লকডাউনের দিনলিপি

দিনগুলো ঘুমিয়ে রয়েছে

এলা বসু 


লকডাউনের দিনগুলো কিছুটা ঘুমিয়ে রয়েছে, এই ঘুম ঘুম দিন কোমায় চলে যাবে না তো? আশংকা, উদ্বেগ সকলের। এই নিত্যবন্দী, নিঃসঙ্গ, শ্বাসরুদ্ধ দিনগুলো সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতন ভিতরে ভিতরে প্রস্তুতি নিচ্ছে না তো আগামীতে এক অজানা আকস্মিক বিস্ফোরণের? জানি না, হয়তো নিচ্ছে, হয়তো নিচ্ছে না। কিন্তু এই অজ্ঞাতকুলশীল বিরোধীপক্ষের মনে কি আছে সেটা না জেনে এই বিপদসংকুল সময়কে অবসর হিসাবে কি করে চিহ্নিত করব? চোখ বন্ধ করে আমরা রাখতেই পারি, কিন্তু ঝড় তো আমাদের দেখতে পাবে, সে কেন রেয়াত করবে? তবু, ভালো থাকতেই হবে, ঘরে বসে মন ভালো রাখতেই হবে, পারিবারিক, সামাজিক দায়বদ্ধতা সেরকমই ইঙ্গিত করে। এই কদিনে সেই সূত্র ধরেই ফিরে এসেছি আমার অভিমানী, বহুকালের পুরোনো, কিছুটা ভাঙা, ধুলোপড়া হারমোনিয়ামের কাছে। সকাল বিকেল সে আমাকে একটা সাময়িক আশ্রয় দেয়, মানসিক স্থিরতা দেয়।
আমার ঘরটিতে বিছানার এক পাশে হারমোনিয়াম, বাকি জায়গাটুকুতে হাজারখানা বই ছড়ানো ছিটানো। সামনে বিভিন্ন লেখকের ও বিষয়ের অনেকগুলো বই একসঙ্গে না দেখলে মানসিক শান্তি পাই না। অনেক সময়েই একটানা কোনও বই হয়তো পড়তে ইচ্ছে করল না, আরেকটাতে হাত পড়ল। এখন এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ পেয়েছি এই ঘরে। জানলা হাট করে খোলা, অল্পস্বল্প লোকজন যাওয়া আসা করছে, কিন্তু বেশ শান্তি আছে। দ্রুত একটার পর একটা বই শেষ করে ফেলছি। যেমন কামুর আউটসাইডার, মার্কোয়েজ এর মেমোরিজ অফ মাই মেলাংকোলি হোরস, সুধীর দত্তের গীতা, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী ও নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ছোট গল্প, চিন্ময় গুহর ঘুমের দরজা ঠেলে, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা, প্রতিভা বসুর  মহাভারতের মহারণ্যে, সুধীর চক্রবর্তীর গভীর নির্জন পথে, সুমন গুণের প্রসঙ্গ বুদ্ধদেব বসু ইত্যাদি আর অসংখ্য কবিতার বই তো আছেই।
লকডাউনের দিনলিপির মধ্যে যেটা না বললেই নয়, সেটা হল, ছোট থেকেই আমি বেশ  ঘরকুনো তাই ঘরে থাকা খুব কঠিন কাজ নয় আমার জন্য। কিন্তু বই হলেই তো চলবে না!  বিভিন্ন সাইজের নোটবুক, ডাইরি সেগুলো তো ফেলে এসেছি সল্টলেকে দুদিন পরে নিয়ে আসব ভেবে, সেই দুদিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে চলেছে। বস্তুগত আকর্ষণ বলতে সারি সারি পছন্দের বই, বিভিন্ন রকমের কলম, নানা রকমের ও সাইজের নোটবুক, ডাইরি এগুলো অন্যতম। এদের জন্য বিরহ শুধু নয়, বেশ দুর্গতি ও হচ্ছে বৈকি। চিন্তা ভাবনা আছে, বিষয় বৈচিত্র আছে, কলমও আছে কিন্তু লিখে রাখার জায়গা নেই।
ট্রাঙ্কের ভিতর থেকে ধুলো ঝেড়ে পুরোনো অনেক বই বার করলাম কদিনে, সামনে দেখেও সুখ। বারবার  মনে পড়ছে ২০০৬ সালের কথা, প্রথম সন্তানটি মিসক্যারেজ হয় বলে দ্বিতীয়বার কনসিভ করলে ডাক্তার বেডরেস্টে থাকতে বলেন, সেই সময়েও বইপত্রে ডুবেছিলাম। বেশ মনে পড়ছে, শরদিন্দু দ্বিতীয়বার পড়ছিলাম তখন, প্রথমবার তার বছর দশেক আগে পড়েছিলাম। তো, মজার ব্যাপার হল, অধিকাংশ ব্যোমকেশের রহস্যগুলোর শুরুতেই মনে পড়ে যাচ্ছিল পরপর কি কি ঘটবে, আর সেটা নির্ঘাত স্মৃতি থেকেই, কিন্তু আমি নিজের বুদ্ধিবলে সব আগে থেকেই ধরে ফেলছি এমনটা ভেবে এক অদ্ভুত আত্মতুষ্টি অনুভব করছিলাম, যেন আমার বুদ্ধি আচমকা ক্ষুরধার হয়ে উঠছিল তলে তলে, এই সুযোগে তার প্রকাশ ঘটল!
যাই হোক, ফিরে আসি এখনকার দিনলিপিতে। বাড়ির রেডিও খারাপ, টিভি দেখছি না নিউজ চ্যানেল বাদে, মোবাইল হাতে পাই মেরেকেটে কয়েক ঘন্টা। বাকি সময়টুকুতে আমি কিন্তু ফিরে গেছি সেই বছর কুড়ি আগের মুঠোফোন আবিষ্কারের প্রাক দিনগুলিতে। জানলা দরজা টেবিল বেশি বেশি করে পরিষ্কার করছি, সবজি ধুচ্ছি, বাইরে থেকে ঘরে যা কিছু ঢুকছে সবই ধুচ্ছি আর ধুচ্ছি। আত্মীয় বন্ধুরা জানে আমি অসামাজিক, জীবনেও কাউকে নিজে থেকে ফোন করি না, হোয়াটস্যাপ এর কোনও গ্রূপেই আমি একটিভ নই।
এইরকম একটা নিভৃত নির্জন সময়ে বিমল করের খড়কুটো, রবীন্দ্রনাথের মাল্যদান, শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের নিশিযাপন, মার্কোয়েজ এর লাভ ইন দা টাইম অফ কলেরার চরিত্রগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। ঘটনাপ্রবাহ যেমন খুশি যখন তখন মনের মধ্যে ছুটে বেড়াচ্ছে। করোনার  দিনগুলোর  মধ্যে দিয়ে যাবার সময় একটা সরু লাল মার্কারের  দাগ পড়ে যাচ্ছে কত সম্পর্কে! কে ছুঁয়ে থাকল, কে ফিরে দেখেনি কখনও, কে মেঘ না চাইতে জলের মতন আকাশ ফুঁড়ে অকাল জ্যোৎস্না নামিয়ে আনলো। অনিশ্চিত কে আপন করতে করতে কত নিশ্চিত, নিশ্চিন্ত সম্পর্ক নিথর, নিস্পন্দ  হয়ে গেলো করোনা বিপর্যয়ে l সবকিছুর একটা সময়সীমা থাকে, পূর্ব নির্ধারিত। তারপরে আর ইলাস্টিকের মতন টেনেও দুটো ভিন্ন গ্রহের দূরত্ব ঘোচানো যাবে না, কারণ ততদিনে তাদের মধ্যে অন্য গ্রহ ঢুকে পড়ছে প্রেম, পাপ, বিষন্নতা অথবা বিপর্যয়ের।

Post a Comment

0 Comments