পেজ থ্রি


‘উনিশে এপ্রিল’ : সম্পর্কের অন্তঃসঞ্চার 

সুমন গুণ 


বাংলা ফিল্মের ধারায় ঋতুপর্ণ ঘোষের অবস্থান খুব স্পষ্ট আর নিশ্চিত। তাঁর ছবির মতোই। বুদ্ধদেব অপর্ণা গৌতম-এর পরে ঋতুপর্ণ ঘোষের গল্পবলার দায়হীন আর কৌণিক ধরনটিই বাংলা ফিল্মের গ্রাহ্য প্রবণতা হয়ে উঠল নয়ের দশক থেকে। অথবা এমনও বলা যায়, ঋতুপর্ণর এই ধরনটি  তাঁর সময়ই ঠিক করে দিয়েছিল। খেয়াল করলে দেখা যাবে, সাত-আটের দশকে সারা ভারতেই ফিল্মের ভাষায় যে-দায়বোধের দাপট ছিল, কখনো কখনো আদর্শের প্রতি আস্থার যে-স্বাভাবিক প্রকাশ ছিল, তা নয়ের দশক থেকে কমতে শুরু করে। আর্ট আর কমার্শিয়াল ফিল্ম নামে দুটো আলাদা ঘরানার মধ্যে লড়াইটা  আটের দশক পর্যন্ত বেশ শোনা যেত, নয় থেকে যা নিঃশব্দে নিরর্থক হয়ে ওঠে। মনে আছে, বসন্ত শাঠে নামে একজন কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী ছিলেন আটের দশকে, যিনি এই দুটি ঘরানা নস্যাৎ করে গম্ভীরভাবে জানিয়েছিলেন যে তিনি শুধু বোঝেন ছবি দু’রকম হয় --ভালো ফিল্ম আর খারাপ ফিল্ম। সেই কথা শুনে আমরা কী খেপে গিয়েছিলাম! এর বিরুদ্ধে উৎপলেন্দু  চক্রবর্তী খুব ধারালো একটা লেখা লিখেছিলেন ব্যঙ্গ করে, এখনো মনে আছে। 
ঋতুপর্ণর প্রথম ছবি ‘হীরের আংটি’ আমি দেখিনি। এর পরের ছবিটি থেকেই তাঁর উত্থান। ‘উনিশে এপ্রিল’ কলকাতায় প্রথম দেখার পরে, যতদূর মনে পড়ছে, দিল্লি ফিল্মোৎসবেও আরেকবার দেখেছিলাম। সেরার পুরস্কার নিতে ঋতুপর্ণ সেবার দিল্লি গিয়েছিলেন। সেবার কথা হয়নি, কিন্তু ছবিটি নিয়ে পরে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল। নানা কথার সঙ্গে, সহাস্যে বলেছিলেন তিনি যে ছবিটির নাম ‘বসে কাঁদো’ হলেই মনে হয় ভালো হতো! ছবিতে কান্নাকাটির শট একটু বেশি আছে বলে মনে হয়েছিল তাঁর নিজেরই। যদিও,  নিরাসক্তির একটা ধরনও এই ছবির ভাঁজে ভাঁজে রক্ষা করতে পেরেছিলেন তিনি। ছবির শুরুতেই একটি বিহ্বল মৃতদেহ দেখা যায়, যার শরীরে ক্রমশ স্তূপ হয়ে উঠছে মালা। পর্দায় ছোটো ছোটো শটে একই সঙ্গে ফুটে ওঠে ছবির পরিচয়লিপি, শোনা যায় অন্য ঘরে চা আর খাবারের নিরুদবেগ ব্যঞ্জনশব্দ। দৃশ্যটি তারপর দেখাও যায়, চা তৈরি, সঙ্গে কথাবার্তা : ‘বডি কি রেখে দেওয়া হবে?’, ‘চিনির কৌটোটা দে তো’, ‘ট্রেটা দে’, সৎকারের আগে খাবার ফেলে দেবার রীতি নিয়ে : ‘সে তো রান্না, চায়ে কোনো দোষ নেই’। পাশের ঘরের মৃত্যুর সঙ্গে যেন এই ঘরের এক স্বাভাবিক কিন্তু অস্বস্তিকর সম্পর্ক রয়েছে। এই নিরাসক্ত আর একই সঙ্গে স্বাভাবিক অথচ বিচলিত প্রবণতাই ছবিটির বৈশিষ্ট্য। ছবির আগাগোড়া এই ধরনটি বজায় রয়েছে। নৃত্যশিল্পী সরোজিনী গুপ্তের স্বামী মারা গেছেন, শিল্পী তখন মাদ্রাজে। তাঁর অলংকৃত ছবিটি থেকে, তাঁর সম্পর্কে নানাজনের কথা থেকে টের পাওয়া যায় তাঁর সামাজিক ও পারিবারিক মর্যাদা, এই দুটি সম্পর্কের মধ্যে যে গোপন আর উচ্চকিত টানাপোড়েন আছে, তাও ধরা পড়ে। বাবা মারা যাবার দিন, শৈশবেই, মেয়ে মিঠুর সঙ্গে তার মা’র সম্পর্কের জটিলতা চেনা হয়ে যায় একটি কথাতেই –- পরিচারিকা বয়াকে বলছে সে : ‘মা ডাকলে কিন্তু তুমি যাবে না।’ মা ও মেয়ের সম্পর্কের মধ্যে এই আচ্ছন্ন ও জটিল সম্পর্কের নানা পরম্পরাই ছবিটিতে দেখানো হয়েছে। দেখানোর যে-ভঙ্গিটি নিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ, তা বিশুদ্ধ ন্যারেটিভ, তবে কখনো কখনো তা ভেঙেও দিয়েছেন তিনি। এই ভাঙন প্রথমে বোঝা যায় না, আর এই না বোঝার ফলেই চমৎকার সয়েও যায় তা। যা জানাতে চান পরিচালক, তাঁর আঁচ পেতে পেতে ছবিটি দেখা শেষ হয়ে যায়। 
মিঠুর শৈশব থেকে সরাসরি তার বিমূঢ় তারুণ্যে চলে আসে ক্যামেরা। মিঠুর সঙ্গে তার প্রেমিক সুদীপের সম্পর্কের মধ্যে যে-অস্বচ্ছ বিষণ্ণতা আছে, তার ছায়া মিঠুর ব্যবহারে ছড়ানো থাকে। ট্রেনে তাকে বিদায় জানাতে সুদীপ আসে না, ট্রেনের কামরায় উদবিগ্ন-উৎসুক তার চঞ্চল অপেক্ষার দৃশ্যটি বারবার দেখানো হয় ছবিতে। যেন এই প্রস্তুত অথচ অচরিতার্থ অপেক্ষাই তার জীবন, তার মা ‘ডান্সার’ বলে সুদীপের তাকে বিয়ে করতে না-চাওয়াটাই যেন স্বাভাবিক। যদিও তার একমাত্র নির্ভরতার জায়গাটাই এর ফলে ধসে যায়। বাবার সঙ্গে তার অসমাপ্ত সম্পর্কের পরে সুদীপের সঙ্গেই ঘন হয়ে উঠেছিল তার সবকিছু, তা-ও হারিয়ে যাওয়ায় খুব দ্রুত আর সংগত আবেগে আত্মহননের ট্যাবলেট কিনে আনায় সে। 
এই সময়ে, একমাত্র মা-ই ফেরাতে পারত তাকে। কিন্তু তখনো পর্যন্ত তার সঙ্গে  মা’র সম্পর্কের মধ্যে কোলাহলময় আর্তি ছাড়া আর কিছুই স্পষ্টভাবে তৈরি হয়নি। মা জাতীয় সম্মান পাওয়ায় তার নিরুপায় উদাসীনতা প্রায় ঈর্ষায় অনুবাদ হয়ে যায়। দুজনের সম্পর্কে  কোনো সাচ্ছল্য না থাকায় তাদের সব বিনিময় মনে মনেই নষ্ট হয়। শুধু, মা’র হাঁটুতে ব্যথার খবরে তার সচকিত দুশ্চিন্তায়, ‘তোমার গলায় পাউডার লেগে আছে মা’ বলার আন্তরিকতায় --- হয়ত তা আত্মহননের আগের আবেগে --- মেয়ের বিয়ের লক্ষ্যে মা’র শাড়ি-কিনে-রাখা-অভ্যাসে : ‘মা তো আমি আফটার অল’, এবং আরো অনেক ছোটো বড়ো কৌণিকে মাঝে মাঝে তারা ঘন হয়ে এলেও সম্পর্ক কিছুতেই সহজ হয় না।   এই দূরত্ব ভেঙে যাবার আগে কঠিন ঝড় ওঠে। অচেনা পাতা ও ধুলোয় ভরে ওঠে মেঝে। ঘরের সবকিছুই জায়গা বদল করে। ভেঙে যায় এতদিনের কাচ, বাইরের বাল্ব নিভে যায়। দুজনে, দুজনের দিকে মোমবাতির নিজস্ব আলোয় তাকায়, কথা বলে। বাবার সম্পর্কে মিঠুর যাবতীয় ধারণাকে অন্যরকম করে দেয় মা, ‘মনেপ্রাণে শিল্পী’ তার মা-র সঙ্গে ‘মিডিওকার’ বাবার সম্পর্কের নানা স্তর, ঈষৎ ফ্লাশব্যাকসহ, ধরা পড়ে। ভাঁড়ার ঘরের দরজা বাইরের দিকে খোলার ব্যর্থ কোলাহলের পর , অল্প চেষ্টাতেই ভেতরের দিকে খুলে যায়। বাবার ছবি ধরে , তারপর, মিঠুর ভেঙে-পড়া কান্নায়, তাই, মিশে থাকে আকাঙ্ক্ষা আর অসহায়তা, যন্ত্রণা আর আত্মসমর্পণ। তার আত্মহননের সিদ্ধান্ত নেবার সময় কলে জল পড়ার যে-অনবরত শব্দ হয়ে যায় মিঠুর নিরাসক্তির সমান্তরালে, তাও আর শোনা যায় না। দুজনের সম্পর্কের এই ঘনিষ্ঠ পরিণামেই শেষ হয় ছবি। সুদীপের আবার ফোন আসে। অনিচ্ছুক আর অভিমানী মিঠুকে ফোন ধরতে রাজি করায় মা, ‘দরকার পড়লে ডাকিস’ – এই আশ্রয়ের আশ্বাস নিয়ে মা দাঁড়িয়ে থাকে। ফোন হাতে সেদিকে তাকিয়ে উচ্চারিত হবার জন্য মুখ ফেরায় মিঠু। 
ছবিটি সফল হয়েছিল প্রতিটি চরিত্রের স্বাভাবিক অভিনয়ের জন্যও। মিঠুর জেদি ও বিশ্বাসী বিষন্নতা,  পাশাপাশি তার মা-র নির্মম লাবণ্য ছবির দুটি আলাদা প্রবণতার মেজাজ ঠিকঠাক ধরে দিয়েছিল।

Post a Comment

0 Comments