ধারাবাহিক উপন্যাস

মেয়েবেলা হারিয়ে গেছে অন্ধকারে। গোল্লাছুটের দুপুর এখন দিগন্তের পাখি। একলা আঁধারে মুখ নেমেছে পথের হাওয়ায়। বাহির থেকে ঘরে ফেরার অশ্রুতপূর্ব-কথার আখ্যান— নেইবাড়ির মেয়েরা। লিখছেন অঙ্কন রায়

এগারো
শর্মিলা আমার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট। মেয়েটা ভারি মিষ্টি। ওর চুলের গোছা ফুরফুরে। একটু হাওয়ায় সব ওলোট পালোট হয়ে যায়। মুখটা গোলগাল ডল পুতুলের মতো। আর ঠিক ওর মতোই একটা সত্যিকারের ডলপুতুল ও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল আলোকবর্তিকায়। তিন বছর আগে।
শর্মিলাকে পেয়ে আমরা সবাই দারুণ খুশি হয়েছিলাম। জীবনের নোংরা দিকগুলো খুব কম বয়সেই দেখে ফেলার কারণে আমাদের মনগুলো যেমন ভাবে তৈরি হয়ে গিয়েছিল, ওর মনটা ঠিক তেমন ছিল না। তার কারণ ছিল। সেটা হল ওর ওপর দিয়ে এই আমাদের মতো মানে আমি বা পুষ্পি কিংবা চানার মতো নির্যাতনের ঢল নেমে আসেনি। ওর সমস্যাটা ছিল অন্য জায়গায়।
আমার সঙ্গে যখন ও কোনও কোনও নির্জন দুপুরে বাগানের টিলাগুলোর ওপর উঠে বসে গল্প করত, গান গাইত, তখন ওর কাছ থেকে টুকিটাকি ওর বাড়ির খবর জানতে চাইতাম। হয়েছিল কি ওর জন্মের পর ওর মা মারা যান। বাবা আবার বিয়ে করেন। সৎ মা’র হাতেই বড় হয়েছে শর্মিলা। তিনি ওকে সেরকম উজাড় করা ভালবাসা না দিলেও মোটামুটি যত্ন আত্তি করতেন। পুরোপুরি অবহেলিত ছিল না ও। সমস্যাটা বিকট হয়ে দাঁড়ালো যখন আচমকা একদিন ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে ওর বাবা মারা যান। তখন ওর বয়স কত? বড়জোর আট কি ন’বছর। ওইটুকু মেয়ের একে মা ছিল না নিজের, এবার বাবাও চলে গিয়ে ওকে সত্যিকারের অনাথ করে দিলেন। সৎ মা এবার নতুন করে বিয়ে করলেন একজন বদমেজাজি আধবুড়ো লোককে। মা’র যে কেন ওকে ভাল লেগেছিল এক মা—ই জানেন। লোকটা শর্মিলাকে এতটুকু ভালবাসতো না। বরং কথায় কথায় হাত তুলতো গায়ে। এটা অবশ্য সেই আমাদের  উপর ঘটে যাওয়া নোংরামোর হাত নয়। একজন অত্যাচারী শাসকের হাত। কিন্তু সেই হাত থেকে বাঁচার জন্যই সৎ মা একদিন একটা উপায় খুঁজে বের করলেন। শর্মিলাকে ‘অনাথ’ প্রমাণ ক’রে চাইল্ডলাইনের সঙ্গে যোগাযোগ ক’রে তুলে দিলেন আমাদের আলোকবর্তিকায়।
যেদিন শর্মিলা প্রথম এল এই বাড়িতে, সঙ্গে ওর মা এসেছিলেন। আর ওর কোলে ছিল ওর মতোই দেখতে একটা মিষ্টি পুতুল। আমরা অন্যান্যরা একটু অবাকই হয়েছিলাম, কারণ সচরাচর মায়ের হাত ধরে সঙ্গে পুতুল নিয়ে ছোট মেয়েরা যায় স্কুলে, মেলায় বা পার্কে খেলাধুলো করতে। এই পূর্বজীবনের হতভাগিদের সঙ্গে আবাসিক হয়ে থেকে যেতে নয়। কিন্তু শর্মিলা থেকে গেল। ওর মা ওকে রেখে যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘এখানে তুই খুব ভাল থাকবি শমু। অনেক বন্ধু পাবি। গান, খেলা পড়াশোনা... সব পাবি। ওই বিচ্ছিরি মানুষটার মারের হাত থেকে তো বাঁচবি। নিজের মতো নিজের জীবনটা গ’ড়ে নে। আমাদের কথা আর ভাবিসনা।’
মা’র এই কথাগুলো শুনে শর্মিলার চোখের কোল টলটলে জলে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। ও একটু কাঁপা গলায় কান্না কান্না আওয়াজে বলেছিল, ‘তুমি ভাল থেকো মা। আমার জন্য চিন্তা কোরো না।’ তারপর আমাদের হাতে হাত রেখে দ্রুত ঢুকে গিয়েছিল বাড়ির ভিতর বারান্দার দিকে। মা’র দিকে আর ফিরে তাকায়নি।
সেই থেকে তিন বছর শর্মিলা আছে আমাদের কাছে। মাঝে মাঝে দুপুরের দিকে বাগানের টিলার ওপর আনমনে বসে থাকে আর নিজের মনে বিড় বিড় ক’রে কিছু বলে। একদিন আমায় কাছে পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আচ্ছা অহনাদিদি, আমার মা যখন ওই লোকটা বিচ্ছিরি লোক বলেই আমায় এখানে দিয়ে গেল, তাহলে নিজে কেন ওর কাছেই থাকলো?’
আমার ওকে উত্তর দেবার কোনও ভাষা মাথায় আসেনি। সত্যিই ভালবাসার তল খুঁজে পাওয়া যায় না কারো ক্ষেত্রেই। কখনও মনে হয় হাঁটু জলেই সব শেষ, কখনও বা অনন্ত অতলে ডুবে যেতে যেতেও পৌঁছোনো যায় না।

বারো
শর্মিলাকে ওর মা হস্টেলেও রেখে আসতে পারতেন। কিন্তু তাহলে ওর প্রতি তাঁদের দায় থেকেই যেত। সেই দায় থেকে মুক্তি পেতেই মেয়েটাকে ওরা অনাথ বানিয়ে রেখে দিয়ে গেলেন আলোকবর্তিকায়। একজন মায়ের, তিনি সৎই হোন আর যাই হোন, এমন মনোভাবটাও কম মর্মান্তিক নয় একটি ছোট মেয়ের কাছে। শর্মিলা সেটা প্রথম প্রথম বুঝতো না। এখন বুঝতে পারে আর বলে, ‘আমি এখানে অনেক ভাল আছি গো তোমাদের মতো বন্ধু, দিদিদের পেয়ে। ওরা আমার কোনওকালেরই কেউ ছিল না।’
কাঁথাস্টিচের কাজ, টেলারিং বা অন্যান্য হাতের কাজ শেখানোর কর্মশালা মাঝে মাঝেই আমাদের বাড়িতে হয়। অনেক মেয়েরাই সে সব শিখে নিজেরাই এটা সেটা তৈরি করতে পারে যেমন সুন্দর সুন্দর ব্যাগ, চাদর, কুশন কভার ইত্যাদি বানিয়ে ওরা অনেকেই স্টক ক’রে রাখে। বিভিন্ন মেলায় বা বড় বাজারে সেই সব জিনিষের ভাল কদর হয়। বিক্রিও হয়। মেয়েরা কিছু টাকা পয়সা রোজগার করতে পারে এই কাজ থেকে। কয়েকজন ভাল আচার বানায়, সেও বিক্রির ব্যবস্থা আছে। এভাবেই একটু একটু করে নিজেদের স্বাবলম্বী করে তোলার চেষ্টা করে চলে আমাদের আলোকবর্তিকার মেয়েরা। শুধু এক আমিই কোনও গুণের নই। এই যে এত কিছু শেখানো হয়, তা থেকে মেয়েদের কিছু উপার্জন হয়, সে তো আমিও করতে পারি একটু হলেও। কিন্তু না। আমার শুধু ভাল লাগে গল্পের বই পড়তে.... বাগানে ঘুরে ঘুরে গান গাইতে.... টিলার ওপর বসে বসে অনেক কিছু ভাবতে.... মাঝে মাঝে হিজিবিজি লিখে ডায়েরির পাতা ভরাতে। এসব থেকে তো কিছু উপার্জন হয় না। তাই হয়তো মাঝে মাঝে বন্ধুরা আমায় ডাকে ‘অকর্মা’।
আমি নিজেও জানি আমি ‘অকর্মা’, তবু এটাও জানি যে আমি পড়াশোনায় সেরা, আবৃত্তি আর গানও গাইতে পারি ভাল। আমার এই গুণের জন্য একদিন আমি রবি ঠাকুরের আশ্রমে গিয়ে গান গাওয়ার সুযোগ পেলাম। এমন সুযোগ কিন্তু দুর্লভ আমাদের মতো মেয়েদের জন্য। সে তোমরা যাই বলো। আর এই সুযোগ দেওয়ার পিছনে আমাদের ভানুদাদার যা অবদান, সেটা তুলনাহীন। সেবার হোলির দিন, মানে আশ্রমের বসন্তোৎসবের দিন কোপাইয়ের তীর ঘেঁষা আমাদের সবুজহাট, একটু দূরের কুসুমপুর, বনেরপুকুর ডাঙা—  এইসব গাঁ থেকে বাছাইকরা ছেলেমেয়েরা গান গাওয়ার, নাচের সুযোগ পেয়েছিল পল্লি শিক্ষা সংগঠনের মাধ্যমে। আর সেই বাছাই পর্বটা হয়েছিল আমাদের ভানুদাদার হাত ধরেই।
আমি আর আরও কয়েকজন ভিনগাঁয়ের মেয়ে দল বেঁধে সেবার আশ্রমের দোলমঞ্চে উঠে গেয়েছিলাম একটা শক্ত গান। ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে... তব অবগুন্ঠিত কুন্ঠিত জীবনে কোরো না বিড়ম্বিত তারে।’
হোলির কথা উঠতেই মনে পড়ে যায় মিনটির জীবনে অন্ধকারের দিন ঘনিয়ে এসেছিল এই হোলির দিনটাকে কেন্দ্র করেই।
মিনটির বাড়ি ছিল পাকুড়ে। আমাদের সবুজহাট থেকে ট্রেনে উত্তরবঙ্গের দিকে যেতে ঘন্টা দুয়েকের পথ। রাজ্যটা আলাদা। ঝাড়খন্ড। কিন্তু যেহেতু বাংলার কোলঘেঁষা রাজ্য, ওখানকার সমস্ত বাসিন্দাই বাংলা বলতে বা বুঝতে পারেন।
মিনটিদের ছিল একান্নবর্তী পরিবার। মানে ওর দাদুরা তিন ভাই, তাঁদের সাত আটজন ছেলে মেয়ে, তাদের আবার ছেলে মেয়ে সবাই এক সঙ্গে একটা বাড়িতে থাকতো। মিনটিরা অনেক দাদা, ভাই, বোনেরা মিলেমিশে থাকতো। ওদের বাড়িটা এক প্রকান্ড উঠোনের চারদিক ঘিরে। সবার নিজের নিজের পরিবার নিয়ে থাকার জন্য একটি করে ঘর ছিল বরাদ্দ। কিন্তু খাওয়া দাওয়া হত একসঙ্গে। উঠোনের একপাশে বিশাল রান্নাঘরের মধ্যেই ছিল হলঘর আর সেই হলঘরেরই মেঝেতে আসন বিছিয়ে সারি সারি পাত পড়তো খাওয়ার। দুপুরে ভাত ডাল সব্জি মাছ, রাতে রুটি বেগুনভাজা সেমাইয়ের পায়েশ বা অন্য কোনও মিষ্টি, এটা ছিল ওদের বেশিরভাগ দিনেরই মেনু। মাঝে মধ্যে মাংসও হত।
একবার হোলির দিন প্রতিবারের মতোই ওদের প্রকান্ড উঠোনে চলছিল রংখেলা। বাড়ির ছোটরা, বড়রা সবাই একসঙ্গে মেতে উঠেছিল রঙ মাখানোয়। প্রত্যেকে কালো আর বেগুনি রঙে এমন ভূত হয়ে গিয়েছিল যে আলাদা করে কারও মুখ বোঝা যাচ্ছিল না। মাঝে মাঝে ‘বুরা না মানো হোলি হ্যায়... ‘আর সারা রা রা...’ ধ্বনিতে ভারে উঠছিল সমস্ত চত্বরটা।
মিনটি আর ওর দাদা বোনদের বন্ধু বান্ধবরাও এসেছিল ওদের সঙ্গে রংখেলায় যোগ দিতে। এক সময় খেলতে খেলতে হল কি, মিনটি বুঝতে পারলো কেউ ওর চোখে রঙ ডলে দিতে দিতে একটা হাত ওর ফ্রকের উপর দিয়ে বুকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ক্লাস সেভেনে পড়া মেয়ে মিনটি এমনিতে ছোট হলেও শরীরের দিক দিয়ে এই বয়সী মেয়েরা যথেষ্ট বড় হয়ে যায়। সব কিছুই বোঝে। কে কি ভাবে তাদের দেখে, ছোঁয় সেটা না বোঝা থাকে না। মিনটিরও না বোঝার কারণ ছিল না। ও চোখে দেখতে পাচ্ছিল না কিন্তু দুটো হাত দিয়ে টেনে ওই অজানা হাতটাকে বের করে দিয়েছিল এক ঝটকায়। ফলে ওর ফ্রকটা ছিঁড়ে গিয়ে আদুর হয়ে গিয়েছিল গা টা। সেই অবস্থায় কোনওরকমে বুকের ওপর দুহাত চেপে মেয়েটা ছুটতে ছুটতে গিয়ে ঢুকে পড়েছিল নিজেদের দরজা দিয়ে, ঘরের ভিতরে।
বাথরুমে স্নান করতে করতে মিনটি সেদিন ভীষণ কাঁদছিল কিন্তু ভেবে পাচ্ছিল না কে ওর সঙ্গে এমন অসভ্যতা করল। তাও নিজের বাড়িতে। স্নানের জল ওর কান্নার জলের সঙ্গে মিশে রঙিন ধারায় বয়ে যাচ্ছিল একটানা।

তেরো
ভানুদাদা গুনগুন ক’রে একটা গান গাইতে গাইতে অনেকক্ষণ ধরে বাগানের টিলাগুলোর চারপাশে ঘোরাঘুরি করছিলেন। আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করছিলাম। সামনে যাইনি, কারণ মনে হচ্ছিল কোনও এক কারণে উনি ভীষণই চিন্তামগ্ন। এখন সামনে গেলে বিরক্ত হতে পারেন। কিন্তু আমার ধারণাটাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে উনি নিজেই দেখি আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছেন। মুখটা হাসি হাসি। আমি ছুটে গিয়ে বললাম, ‘কি গান গাইছিলে ভানুদাদা? আমি বুঝতেই পারিনি। অনেকক্ষণ বোঝার চেষ্টা করছি।’ ভানুদাদা হো হো করে হেসে বললেন, ‘ধুর বোকা মেয়ে। এটা কোনও গান নয়। একটা নাটকের ডায়লগ। তবে একটু একটু সুর আছে ঠিকই। ঠিকঠাক বলতে গেলে এটা একটা গীতিনাট্যের সংলাপ।’
আমি একটু অবাক হয়ে দাদার দিকে চেয়ে থেকে বললাম, ‘তুমি আজ গানের ক্লাসে এই নাটকের সংলাপগুলো শেখাবে বুঝি ভানুদাদা?’
ভানুদাদা বললেন, ‘না রে। আমার একটা বিপদ হয়েছে। গান গাই ঠিক আছে। কোনওদিন মঞ্চে নেমে অভিনয় করিনি। এবার সেটাই করতে হবে। গুরুদেবের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ অভিনীত হবে আশ্রম মাঠে, আর আমি তাতে দস্যুর পার্ট করছি। প্রথম দস্যু।
এবার আমি হেসে উঠলাম হো হো করে। বলছি, ‘ভানুদাদা, অভিনয় করো ঠিক আছে, তাই বলে দস্যু? তোমার মতো মানুষকে দস্যুর সাজে মানায় কখনও?’ দাদা বললেন, ‘সেই জন্যই তো টেনশন রে। আমায় দেখে বুঝছিস না? সামনের দোলের রাতেই আমাদের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’, আশ্রম মাঠে। এখন আমায় জোরতার প্র্যাক্টিস করে যেতে হবে। কি যে হবে, জানি না।’
আমি এবার একটু সিরিয়াস হয়ে বললাম, ‘না না ভানুদাদা, চিন্তা কোরও না। তুমি থাকলে গীতিনাট্য ভাল হতে বাধ্য।’ সেই হোলির দিনের ঘটনার পর থেকে মিনটির মনটাই কেমন ভেঙে গেল। ও ভাবতেই পারছিল না ওর বাড়ির কেউ ওর সঙ্গে এমন করতে পারে। ওর অনেক দাদা, ভাই সমস্ত বাড়ি জুড়ে। ওদের একান্নবর্তী পরিবারে কোনওদিন এমন ঘটনা ঘটতে পারে তা ওর ভাবনার বাইরে। কিন্তু ঘটেছে তো। আর এটা ও বাড়ির কাউকে বলতেও পারেনি। ওদিকে সব দাদাকেই ওর সন্দেহ হতে লাগল কারণ ও তো বোঝেনি সেদিন কে ওর সঙ্গে ঘটনাটা ঘটিয়েছে। কারও সঙ্গেই তাই মিনটি স্বাভাবিক হতে পারছিল না।
অবশেষে একদিন ওর সন্দেহের অবসান হল। আর সেটা হল বড় বেশি নির্মমতার হাত ধ’রে।
সেদিন সকাল সকাল স্কুলে যাওয়ার পথে মিনটির জেঠুর ছেলে রাজেশদাদার বন্ধু সুকোমলদাদা দাঁড়িয়েছিল ওদের বাড়ির অদূরেই গেটের বাইরে। ওকে দেখে একটু মুচকি হেসে বলল, ‘কি রে মিনটিয়া, কেমন আছিস? সেদিন তোর সঙ্গের ব্যাপারটা আমি নিজের চোখে দেখলাম। ছি ছি। নিজের বাড়ির দাদা কখনও বোনের সঙ্গে এরকম করে? খুব খারাপ। খুব খারাপ কাজ।’
সুকোমলদাদার এই কথাগুলো যে আসলে ওর বিশ্বাস আদায় করার টোপ ছিল সেটা মিনটি তার ওই ছোট্ট বয়স দিয়ে বুঝতে পারেনি। দাদাটা ওকে সব কথা বলবে বলে নিয়ে গিয়েছিল নিজের বাড়িতে। সেখানে আর কেউ ছিল না সেদিন। ওকে বসিয়ে ওর জন্য শরবত নিয়ে এল সুকোমলদাদা। ওর হাতে গ্লাসটা ধরিয়ে বলল, ‘এই নে মিনটি। এটা খা। তোকে আমি বলছি কে ঘটিয়েছে ওই বাজে ঘটনাটা।’
মিনটি শরবতে চুমুক দিতে দিতে দেখে ওর মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুকোমলদাদা। কিছু বলছে না তো! কি দেখছে ওর মুখে? মাথাটা কেমন ঘুরে গেল হঠাৎ। তারপর চোখ দুটো আবছা হয়ে এল। ইচ্ছে হচ্ছে ওখানেই শুয়ে পড়তে। বুদ্ধি কাজ করছে না।

আশ্রম মাঠে ভানুদাদাদের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ অভিনয়ের দিন আমরা আলোকবর্তিকা’র সব মেয়েরা গিয়েছিলাম দেখতে। দিনটা কেটেছিল খুব ভাল। আমাদের বাড়ির ভেতরেই তুমুল রঙখেলা চলেছিল সেদিন সকাল থেকে। সেই রঙ স্নানের সময় তুলতে তুলতে দুপুর পেরিয়ে প্রায় বিকেল বিকেল। তারপর একটুখানি বিশ্রাম নিয়েই আশ্রমমাঠে যাওয়ার প্রস্তুতি। আমাদের জন্য স্পেশাল অনুমতি নিয়ে রেখেছিলেন ভানুদাদা, যাতে আমরা হোমসুদ্ধ সবাই যেতে পারি সন্ধের অনুষ্ঠান দেখতে। দেখলাম মন ভরে। প্রাণ ভরে। আমরা সবাই অবাক ভানুদাদার অভিনয় দেখে। প্রথমে তো চিনতেই পারিনি ওঁকে। ইয়াব্বড়ো একটা পাকানো গোঁফ সারাটা মুখের মধ্যে প্রধান। পেটে বড়োসড়ো এক ভুঁড়ি। মজার মজার গান গেয়ে এত ভাল অভিনয় করছেন যে মনেই হচ্ছে না এটা ভানুদাদার প্রথম মঞ্চে নেমে অভিনয় করা।
আলোকবর্তিকায় ফিরতে ফিরতে আমার আবার মনে হচ্ছিল ভানুদাদ যদি ওই বাল্মীকি সাজা কাকুটার জায়গায় নিজে বাল্মীকি হয়ে অভিনয় করতেন, আরও ভাল মানাতো ব্যাপারটা। ভানুদাদা মানুষটার সঙ্গে বাল্মীকিরই মিল বেশি। অনেক বেশি। রাতে আবার মিনটির কথা লিখতে বসে মনটা ভারি হয়ে এল। আমাদের মতো মেয়েদের জীবনের এই অন্ধকারতম দিকগুলো নিয়ে লেখা সহজ নয় এতটুকু। আর যার কথাই লিখি না কেন, শেষ পর্যন্ত আমাদের গল্পগুলো তো একই। মর্যাদা, সম্মান সব, সব কিছু খুইয়ে আসার গল্প। মিনটির সেদিন জ্ঞান হারানো আর তার পরের ঘটনাগুলো বড়ই মর্মান্তিক। জেঠুর ছেলে রাজেশ দাদার বন্ধু সুকোমলদাদা যে আসল শয়তান সেটা ও বুঝলো আরও কয়েকদিন পরে যখন নিজের চোখে দেখলো ওর জামাকাপড় ছাড়া নগ্ন ছবি। এই ছবিগুলো সেদিন সুকোমলদাদাই ওর ওই অবস্থা করে মোবাইলে তুলেছিল। এরপর দিনের পর দিন ওই ছবিগুলো সবাইকে দেখিয়ে দেবে, এই ভয় দেখিয়ে মিনটিকে ওর স্কুল যাওয়ার সময় নিজের বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে যা খুশি তাই করতো ওর সঙ্গে। মিনটি এত বড় বোকা ছিল যে লোকলজ্জার ভয়ে সুকোমল নামক শয়তানটার সব কথা শুনে চলত। আসলে ওকে দোষ দেওয়াও যায় না। মেয়েটার বয়সই বা কত তখন। আর লজ্জাকর ছবিগুলো যদি সবাই দেখে ফেলে!
দিনের পর দিন এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটতে ঘটতে যা হবার একদিন সেটা হলই। ছোট মেয়েটার পেটে বাচ্চা এসে গিয়েছিল। সেটা টের পাওয়ার পর তুলকালাম কান্ড ওর বাড়িতে। বাবা মা রাতারাতি ওকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে গেলেন অন্য শহরে। গাড়ি ভাড়া করে। তারপর বড় শহরের ডাক্তার বদ্যি সব করতে লেগে গেল আরও কটা দিন। তলে তলে বাবা যে ওকে অন্য কোথাও রেখে আসার প্ল্যান করে নিয়েছেন সেটা প্রথমে ভাবতে পারেনি মিনটি। যেদিন জানলো সেদিন আলোকবর্তিকায় আমাদের একজন হয়ে বাকি জীবনটা কাটাতে এল ছোট একটা মেয়ে। মিনটি।


(ক্রমশ...)
অঙ্কন : অর্চিতা মুন্সী

Post a Comment

0 Comments