ব্লগ : ওদের কথা/ ১

ব্লগ : ওদের কথা/

পুত্রবতীর প্রার্থনা

মঞ্জীরা সাহা


ঝাঁ ঝাঁ করা রোদ ব্যাকগ্রাউন্ড করে মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা রোগা চেহারায় গায়ে আঁচল দেওয়া। হাতে স্টিলের এক খানা ক্যান। টিফিনের ঘণ্টা পড়েছে। বাইরে থেকে যে ঢোল বাজার আওয়াজটা আসছিল সেটা ছেলে মেয়েদের চিৎকারে মিলিয়ে গেছে। মিড ডে মিলের ঘরে লাইন পড়েছে। হাড় বের করা শুকন চেহারার এক মহিলা মাংসের গামলার পাশে লোহার খুন্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশের একজন হাতা দিয়ে ঢেলে যাচ্ছে থালায় থালায়। আগের মহিলাটির কাজ হল কেউ খাওয়া শেষে আবার লাইনে এসে খেতে দাঁড়ালো কিনা লক্ষ্য রাখা।
এই হারামজাদা তোরে না এই মাত্র দেখলাম। যা পালা, বলে লোহার খুন্তিটা যতবার উঁচু করছে ততবার ডান বুকের পাশ দিয়ে ব্লাউজের ফাটা জায়গাটা একটু একটু করে বেড়ে চলেছে। মারামারি ঠেলাঠেলি হচ্ছে লাইনে। স্থির শুধু একজন। হাতের ক্যানটাকে আঁচলের তলায় অর্ধেক ঢেকে পায়ের আঙুলগুলো কুচকে মাথা নিচু করে লাইনের শেষে দাঁড়ানো। ঢোলের শব্দটা চড়কের মেলার। দিনটা নীল পুজো। মহিলাটি থু থু গিলতে গিলতে গিলতে এক আধবার চোখ তুলে দেখে নিচ্ছে লাইন কতদূর এগোল।
দিদিমণিদের ফেলে দেওয়া শাড়ি সায়া ব্লাউজের বদলে সে দিদিমণিদের বসার জায়গা মোছে হাত রাখার জায়গার ধুলো ঝাড়ে জগে জল ভরে ঝাট দেয় স্টাফ রুম। সাথে মিড ডে মিলের শেষে সামান্য কিছু খাবার। আজ মুরগীর মাংশ। আজ তাই ওই রোগা বাসন্তীর কড়া পাহাড়াও বেশি। সে মিড ডে মিলের রাঁধুনি। তাদের নিজেদের ভাগ থেকে একটুও যাতে কম না পড়ে সেদিকে সব সময়ে সতর্ক।
ক্যান হাতে মহিলার আজ উপোস। এখান থেকে বাড়ি গিয়ে পুকুরে ডুব দেবে। ছেলেটার জন্য একটু মাংসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে। দু পিসের বেশি দেবে না ক্যানে।
যে ছেলের জন্য ওনার এই উপোস সে ছেলে কোনওদিন ইশকুলে আসেনি। জড়দ্গব। মুখ থেকে যত নীচের দিকে তাকানো যায় শরীরটা কিরকম ছোট হতে হতে দলা পাকিয়ে গেছে। বয়স সতের। যত বড় হয়েছে চেহারাটা ছোট হতে থেকেছে। ছেলের পরে মেয়ে। কুচকুচে কালো মেয়েটির শরীর শ্বেতিতে সাদা হতে হতে নিজের গায়ের রঙ অবশিষ্ট আছে আর কিছু জায়গায়। ক্যানের উপর মাংস নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বেলা প্রায় পড়ে এলো।
‘নীলের ঘরে দিয়া বাতি
ঘরে যাও গো পুত্রবতী’ বিড়বিড় করে কিসব আওড়াতে আওড়াতে পুকুরে ডুব দিচ্ছে। ভেজা কাপড়ে পুকুর থেকে উঠে গিয়ে পোস্ট অফিসের উলটো দিকের ভাঙা মন্দিরের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
দুদিন পর আবার মিড ডে মিলের লাইন। ওকে দেখে আজ বাসন্তি করল তাড়া।
—তোমার কোনও আক্কেল জ্ঞান নাই গো! জানো না এই বারোয়ারি রান্নায় আমিষ নিরামিষের ভাগ হয়না। তোমাদের না ওষুঝঘর।
ছেলেটা অমন বিছানায় শুয়ে থেকে থেকেই মারা গেছে।
পর দিন থেকে আবার দিদিমণিদের চেয়ার মুছেছে। জগে জল ভরেছে। এবার বাড়ির থেকে ইশকুলের কাজ বেশি।  সেইকদিন ক্যান খালি নিয়ে ফিরে গেছে বাড়ি। দিন পনের পর থেকে আবার মিড ডে মিলের লাইনে দাঁড়িয়েছে। পরের বছর নীল পুজোর দিনে চৈত্র মাসের পচা পুকুরে স্নান করতে  করতে আবার কিসব বিড়বিড় করেছে। মেয়েটির শরীরটি এই  একবছরে যত বড় হয়েছে যত যৌবনের লক্ষণগুলো ফুটে উঠেছে তত শ্বেতিতে সাদা হয়ে উঠেছে ওর শরীর ।
আগেরবার ওই পুত্রবতী মায়ের প্রার্থনাটা কি ছিল আর এই পরের বারেরটাই বা কি? তার মেয়েটি যেন আরও বড়, আরও বড় হয়!  

Post a Comment

0 Comments