রবিবার

ট্যাঙা ভোলার লকডাউন

মঞ্জীরা সাহা


ক্লাস সেভেনের ঘর। বীজগণিতের ক্লাস চলছে। লম্বা ক্লাসরুমে তিনটে পাখার দুটো ঘুরছে। একটার ডানাগুলো কারা যেন বাঁকিয়ে রেখেছে। চৈত্রের এই গরমে সব রসিকতার মধ্যে কারুর নিশ্চয়ই এই রসিকতাটাই সবচেয়ে মজাদার লেগেছিল। বাকি ফ্যান দুটোর সঙ্গে কেউ রসিকতা করতে না এলেও সে দুটোর অবস্থা খুব খারাপ। দরদর করে ঘামতে ঘামতে এ স্কোয়ার বি স্কোয়ার-এর মাঝেই পেছন থেকে একটা ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। বার বার অস্পষ্ট ভাবে শুনতে শুনতে একবার স্পষ্ট হল আওয়াজটা। ‘ট্যাঙা ভোলা’ ‘ট্যাঙা ভোলা…’। ‘হি হি হি হি’।
ব্ল্যাকবোর্ডের থেকে মুখ ঘোরাতেই আবার সব চুপচাপ। আবার উল্টোদিকে ঘুরে কিছুক্ষণ কান পেতে থাকায় স্পষ্ট হল কাকে ক্লাসের ছেলেরা অমন করে ডাকছে। যাকে ওভাবে ডাকছে সে তখন অঙ্ক খাতার মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে দিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমি ছেলেটার সামনে হেঁটে যাওয়ায় যে যার মতো খোঁচা মেরে নেড়ে চেড়ে তুলে দিল। চোখ কচলাতে কচলাতে দাঁড়িয়ে পড়ে আমার দিকে কিরকম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইল।
ছেলেটির নাম শান্তনু। চেহারাটা অদ্ভুত। রোগা টিংটিঙে  হাড় বার হওয়া শরীর। মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায় জন্মের সময়ে ছিল বেশ ফর্সা। এখন একটা তামাটে পরত পরে গেছে। খোঁজাখুঁজি করলে ওর শরীরের আসল রঙটা কোথাও কোথাও দেখতে পাওয়া যায়। বাদামী চুলগুলির উপর ভালো করে তেল দিয়ে এসেছে। জুলপিটা অনেকখানি নেমে এসেছে গাল বেয়ে। সব কিছুর মধ্যে ঠোঁট দুটো অদ্ভুত রকম লাল।
ঘুমোচ্ছিলি কেন বসে বসে? তোকে ওরা ট্যাঙা ভোলা করে ডাকছে কেন রে?
চারপাশ থেকে আবার ফিক ফিক করে হাসির আওয়াজ।
মাথাটা একেবারে গলায় ঝুঁকে পড়ল। কোনও উত্তর নেই। পাশ থেকে একটি ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে ওর ঘাড় জড়িয়ে কথা শুরু করতে যাচ্ছিল। আমি ধমক দেওয়ায় হাত নামিয়ে বলল, আমাদের এই পিছনের মাঠে চড়কের মেলা হয় ম্যাডাম। ও তো রোজ এখন শিব সাজে। শিব সেজে ভিক্ষে করে বেড়ায়। পাড়ায় পাড়ায় ঘোরে। মুখে রঙ চঙ মেখে ওরে যা লাগে না! মাথায় লাল লাল জটা পরে। হাতে রাঙতার ত্রিশূল নেয়। তাই সব আমরা ওরে ‘ট্যাঙা ভোলা’ ‘ট্যাঙা ভোলা’ করে ক্ষেপাই। আপনি আসবেন ম্যাডাম আমাদের চড়কের মেলায়?
এটা এবছরের কথা না। দু’বছর আগের। এখন তো লকডাউন চলছে। স্কুল বন্ধ। সবাই ঘরে বন্দি। সেলিব্রিটিরাও। বাঁচা মরার খবরের মাঝে কিচেনে শোবার ঘরে কিভাবে তাদের দিন কাটছে টেলিকাস্ট হচ্ছে। দেখে আমাদের টাইম পাস হচ্ছে।
এখনও চৈত্রমাস চলছে। সামনেই সংক্রান্তি। ঘাড়ে এসির ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগছে। সামনে মোবাইল স্ক্রিনে ফেসবুকে খাবারের ছবি রেসিপি। হট কাফে চিকেনের রঙিন রঙিন ডিস।  দীর্ঘ একটা ছুটি। রাস্তায় বেরনো নেই। ট্রেন ধরা নেই। ভিড় ট্রেনে জায়গা পাওয়ার চিন্তা নেই। শুধু চিন্তা এ অবসর কাটবে কি করে!
ওই স্কুলের পিছনের বাঁশবাগানের ভেতর দিয়ে গিয়ে মাঠটা নিশ্চয়ই এখন ধূ ধূ করছে। পাশের ডোবাটা শুকিয়ে গেছে নিশ্চয়ই। টাক ফাটা রোদের তেজ এবার এর তেমন টেড় পাচ্ছি না ঘরে বসে। ওই আমাদের স্কুল বাড়িটা এই দুপুর বেলা খাঁ খাঁ করছে নিশ্চয়ই। প্রেয়ার লাইনের গান নেই। ক্লাস রুমের চিৎকার নেই। দাউ দাউ আগুনে বড় বড় কড়াইতে ঝোল ফুটছে না। ক্যানে করে বাড়ি নিয়ে যাওয়া সোয়াবিনের ঝোলমাখা ভাত পচে উঠবে কিনা সে চিন্তা ওদের এবার নেই। উলটে রাখা কালো কালো কড়াইয়ের উপর ধুলো পড়েছে নিশ্চয়ই।
আর সেই ট্যাঙা ভোলা! ও এখন কোথায়?
মনে পড়ছে না কবে যেন ওকে ইশকুলে লাস্ট দেখেছিলাম! খাবারের রেসিপি দেখতে দেখতে দিন গুনছি লকডাউন ওঠার। ও কি দিন গুনছে আগামী বছর চড়ক মেলার! নাকি অন্য কোথাও অন্য কোনও রাজ্যে ফ্ল্যাটবাড়ি নির্মাণের কোনও সাইটে কাজে যাওয়ার?

Post a Comment

0 Comments