বিশেষ নিবন্ধ

যদি তাড়িয়ে দেয়, হাসপাতালেই ফিরব

নাসরিন নাজমা


আগে থেকেই জেনে নিয়েছিলাম বিকেল চারটের আগে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাব না। শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টার শেষে সাড়ে পাঁচটায় হাতে পেলাম রিলিজ অর্ডার। আপাতত কদিনের জন্য ছুটি। সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ির প্রয়োজনের কথা নির্দিষ্ট জায়গায় জানিয়ে পা বাড়ালাম হোস্টেলের দিকে, জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিতে হবে। একটু পরেই হস্টেলের সামনে এসে গেল আমার জন্য নির্ধারিত গাড়ি। এই কদিন এখানে থাকার সময়ে যারা খুব আপনারজন হয়ে উঠেছিল, তাদের থেকে বিদায় নিয়ে এগিয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে মেইন গেট পেরিয়ে যাচ্ছি, গাড়ি এসে পড়েছে রাস্তায়। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে হস্টেলের বারান্দা, শেষ কয়েক দিনের ব্যস্ততা। আবছা হতে হতে মুছে যাচ্ছে দৃষ্টি থেকে।
শহরের এদিকটায় রাস্তাঘাট বেশ চওড়া, মসৃন। লকডাউনের কারণে রাস্তা ফাঁকা থাকায় গাড়ি চলছে বেশ জোরে। জানলায় চোখ রাখলাম। কী দ্রুত বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট, পিছনের দিকে ছুটে যাচ্ছে অবিরত। একে একে পেরিয়ে যাচ্ছি— সিটি সেন্টার, ইকো পার্ক, মাদার ওয়াক্স মিউজিয়াম। ইকো পার্কের বিস্তীর্ণ এলাকা নিঃস্ব বুক পেতে শুয়ে আছে মরে আসা আলোর নিচে, পাশের জলাশয় জুড়ে শুধুই ঢেউ ভাঙার আওয়াজ শব্দ, নৌকগুলো একমনে অভিমানে দুলছে। কেউ কোত্থাও নেই। জনসমাগমে মুখরিত, শপিং সিনেমা আইসক্রিম পার্লার, ফুচকা, প্রেমিক যুগলের পায়ে পায়ে হেঁটে যাওয়া, ঠোঁটে ঠোঁট বয়ে যাওয়া সময়ের সাক্ষী এই জনারণ্য আজ সম্পূর্ণ অচেনা লাগছে। সমস্ত রেস্তোরাঁ, ডিস্কোর দরজা বন্ধ। খাবারের সুগন্ধ, সুসজ্জিত মানুষের সারি, সাইকোডেলিক আলোর নেশা আর ডিস্কোর মাতাল করা উদ্দাম সুরের সাথে কোমরের মেলবন্ধন সবকিছু থমকে আছে, থমথমে ভয়ে। আবার কবে সব কিছু ঠিক আগের মতন হয়ে উঠবে জানি না।
চোখ সরিয়ে মন ভরে দেখতে থাকলাম রাস্তার দুপাশ জুড়ে গাছের মিছিল। হরিপ্রভা, জারুল, রক্তকরবী, বনপলাশ, কৃষ্ণচূড়ারা জীবনের উল্লাসে মুখরিত। এই মহামারী দিনে, ভয়ঙ্কর আঁধার সময়েও দুহাত উজাড় করে ছড়িয়ে দিচ্ছে বেঁচে থাকার রঙ। দিগন্তের কোল ঘেঁষে উড়ে যাচ্ছে পাখিদের ঝাঁক, অসুখ ওদের ছুঁতে পারেনি। নামিয়ে দিলাম জানলার কাঁচ। উত্তাল হাওয়া এলোমেলো করে দিচ্ছে চুল, ওড়না। কয়েকদিনের ব্যস্ত জীবনের শেষে, হাসপাতালের স্থবিরতার পরে এলোমেলো হাওয়া গালে, কপালে ছুঁয়ে দিচ্ছে কী অপূর্ব স্পর্শ! যদিও বুক ভরে নিতে  নিতে পারছি না বাতাসের গন্ধ, মুক্তির আস্বাদ। মাস্কের আবরণ বাধ সাধছে নাকে মুখে।
হুশ করেই পৌঁছে গেলাম এয়ারপোর্ট এর কাছে। অন্য দিনের ব্যস্ত জায়গাটা শুনশান। পুরনো স্মৃতির ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসছে আড্ডার রাত। কয়েকজন বন্ধু আছে যারা আমার থেকেও বেশি খেপচুরিয়াস। মাঝে মাঝেই যেদিন মাথার পোকা নড়ে উঠতো হঠাৎই মনে হতো আজ সারারাত আড্ডা দিলে কেমন হয়, সেদিন রাতের খাওয়া দাওয়ার পরে দল বেঁধে চলে আসতাম এয়ারপোর্ট চত্বরে। তারপর কাপের পর কাপ চা, গল্প আর ধোঁয়ায় উড়ে যেত একটা গোটা রাত। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠছে সেই উচ্ছল দিনগুলো।
রাস্তার ডিরেকশন বুঝিয়ে দিতে দিতে ডান, বাম, ইউটার্ন শেষে পৌঁছলাম নিজের পাড়ায়। মাত্র মাস চারেক হল এই নতুন ফ্ল্যাট, নতুন পাড়ায় এসেছি। সবার সাথে খুব একটা আলাপ নেই বলেই আমার পেশার সম্বন্ধে খুব কম লোকই জানেন। আমার অ্যাপার্টমেন্ট এর কয়েকজন অবশ্যি জানে।
আমি যে রাজারহাটে পোস্টেড এই খবরটা কাউকেই জানাইনি, কিন্তু কদিন বাড়িতে নেই দেখে নিশ্চয় কেউ না কেউ সন্দেহ করছেন। অনেকের অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি এবং ভয় পাচ্ছি!
কাউকে নিজের বাড়ির লোকরাই আসতে নিষেধ করছে, বলছে হাসপাতালেই থেকে যেতে, কোথাও প্রতিবেশীরা ঢুকতে দিচ্ছে না পাড়ায় আবার কোথাও বাড়ির মালিক, মেসমালিক বিনা নোটিশেই তাড়িয়ে দিচ্ছেন। সব্বার অপরাধ একটাই, তারা হাসপাতালে করোনার বিরুদ্ধে লড়ছে, রোগীর সেবা করছে নিঃস্বার্থ, নিজেদের জীবনের কথা না ভেবেই।
দুরুদুরু বুকে পৌঁছলাম বাড়ির সামনে। ড্রাইভারকে ধন্যবাদ জানিয়ে ব্যাগপত্র নিয়ে নেমে পড়লাম, যা থাকে কপালে। যদি তাড়িয়ে দেয় ফের হাসপাতালেই ফিরব। কয়েকদিনের শেষে আজ ফিরলাম ঘরে। ভয় পাওয়ার মতো তেমন কিছুই হল না যদিও, কেউ বাইরেও নেই। বাইরের কোলাপসিবল খুলে, নিজের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে পৌঁছলাম আমার নিজের, একান্ত নিজের ছোট্ট আশ্রয়ে!

Post a Comment

0 Comments