সেইসব কথা যারা জানে, তাঁদের কাছে।
আজ নীল ষষ্ঠী। এসব বিষয়ে তেমন ধারণা নেই। দেখেছি চড়কের মেলা, গাজন। খেয়েছি পয়লা বৈশাখের জম্পেশ বাঙালি রান্না। আর সবচেয়ে প্রিয় বৈঠকি আড্ডা। এইবারে সবটাই বন্ধ। গোধুলির রোদ্দুর বারান্দায় গ্রিলের ফাঁক দিয়ে মেঝেতে পড়ে আলপনা এঁকে ঘরে এসেছে গলন্ত মোমের মতন। মনটা কেমন করে উঠল! উৎকণ্ঠিত মন বলল তার খবর তো এল না। আর সবাই এখনও ভালোই আছে। কিন্তু সে কেমন আছে এই সময়? সেই মায়াময় আলোয় কি ছিল জানি না। কেবল কিছু গন্ধ যেন ভেসে এল–পাটভাঙা সাদা থান...পণ্ডস ল‍্যাভেণ্ডারডিউ পাউডার... খিলি পানের জর্দা... ধূপের ধোঁয়া... আবছায়া... লালচে সোনালি আভা... সেই পরিচিত স্বর...পাগলী, তোমার সঙ্গে আমার চিরকালের সম্পর্ক... ছেড়ে যাবার নয়... শেষ হবার নয়...!
আজ সন্ধেবেলায় আমি পুজোয় বসেছি। একটা বড় পিতলের রেকাবিতে সাজিয়েছি মোম―আমার প্রেমের নামে... বিশ্বাসের নামে... প্রিয় বন্ধুদের নামে... প্রতিটি প্রিয়জনের নামে... আমার বাংলাভাষার নামে... বাংলা গানের নামে... সুরের নামে... ছন্দের নামে... কবিতার নামে... স্বাস্হ‍্যের নামে... শিক্ষার নামে... স্বাধীনতার নামে... মুক্ত চিন্তার নামে... আমার দেশের নামে... পুরো বিশ্বের নামে... মানবতার নামে... সভ‍্যতার নামে... বৃক্ষের নামে... প্রতিটি প্রজাতির প্রাণীর নামে... মানুষের নামেও।
জিঙ্ক অক্সাইড ভিজিয়ে মেঝেতে এঁকেছি জটিল আলপনা। তার মাঝে এঁকেছি জালবন্দী করোনা। তার ওপরে চাপিয়েছি পাটকাঠি―ধর্মীয় ও অধর্মীয় মৌলবাদের নামে... হিংসে, লোভ, অহঙ্কার, অবিশ্বাস... যা কিছু কালো, তার নামে। প্রদীপ জ্বেলেছি শান্তির নামে। আগুন দিয়েছি পাটকাঠিতে। পুজোর নিয়মকানুন কিছুই জানার আগ্রহ হয়নি কখনও। ধরেছি আজানের সুর। বাজিয়েছি শঙ্খ। এ দুটো একসঙ্গে বড় সুরে বাজে! মোমবাতিগুলো জ্বালিয়েছি একে একে। চুপ করে বসে দেখছি। মোমবাতি জ্বলতে জ্বলতে ক্ষয়ে আসছে। কেবল শিখাগুলো অনির্বাণ! এভাবে কারুর ভাল হয়? কিংবা মঙ্গল?
সম্বিত ফিরল যখন চারিদিকে তরল অন্ধকার। আমার রেকাবিতে সবক’টি মোম গলে একাকার হয়ে গেছে― এক রেকাবি ভরা গলে যাওয়া মোম! একটিমাত্র শিখা নিবু নিবু আলো ছড়াচ্ছে। একটাই বিশ্ব— একটাই জীবন— একটাই চাওয়া— ভালবাসা আর শান্তি!

Post a Comment

0 Comments