ব্লগ : ওদের কথা/ ৩

ব্লগ : ওদের কথা/ ৩

কানা লক্ষ্মীর কথা

মঞ্জীরা সাহা


কাচ ভাঙা ছবিতে মা লক্ষ্মীর চোখে মুখে সিঁদুরে লেপালেপি। মুখ চোখ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ঘরের ছোট মেয়ে লক্ষ্মী বিশ্বাসেরও চোখ দেখেনি কেউ কোনওদিন। চোখের পাতাদুটোর যে জায়গাটা আর সবার উঁচু মতোন থাকে ওর বেলা কিরকম কুঁচকে গিয়ে কোটরের ভিতরে ঢুকে গেছে। কেউ কোনওদিন ওকে ওই চোখ দুটো ঢাকতে ঘন কালো চশমা কিনে দেয়নি। মা লক্ষ্মীর ছবি রাখা বেড়ার ওই ঘর থেকেই লক্ষ্মী বিশ্বাস বান্ধবীদের ঘাড়ে পিঠে ব্যাগে হাত রেখে বাঁশ বাগানের ভেতর দিয়ে দিয়ে শর্ট রাস্তায় ইশকুলে চলে আসতো।

সরকারের নিয়ম অনুযায়ী কোনও ছেলে মেয়েকে ফেরানো যাবে না। লক্ষ্মী বিশ্বাসকেও ফেরানো হয়নি। ওর মা চোখের দু ফোঁটা জল ফেলতেই ভর্তি করা হয়েছিল। ইশকুল থেকে পাওয়া বই ব্যাগ ইশকুল ড্রেসে পুরোটাই ও বাকিদের মতো লাগতো চোখ দুটো বাদে। বইগুলো আর সবার মতোই মলাট ছাড়া। শুধু ওরগুলো একটু বেশি সাদা থেকে যেত বছর শেষে জমা দেওয়ার সময়ে। ওর বেলা বান্ধবীদের নাম রাখতে খুব বেশি একটা ভাবতেও হয়নি। একই নামে দুই তিন জন থাকায় ছোট রীণা মেজ বেবি বড় গীতা, নামের সঙ্গে এসব বিশেষণ জুড়ে গিয়ে ইশকুলে এসে তাদের নতুন নামকরণ হত। ওর বেলা বান্ধবীদের ছোট বড় মেজ সেজর ঝামেলায় আর যেতে হয়নি। নাম রেখেছিল সোজাসুজি। কানা লক্ষ্মী!

চোখ দুটো আর কোনওদিনও বড় না হলেও বাকি শরীর পালটে যাচ্ছিল সেভেনে উঠতে উঠতেই। মালতী পিংকি সবিতা পিয়ালীর বইয়ের ব্যাগের ভেতর লুকিয়ে আনা রঙ বেরঙের টিপের পাতা ময়লা ধরা চিরুনী পাথর বসানো ক্লিপের ভাগ পেত লক্ষ্মীও। ওদের শত্রু পক্ষের বান্ধবীরা ওদের সাজগোজের নালিশ করতে গিয়ে ওই কানা লক্ষ্মীর নামেও নালিশ করে আসত। পাশের ক্লাসরুম গুলোর বাপি রাজু গোপাল, কে কেমন কিভাবে কখন কার দিকে তাকিয়েছিল কখন চোখ মেরেছিল এসব নিয়ে যখন ফিশফিশ করে গল্প হত জানি না লক্ষ্মী ঠিক কি বলত! প্রতিবছর ওর সাদা পরীক্ষার খাতায় নামের ঘরে দিদিমণির হাতে লেখা লক্ষ্মী বিশ্বাসের খাতাটা জমা পড়ত আগের রোল আর পরের রোলের ঠিক মাঝখানে। মার্কশিট তৈরি হত লক্ষ্মী বিশ্বাসের নামে। সে মার্কশিট ভাঁজ করে ব্যাগে পুড়ে আবার বান্ধবীদের ঘাড়ে হাত দিয়ে সেই একই ভাবে ফিরে যেত বাড়ি, যেভাবে আসত। ওর স্কুলের জামা খানিক কম ময়লা হত। মিড ডে মিলের ঘরে ওভাবেই লক্ষ্মী পৌঁছে যেত ঘণ্টা পড়লেই। ক্যান ভারী হয়ে যেত খাবারে। ক্যানের মুখ বন্ধ করে কানের কাছে নিয়ে ক্যানের ভারটা দু’বার ঝাঁকিয়ে দেখে নিয়ে আবার হাঁটা লাগাতো বান্ধবীদের সঙ্গে। স্পোর্টেসের মাঠে তালির আওয়াজে হাততালি দিয়ে উঠত।

রঙ ছাড়া ন্যাড়া প্লাস্টারের ঘরগুলির ভেতর ওদের ক্লাস চলত। আম কাঁঠাল গাছে উঠে লাভারেরা লাভ লেটার ছুঁড়ে মারত ওদের ঘরে। বেঞ্চের উপর কম্পাস খুঁচিয়ে বান্ধবীরা আগের বছরের ছাত্রীদের লেখা নামগুলির উপর নাম লিখত নিজের লাভারের। সাদা খাতায় বানান ভুলে লিখত মঁ-ব্লাঁ পর্বত শৃঙ্গের নাম। ইয়োরোপ মহাদেশের সমৃদ্ধির কারণ লিখত দিদিমণির ডিক্টেশনের সঙ্গে সঙ্গে। লক্ষ্মী তখন হাত দুটো জড়ো করে মাথা নাড়িয়ে যেত হাসি মুখে। কোনওদিন জানা হয়নি সিমেন্টের দেওয়াল টেবিল চেয়ার দিদিমনির মুখের দিকে তাকিয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ের পর্বত শৃঙ্গের উচ্চতা জেনে বান্ধবীদের মাথা নাড়ানো আর লক্ষ্মীর মাথা নাড়ানোর পার্থক্যটা ঠিক কোথায়? লক্ষ্মীর মুখে ওই হাসিটা সব সময়ে লেগে থাকত। ওটা হাসি না অন্য কিছু সেটাও বোঝা যায়নি। ওর মুখে ওই এক এক্সপ্রেশন বাদে অন্য কোনও এক্সপ্রেশন কেউ কোনওদিন দেখেনি। দেখেনি ক্লাস এইট অবধি ডিঙিয়ে গিয়ে নাইনে উঠে ইশকুল ছেড়ে পুরোপুরি বাড়ি চলে যাওয়ার দিনও…।





Post a Comment

4 Comments

  1. ওদের জীবনের যাপনের এত অনুপুঙ্খ বর্ণনা পড়ে খুব ভালো লাগল। মানুষই তো আমার আগ্রহের বিষয়। তাদের জীবনকে এত সুন্দর ভাব ও ভাষায় প্রকাশ করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. শতানীক লেখাটা পড়ার জন্য প্রথমেই ধন্যবাদ।
      চেষ্টা করেছিলাম আরো একদিক তুলে ধরতে এডুকেশন সিস্টেমের অন্ধকার দিক।

      Delete
  2. Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ তাপস বাবু

      Delete