লকডাউনের দিনলিপি

কানে ভেসে আসছে ব্রিটনি

সুপ্রভা মণ্ডল


এপ্রিলের শুরু। এই নিয়ে প্রায় দু’সপ্তাহের উপর হয়ে গেল বাড়ির বাইরে পা ফেলিনি। কারণটা এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবীকেই তোলপাড় করে দিচ্ছে। শুরুটা গত বছরের শেষ থেকেই তবে ২০২০ আমাদের জন‍্য এরকম একটা সময় নিয়ে আসবে তার ধারণা ছিল না। ভাইরাসের প্রকোপ থেকে বাঁচতে এই সময় আমার রোজকার জীবনে তেমন কিছু পার্থক‍্য আসেনি। এমনিতেই ঘরকুনো তাই কোনও অসুবিধা হয় না কিন্তু সবাইকে একসঙ্গে ঘরে বন্দি করে দিলে সেই পরিস্থিতি কিছুটা অন‍্যরকম হয়ে পড়ে বইকি!
কিন্তু লড়াইয়ের এই একটাই পথ এখন। টিভি খুললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিভৎস পরিস্থিতি, মৃত‍্যু আর হাহাকার। দেশের অবস্থাও কিছু স্বস্তি আনে না। সবাই বলছে পৃথিবী অসুখে ভুগছে! কিন্তু আমার মনে হয় প্রকৃতি কিছুটা হলেও রেহাই পেয়েছে। আজকাল সকাল ১০টাতে, দিনের ব‍্যস্ত সময়েও মানুষজনের হইহল্লা চোখে পড়ে না। তার বদলে পাখির আওয়াজ ভেসে আসে। রাস্তাঘাটের জানজট ধুলো, ধোঁয়া, ছুটোছুটি সবকিছুই প্রায় অদৃশ‍্য এখন। এক ধাক্কায় জীবনের গতি স্লথ হয়ে গেছে। যারা ঘরে বসে কাজ করেন না তাঁদের ‘Work from home’ এর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ঠিকই কিন্তু যারা আমার মতো পড়ুয়া তাদের যে ঠিক কি করা উচিৎ সেটা বোঝা মুশকিল হয়ে পড়েছিল। হ‍্যাঁ পড়াশোনা তো আছেই তবুও এমন সংকটের পরিস্থিতিতে কি সারাদিন বই মুখে দিয়ে বসে থাকা যায়? তাই এই কয়েকটা দিন ধরে কিছু পুরনো অভ‍্যেসকে নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। আমার বাড়িতে যে একটা ছাদ আছে তার কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। ডিপার্টমেন্ট থাকলে তো ভুলেই যাই আর ছুটির দিনে বেশিরভাগ
সময় পেরিয়ে যায় স্মার্টফোনের স্ক্রিনের উজ্জ্বল আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে। সেই কারণেই একদিন বিকেলে একাই চলে এলাম ছাদে। এসে যেটা  দেখলাম  সেটা আশা করিনি। পাড়ার বেশিরভাগ লোকজন তখন ছাদে উঠে এসেছে। কেউ কেউ নিজের মতো ঘুরছে আর বাকিরা গল্পে মেতে উঠেছে যথা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে। প্রতিদিন যন্ত্রপাতির আকর্ষণ ভুলে এমন দৃশ‍্য উপভোগ করা সম্ভব নয় জানি কিন্তু বসন্তের সেই বিকেলবেলা আমাকে ছোট্টোবেলার একটা স্মৃতি উপহার দিয়ে গেল। ইদানিং মানুষে মানুষে যোগাযোগ বেড়ে উঠেছে। রোজকার কর্মব‍্যস্ততার মধ‍্যে যাদের সঙ্গে কথা বলা হয়ে ওঠে না বা কল্ হিস্টরিতে যাদের নাম দেখা যায় না, তাদের কাছ থেকে এই সময়ে ভাল থাকার খবর পাওয়া গেলে অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। এর মধ‍্যেই একদিন ভিডিও কল—এ আমার এক ছ’বছর বয়সী ছোট্ট বোনের সঙ্গে কথা চলছিল। এই বন্দীদশায় বড়দেরই যেখানে হাসফাঁস অবস্থা সেখানে ওর মতো শিশুদের পক্ষে  এতদিন ধরে বাড়ির মধ‍্যে আটকে থাকা কঠিন। তাও দেখলাম কি সুন্দর মনখারাপ না করে কত নতুন নতুন ছবি এঁকেছে, হাতের কাজ করেছে... সেই সবই দেখাতে ব‍্যস্ত ছিল। ওকে দেখেই আবার নতুন করে রঙ তুলি নিয়ে বসতে ইচ্ছে হল।
আজকের খারাপ দিনগুলোর মধ‍্যে চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই কিছু ভালো জিনিস খুঁজে পাওয়া যায়। এসব ভাবতে ভাবতে লক্ষ‍্য করেছি মন সেই বাইরের দিকেই উড়ে চলে যায়... সেটাই তো স্বাভাবিক! এই মূহুর্তে যেমন পাশের বাড়ি থেকে কানে ভেসে আসছে ব্রিটনির গানের টুকরো টুকরো কথা— ‘‘my loneliness is killing me...’’ হ‍্যাঁ এটাই তো সবচেয়ে বড় শাস্তি! আবার ঠিক নিয়ম মেনেই স্বাভাবিক দিন ফিরে আসবে সেই অপেক্ষাতেই পথ চেয়ে থাকা।

Post a Comment

0 Comments