রবিবার

ভাঙনের বিপন্ন আজান

সুমন গুণ


চেনা মাটির সঙ্গে, চেনা চারপাশের সঙ্গে, চেনা পাড়ার সঙ্গে বিচ্ছেদের যে কোনও মুহূর্তেই ভেতরে ভাঙনের আওয়াজ টের পাওয়া যায়। এক বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়ি যাবার মধ্যেও যে বেদনা, তার সঙ্গে নিজের দেশ থেকে অন্য দেশে ছিন্নমূল হয়ে পালিয়ে যাবার যন্ত্রণার তফাতটা শুধু স্থানের নয়, শুধু ছেড়ে যাওয়ার নয়, চিরকালের জন্য নিজের অস্তিত্বের অংশকে বিচ্ছিন্ন করার যন্ত্রণা এখানে প্রধান।
এতদিন ধরে বেঁচে থাকার সব মুহূর্ত অর্থহীন হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা। এতদিনের বারান্দা, পাশের বাড়ি, পাড়ার মোড়, অফিসফেরত সন্ধে ... সব খাদের কিনারে ঢলে যাওয়ার যন্ত্রণা।
ছিন্নমূল মানুষের যন্ত্রণার কথা, বিচ্ছেদের কথা, বিপন্নতার কথা আমাদের সাহিত্যে, ছবিতে, ফিল্মে নানা ভাবে নানা সময় ধরা পড়েছে। গল্প-উপন্যাসে তো আছেই, কবিতাতেও তার উচ্চারণ খুব কম নেই। আমরা জানি, অডেন তাঁর একটি কবিতায় এই বিভাজনের  মধ্যে যে মূঢ়তা, যে কুৎসিত অমানবিকতা তাকে স্পর্শ করেছেন। বিপর্যয়ের পর থেকেই বাংলা সাহিত্য এই ‘অন্তহীন আত্মলাঞ্ছনার ক্ষত’ ধারণ করেছে। রমেশচন্দ্র সেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মনোজ বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরকিশোর ঘোষ, সাবিত্রী রায়, নারায়ণ সান্যাল, হাসান আজিজুল হক,  জ্যোতির্ময়ী দেবী, মাহমুদুল হক, সেলিনা হোসেন, অমিয়ভূষণ মজুমদার, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র রায়, প্রফুল্ল রায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, দেবেশ রায়, শহীদুল্লাহ কায়সার, সত্যপ্রিয় ঘোষ, সরোজকুমার রায়চৌধুরী, শান্তা সেন, অভিজিৎ সেন, অমলেন্দু চক্রবর্তী, জ্যোৎস্নাময় ঘোষ, অমর মিত্র ও আরও কয়েকজন কথা-সাহিত্যিক এবং বিষ্ণু দে, অন্নদাশঙ্কর রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুনির্মল বসু, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, মণীন্দ্র রায়, চিত্ত ঘোষ, রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী , মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, সলিল চৌধুরী, তারাপদ রায় সহ আরও অনেক কবির লেখা এই সূত্রে আমাদের মনে পড়বে। ঠিক এই মুহূর্তের কবিতায় দেশভাগের যন্ত্রণা আর আত্মবিলোপের বেদনার কথা তেমন ভাবে না থাকলেও কারও কারও কবিতায় একই ভাষার মধ্যে সীমান্তের কাঁটাতারের জন্য যে বেদনা তা ধরা পড়েছে।
হয়তো যতটা উচিত ছিল, ততটা, এই ক্ষত, আমাদের লেখায় ফুটে ওঠেনি। এর সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং ব্যক্তিগত নানা কারণের উল্লেখ করা হয়েছে নানা জায়গায় অনেকবার। কেউ বলেছেন একের পর এক আঘাত আমাদের স্তম্ভিত করে দিয়েছিল বলে আমরা লেখায় সাড়া দিতে পারিনি। কমিউনিস্ট পার্টির আওতায় থাকা আমাদের লেখকদের রাজনৈতিক অক্ষমতার কথা বলেছেন অনেকে। দেবেশ রায়-এর মতো কেউ কেউ মনে করেন কদর্যতা খোঁটার অনীহাই এই নীরবতার কারণ। আবার, অসাম্প্রদায়িকতার বাধ্যতামূলক মুখোশ পড়ে থাকার পরিণাম এই নীরবতা, এমনও কেউ কেউ মনে করেন। নীরবতার অন্য প্রান্তের ভয়ংকর কিছু ব্যক্তিগত তথ্যের খোঁজ দেন আমাদের উর্বশী বুটালিয়ার মতো বেশ কয়েকজন অনুসন্ধিৎসু গবেষক-লেখক।
দেশভাগের যন্ত্রণা অনেক ছবি, অনেক স্মৃতি, অনেক বিক্ষোভ আশ্রয় করে ভাষা পেয়েছে বাংলা কবিতায়। কখনও পথে, স্টেশনে শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্দশার উচ্চারণে, কখনও ফেলে আসা গ্রামের, দেশের স্মৃতিকথার উল্লেখে, কখনও চেনা মানুষজনের সঙ্গে বিচ্ছেদের যন্ত্রণায়, কখনও বা এই নির্যাতনের জন্য দায়ি চরিত্রদের প্রতি ব্যঙ্গ আর কৌতুকে দেশভাগ বারে বারে হানা দিয়েছে।
কখনও অন্য দেশে গ্লানিময় বেঁচে থাকার লজ্জা আর আক্ষেপ বিষয় হয়েছে কবিতার। সব হারানো মানুষদের বিপন্নতার কথা, আশ্রয়হীনতার কথা, বেঁচে থাকার শোচনীয় অসহায়তার কথা বিষ্ণু দে লেখেন এভাবে :
‘‘এখানে ওখানে দেখ দেশছাড়া লোক ছায়ায় হাঁপায়
পার্কের ধারে শানে পথে পথে গাড়ি বারান্দায়
ভাবে ওরা কী যে ভাবে! ছেড়ে খোঁজে দেশ/ এইখানে কেউ বরিশালে কেউ কেউবা ঢাকায়’’।

পাশাপাশি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্বপশ্চিম’ উপন্যাসের এক চরিত্রের এই বিপন্ন বিস্ময়ও সমান সত্য: ‘সত্যই আইশ্চর্য শহর। শিয়ালদহ ইস্টিশনে রিফিউজি থিকথিক করত্যাছে, তারই মধ্য দিয়া হৈ হৈ করতে করতে বনভোজন পার্টি যায়’।
দেশভাগের যন্ত্রণা ত্রিপুরার কবিরা ধরে রেখেছেন কবিতায়। ফেলে-আসা দেশের স্মৃতি, পরিজন হারানোর জ্বালা, নতুন জায়গায় লড়াইয়ের ধারালো অভিজ্ঞতার লালন পেয়েছে তাঁদের লেখা। সলিলকৃষ্ণ দেববর্মণের ‘মধ্যরাতের স্বাধীনতা’ কবিতা—
‘‘আমাদের দেশের বুকে স্বাধীনতা এসেছিল
মধ্যরাত্রে এ কথা বলছি না, তবু—
আজ প্রশ্ন জাগে, বুকে হাত দিয়ে টের পাই
কোথায় সে সোনালী স্বাধীনতা ।
নাকি সব ভুলে গেছি কোথায় রেখেছি তারে’’।

বরাক উপত্যকার কবিতাতেও দেশভাগের যন্ত্রণা নানাভাবে ছায়া ফেলেছে। শক্তিপদ ব্রক্ষ্মচারীর কবিতায় :

‘‘আমাদের গ্রাম থেকে শহর ছিল পঁচিশ মাইল দূরে
আমরা স্বপ্নে ছাড়া ট্রেন ও মোটর গাড়ি দেখিনি বহু দিন
তিন বাঁক উজানের একজন হোমীওপ্যাথ সাত ইঞ্চি শিশিতে করে
শাদা জলের ওষুধ দিতেন আমাদের
আমাদের  কোনো ডাকঘর বা ‘সভ্যতা বলে
তা অনেকদিন আমাদের জানা হয়নি ।

এতো সব অসুবিধা মধ্যেও আমাদের ত্রিসীমানায়
একটি নদী ছিল এবং আপনারা বিশ্বস না
করলে সত্যিই দুঃখ হবে
নদীটির নাম ছিল, বিবিয়ানা’’।

দেশভাগের প্রত্যক্ষ কামড় যাঁদের সহ্য করতে হয়েছে কিংবা যারা পরোক্ষভাবে হলেও টের পেয়েছেন এর নির্মম আর উদাসীন ছোবল, তাঁদের লেখায় এই ঘটনার প্রভাব পড়েছে সরাসরি। তার পরের প্রজন্মের লেখায় এই প্রভাবের ধরন ও তাৎপর্য পাল্টে পাল্টে গেছে। আর গত পনের-কুড়ি বছরে যাঁরা বড় হয়েছেন তাঁদের লেখায় একই ভাষার দুটি দেশের  সম্পর্কের দোলাচলের কথা, বন্ধনের কথা অন্যভাবে এসেছে।
একটি রাজ্যে নাগরিকপঞ্জি প্রকাশের পর আবার নতুনভাবে শরণার্থী হয়ে ওঠার আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে আমাদের দেশে। অসমে নানা কারণে বিদেশি-বিরোধী মনোভাবের আন্দোলনমুখর ইতিহাস আছে। নানা সময়ে এই অঞ্চলের ভৌগোলিক চেহারাও যেমন পালটেছে, জনবিন্যাসের গঠনও বদলে বদলে গেছে। নানা উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন অভিযোগ ঠেকা দিয়ে রাখা হয়েছে। ১৯৮৫ সালে অসম চুক্তি একটি বড়ো উদ্যোগ, যা এই অঞ্চলের নাগরিক পরিচয়ের সমস্যাকে নির্দিষ্ট ভাবে সামাল দিতে চাইল। এই চুক্তিতেই ঠিক হল, ১৯৭১-এর আগে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের ভারতীয় নাগরিক বলে মেনে নেওয়া হবে। কিন্তু সমস্যা এতেও মেটেনি, ২০০৫ সালে আরেকটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের সাহায্যে তা সমাধানের চেষ্টা হয়, তারও পরে প্রায় পাঁচ বছর বিষয়টি চাপা ছিল। ২০০৯ সালের একটি আবেদনের ভিত্তিতে ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ফসল নাগরিক পঞ্জির এই নবতম উদ্বোধন।
এটি বের হবার পর যে আতঙ্ক আর অসহায়তার রোল উঠল, তা মনে পড়িয়ে দেয় বিশ্বব্যাপী শরণার্থী সমস্যার ভয়াবহতাকে। ২০১৭ সালে নানা দেশ থেকে ইওরোপে আশ্রয় নিতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরের পথেই মারা গেছেন বা নিখোঁজ হয়েছেন ৩০০০-এর বেশি মানুষ, ২০১৬ তে সংখ্যাটা ছিল ৫০০০-এর ওপরে। একটি হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি মুহূর্তে উৎখাত হওয়া জনসংখ্যার অর্ধেকই শিশু। আর এই শিশুরা মা বাবা আত্মীয় পরিজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন। এর চেয়ে পাশবিক, এর চেয়ে নৃশংস আর কিছু হতে পারে না, বলেছেন নোয়াম চমস্কি, এই সেদিন। নাগরিক পঞ্জিতেও দেখা গেছে, পরিবারের একজনের নাম থাকলেও নেই অন্যজনের নাম।
এখন কী হবে?
বাচ্চা থেকে যাবে, মা বাবা চলে যাবে?
কোথায় যাবে?
বাংলাদেশে?
সেটা যে কতটা অবাস্তব একটি প্রস্তাব সেটা রাজনৈতিক দলগুলি জানে। ওপার থেকে এর মধ্যেই একাধিক বার্তা এসে গেছে এই মর্মে যে বাংলায় কথা বললেই তাকে বাংলাদেশি বলা চলে না। এই গোটা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যে বাংলাদেশের কোনও সম্পর্ক নেই তাও প্রকাশ্যে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। (এই তৎপরতা স্বাভাবিক, কারণ একাধিক রাজ্যের সরকারও ঘোষণা করেছেন যে সেই রাজ্যেও ‘বাংলাদেশিদের’ চিহ্নিত করে ফেরত পাঠানো হবে।) ১৯৫০ সালের নেহরু-লিয়াকত চুক্তির মর্ম নিয়ে কোনও পক্ষেরই মাথাব্যথা নেই। তাহলে? ক্যাম্পে রাখা হবে? কটা ক্যাম্প বানানো হবে?
এইখানেই খেলাটা ধরেছেন রাজনৈতিক নেতারা। অসম চুক্তির সময় ১৯৭১ থেকে ১৯৮৫ সালের দূরত্ব ছিল ১৪ বছরের। এখন সেটা হয়ে গেছে প্রায় ৫০ বছরের। এটা না বোঝার কারণ নেই যে প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল এদেশে যাঁরা আছেন তাঁদের বিদেশি বলে দেগে দেওয়া কার্যত অসম্ভব। এবারে শোনানো হচ্ছে, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের গল্প। পরিষ্কার বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে একটি সম্প্রদায়ের বাঙালিদের চিন্তার কিছু নেই। এই বিল পাস করে তাঁদের শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করে রেখে দেওয়া হবে। বাকিরা হবেন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী।
এই মর্মে প্রকাশ্য ঘোষণাও হয়েছে। বিভাজনের এই ছক শুধু যে দুটি সম্প্রদায়কে আলাদা করে দেবে তাই নয়, সারা ভারতে ধর্মীয় মৌলবাদের প্রচারে কাজে লাগবে।
এই পরিবেশে নতুন করে আবার এই সময়ের লেখায় ফিরে আসছে উৎখাত হবার ভয়, আতঙ্ক আর উদ্বেগ।
উঠে আসছে মিঞা কবিতা সহ নানা স্তরের কবিতার কথা। একটি মিঞা কবিতা তুলছি, যেখানে এই বিপন্নতার ভাষা ধরা পড়েছে :
‘‘লিখা
লিখি লোয়া
মই এজন মিঞা
এনআরসি-র ক্রমিক নং ২০০৫৪৩
দু’জন সন্তানর বাপেক মই
অহাবার গ্রীষ্মত লব আরু এজনে
তাকো তুমি ঘিন করিবা নেকি
যিদরে ঘিন করা মোক?’’

সুমনা রহমান চৌধুরীর রূপান্তরে :
‘‘লিখ
লিখে রাখ
আমি একজন মিঞা
এনারসি-র ক্রমিক নং ২০০৫৪৩
দুই সন্তানের বাবা আমি
সামনের গ্রীষ্মে জন্ম নেবে আরও একজন
তাকেও তুমি ঘৃণা করবে কি
যেভাবে ঘৃণা কর আমায়?’’

Post a Comment

0 Comments