রবিবার

পদাতিক মৃণাল সেন 

চণ্ডী মুখোপাধ্যায়


এই শহর কলকাতাতেই থাকতেন মৃণাল সেন। এখন আর মৃণাল সেন নেই এই শহরে, নেই এই গ্রহে। কলকাতা তাঁর কাছে ছিল এল ডোরাডো। সব পেয়েছির দেশ। প্রেমের শহর। কলকাতার অসুখে তিনি যন্ত্রণা পেতেন, কলকাতার সুখে তিনি আহ্লাদিত হতেন। এই শহর কলকাতার মানুষটি সারা পৃথিবী ঘুরেছেন। মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক। সারা পৃথিবীতে ছড়ানো ছিল তাঁর বন্ধু।
যেমন উপন্যাসে যিনি এনেছেন জাদু-বাস্তব সেই মার্কেসের সঙ্গে তাঁর ছিল অভিন্নহৃদয় বন্ধুত্ব। বাঙালি তাঁকে চেনার আগেই মার্কেসের গল্প শুনেছি মৃণালদার মুখে। মার্কেস চেয়েছিলেন তাঁর গল্প নিয়ে ছবি করুন মৃণাল। সে ছবি অবশ্য হয়নি শেষ অবধি। এসব গল্প মৃণালদার মুখেই শোনা। তিনি ছিলেন কথাপুরুষ। দারুণ আড্ডাবাজ। আর যে আড্ডার প্রতিটি মুহূর্তই সৃষ্টিময়। যে কোনও বয়সের মানুষের সঙ্গে মিশে যেতেন। আর সেটা হয়ে উঠত সাহিত্য সিনেমা নিয়ে অবাধ গতিময় আড্ডা। যাঁরা মৃণালদার সঙ্গে আড্ডা মেরেছেন তাঁরা জানেন এই আড্ডা হয়ে উঠত কি অনন্য। সাম্প্রতিক দুনিয়ার অলিগলির সন্ধান রাখতেন তিনি। তিনি ছিলেন সবসময় এক তাজা তরুণ। বয়স তাঁকে কখনই ছুঁতে পারেনি।
কিন্তু শেষ এক যুগ নিজেকে তিনি এক অদ্ভুত অভিমানে গুটিয়ে নেন নিজের চার দেওয়ালের মধ্যে। ক্রমশই পরে চার দেওয়ালের মধ্যে এক বিছানায়। বয়সজনিত কারণেই। এই সময় তিনি যেন সামান্যতম শারীরিক কষ্ট না পান সেই জন্যেই তাঁকে ঘিরে ছিল বেশ কিছু মনের দিক থেকে তরুণ বিপ্লবী যুবক। কর্মসূত্রে এঁরা সকলেই চিকিৎসক। এঁদের মধ্যে একজন ডাক্তার অধৃষ্যকুমার। একদা সতত কথাময় মৃণালদা এক বিছানায় স্মৃতিহীন। কিন্তু সজাগ ছিল তাঁর সম্মান এবং অভিমান-বোধ। মৃত্যুর আগে তাই পুত্র কুণালকে জানিয়ে যান যে মৃত্যুর পর কোনও সরকার বা প্রতিষ্ঠান যেন তাঁর শেষ যাত্রার তদারকি না করে। ফুল বা মালা দেয়ার জন্যে যেন তাঁর দেহ শায়িত না করা হয় কোনও তথাকথিত সাংস্কৃতিক পরিসরে। হয়নি।
কুণাল ফেসবুকে ছোট এক পোস্ট দেন: ‘‘আমার বাবা বার বার বারণ করে গেছেন যে তাঁর মৃত্যুর পর শেষ যাত্রায় যেন আতিশয্য না হয়। তাই আমাদের সেই ইচ্ছাপূরণ করা উচিত। তাই আমরা বিকেল ৩টের সময় দেশপ্রিয় পার্কের সামনে একসঙ্গে মিলে বাবার শেষকৃত্যের পথে যাব’’। কলকাতার বিদগ্ধ মানুষেরা এই মিছিলে সামিল হন, কোনও সরকারি ঘেরাটোপে নয় পদাতিক-এর সঙ্গে তাঁরা সামিল হন স্বাধীন-চেতনায়। তাঁর স্মৃতি-সভাতেও ছিল না কোনও ফুলের চিহ্ন, ছিল না কোনও প্রাতিষ্ঠানিক হাত।
১৪ মে ১৯২৩। ফরিদপুরে মৃণাল সেনের জন্ম। বাবা দীনেশ সেন, পেশায় আইনবিদ, ঘনিষ্ট ছিলেন চরমপন্থী কংগ্রেসিদের সঙ্গে। সেই সূত্রে নেতাজি সুভাষচন্দ্র আসতেন তাঁদের বাড়িতে। স্কুল জীবন, প্রাথমিক কলেজ জীবন ওখানেই। ১৭ বছর বয়সে কলকাতায় এলেন। সেই চল্লিশের দশক। দাঙ্গা, দেশভাগ, দুর্ভিক্ষ, মধ্যরাত্রির স্বাধীনতা। পাশাপাশি ভারতীয় গণনাট্য সংঘ- ঋত্বিক, হেমাঙ্গ, সলিল চৌধুরী, শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য প্রমুখ এইরকম অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যেই মৃণালের যৌবন। যার রেফারেন্স প্রভাব এসেছে ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘আকালের সন্ধানে’, ‘কলকাতা ৭১’ ছবিতে। ৪৩’র দুর্ভিক্ষ নয়, তাঁর এইসব ছবিতে ফিরে ফিরে আসে ষাটের প্রায় দুর্ভিক্ষসম খাদ্য সংকট। পকেটে কোনও পার্টি-কার্ড না নিয়েই জড়িয়ে পড়লেন বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে। সরাসরি কোনও দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না হয়েই তিনি আজীবন বামভাবনায় বিশ্বাসী। নিজেকে বলতেন তিনি প্রাইভেট মার্কসিস্ট। তাঁর কাছে সিনেমা হল সেই চিন্তারই প্র্যাকটিস।
মৃণালের প্রথম ও শেষ প্রেমিকা গীতা। গীতা সোম। তাঁর জীবন-সঙ্গিনী। গীতার সঙ্গে প্রেম-প্রসঙ্গে মৃণাল নিজেই বলেন, “গীতার সঙ্গে উত্তরপাড়াতে দেখা করতে যাওয়ার পথে হুইলার থেকে একটা বই কিনলাম। এ ফেস অফ কমিউনিজম। বালির ব্রিজের ওপর দিয়ে দুজনে হাঁটছি। সেদিন হঠাৎ গীতার হাত ধরে তাকে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করলাম। প্রচণ্ড নার্ভাস ছিলাম ঠোঁটটা পড়ল ওর নাকের ওপর, আর হাত কেঁপে ‘এ ফেস অফ কমিউনিজম’ ঝপাৎ করে গঙ্গার জলে গিয়ে পড়ল। আমার প্রথম চুম্বনের সঙ্গে কমিউনিজমের যুক্তির বেড়াজাল গঙ্গায় ভেসে গেল।”
এইভাবেই কথাপুরুষ কথা বলতেন। যুক্তি- হিউমার এবং আত্মসমালোচনায়। এই গীতাকেই বিয়ে করেন মৃণাল। আর গীতার সঙ্গে আলাপ তো সিনেমাসূত্রেই। রাতভর-এর আগেই গণনাট্যের ক’জন মিলে বাংলা ছবি পরিচালনা করতে যান। সেটা ১৯৫০ সাল। ছবির নাম ‘দুধারা’। পরিচালক হিসেবে এই গোষ্ঠীর নাম ছিল ‘অনামী’। কাহিনী লেখেন মৃণাল সেন। আলোকচিত্রী হলেন- বিদ্যাপতি ঘোষ। সেই প্রথম মেডিকেল রিপ্রেজেন্টটেটিভের সিনেমা-বিহার। এই ছবিতেই অভিনয় করেন গীতা সোম। তখনই আলাপ গীতার সঙ্গে। মৃণালের মৃত্যুর বছর খানেক আগে মারা যান গীতা। এবার সত্যিই একা হয়ে যান তিনি।
সত্যজিৎ প্রথম ছবিতেই আন্তর্জাতিক। মৃণালকে অপেক্ষা করতে হয়েছে টানা তের বছর। ‘ভুবন সোম’ পর্যন্ত। এর অগ্রজ হিসেবে মৃণালের রয়েছে ৮টি ছবি। কিন্তু ‘ভুবন সোম’ থেকেই মৃণাল পেলেন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা। এই ছবি থেকেই জন্ম নিল নিউ ইন্ডিয়ান সিনেমা বিকল্পে যাকে বলা হয় ভারতীয় নব তরঙ্গ। যেমন হয়েছিল ফরাসি সিনেমায়-পঞ্চাশের দশকে। জঁ লুক গোদারের নেতৃত্বে তক্রুফো, শ্যাব্রল, রোমার, রিভেত-এরা ফরাসি সিনেমায় নবতরঙ্গ আনলেন। গোদার যদি ফরাসি সিনেমার আইকনোক্লাস্ট হন তাহলে মৃণাল সেন একাই হলেন ভারতীয় সিনেমার প্রথা ভাঙ্গার কালাপাহার।
জীবনের প্রথম ছবি ‘রাতভোর’ ছবিটিকে নিজের ছবি হিসেবে স্বীকার করতে রাজি ছিলেন না মৃণাল। উত্তমকুমারকে নায়ক করে এই ছবিটি নেহাতই দায়ে পড়ে করা। অবশ্য তার পরের ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’কেই মৃণাল মনে করেন তাঁর আত্মপ্রকাশের ছবি। তার আগে ‘নীল আকাশের নীচে’। যা তাঁকে বাংলা সিনেমায় প্রবেশের ছাড়পত্র দিল। ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবির পর থেকে মৃণাল সেনের পর পর সাতটি ছবির সাধারণ সূত্র হল মধ্যবিত্ত নারী পুরুষের সম্পর্কের সংকট। যেমন ‘বাইশে শ্রাবণ’-এ পঞ্চাশের মন্বন্তরের প্রেক্ষিতে দাম্পত্য সংকট। তেমনি ‘পুনশ্চ’, ‘অবশেষে’, বা ‘প্রতিনিধি’-র সংকট হল মধ্যবিত্ত স্ত্রী পুরুষ সমানাধিকার প্রশ্নে মধ্যবিত্তের রক্ষণশীলতা, ‘আকাশ কুসুম’ ছবিতে যা মধ্যবিত্তের স্বপ্নবিলাস, ‘মাটির মুনিষ’ যা হয় সামন্ত মূল্যবোধ বনাম ব্যক্তি স্বাতন্ত্র‍্য মূল্যবোধ। এমনকী সেই ভুবন সোম ছবিরও অন্তসার মধ্যবিত্তের অস্তিত্বর স্বপ্নবিলাস। মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র জীবনের ষাটের দশককে অনায়াসে ‘মধ্যবিত্ত সপ্তক’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ‘আকাশ কুসুম’ ছবি মুক্তি পাওয়ার সময়ই মৃণালকে চিহ্নিত করেন সত্যজিৎ। ছবি মুক্তি পাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ছবিটিকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন স্বয়ং সত্যজিৎ। এই প্রথম, নিজের ছবি নয়, অন্য এক বাঙালি পরিচালকের ছবির বিরুদ্ধে, কোনও প্ররোচনা ছাড়াই, কলম ধরলেন তিনি। এর অন্তরালের রহস্য জানতে ইচ্ছে করে সকলেরই। সত্যজিৎ যখন হলিউড ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমা শাসন করছেন তখন মৃণাল হঠাৎ ইউরোপীয় সিনেমা ধারাকে নিয়ে আসছেন বাংলা সিনেমায়-এটা কি পছন্দ ছিল না সত্যজিতের? আর এটা তো অস্বীকার করা যায় না ‘আকাশ কুসুম’ থেকে মৃণালের চিত্রভাষা গতানুগতি থেকে বেরিয়ে এক স্বতন্ত্র‍ পথ খুঁজে নিচ্ছে। যার চূড়ান্ত পরিণতি ‘ভুবন সোম’ পেরিয়ে কলকাতা-ত্রয়ী-তে। আর ভুবন সোম-এর পরেই তো ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমা হাতবদল হয়ে চলে এল মৃণালের কাছে।
দশকে দশকে পাল্টান মৃণাল। পঞ্চাশের মৃণাল পাল্টে যান ষাটে। সত্তরে অন্য মৃণাল। আবার আশির মৃণালের সঙ্গে আগের মৃণালের কোনও মিল নেই। সবকিছুতেই- আঙ্গিক প্রকরণে। ‘ইন্টারভিউ’ থেকে এই পর্যায়ের শুরু, শেষ ‘কোরাস’-এ। সমসাময়িক রাজনীতি নিয়েই ছবি করছেন তিনি। মধ্যবিত্তের বিপ্লব স্বপ্নপুরাণ। এইসব ছবির সব কটারই পটভূমি কলকাতা। যেমন ‘খণ্ডহর’ বা ‘আকালের সন্ধানে’ ছবির পটভূমি গ্রাম হলেও ভাবনাগত ভাবে দুটো ছবিই নাগরিক।
মৃণাল ২৭টি ছবি করেছেন যার মধ্যে ১৪টি সরাসরি কলকাতা-কেন্দ্রিক। সরাসরি গ্রামভিত্তিক ছবির সংখ্যা দুই- ‘মৃগয়া’ এবং ‘ওকা অরি কথা’। ‘জেনিসিস’ এক স্বতন্ত্রতম ছবি। যেখানে মৃণাল ফিজিক্যাল রিয়েলিটি থেকে এক ধ্রুপদী রিয়েলিটিতে চলে যান। মহাপৃথিবী-তে মৃণাল আন্তর্জাতিক। এরপর মৃণাল আরও দুটো ছবি করেন- ‘অন্তরীন’ ও ‘আমার ভুবন’। মৃণাল অন্তত ১৪টি টিভি ফিল্ম করেছেন- সিরিয়াল আকারে। ছোটদের জন্যেও ছবি করেছেন-রবীন্দ্রনাথের ‘ইচ্ছাপূরণ’।
মৃণাল সারা জীবন লড়াই চালিয়েছেন নিজের সঙ্গে। তিনি স্বীকার করেন তিনি অবস্থান করেন বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণী-তে। তিনি এই শ্রেণীতে দাঁড়িয়েই ছবি করেন। কোনও আত্মপ্রবঞ্চনা নেই। বরং রয়েছে আত্মসমলোচনা। তবে তফাৎ একটাই তিনি এই কলকাতাতেই নানা প্ররোচনাকে অগ্রাহ্য করে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বেঁচেছিলেন। 

Post a Comment

0 Comments