নগরকীর্তন

গানের পাখি/ ৪

বাজনার জাদুকর

আবীর মুখোপাধ্যায়


স্বর্ণযুগের বাংলা গানের সুর ও কথার মতোই মিঠে সেই সব গান তৈরির গল্পও। সুরকার, গীতিকারদের সঙ্গে শিল্পীদের সম্পর্ক— জন্ম দিয়েছে যামিনি পটে জড়ানো বিচিত্র উপাখ্যানের। এই ধারাবাহিকে আমরা ফিরে ফিরে শুনব হারানো দিনের মনকেমনের গান। চেয়ে চেয়ে অপলক দেখব সুরের আকাশে শুকতারা। আর একলা হয়ে নিবেদন করব একে অপরকে গানের রেকাব।


কারও কাছে আইকন, কারও কাছে তিনি স্বপ্নের নায়ক!
আবার কারও কাছে তিনি মিথ, কাল্ট ফিগার।
তাঁকে নিয়ে গ্রন্থের ব্লার্বে লেখা হয়, ‘‘প্যারিসে উদয়শঙ্করের নৃত্যসঙ্গী, মাইহারে আলাউদ্দিনের শিষ্য, আসরে সুরমুর্চ্ছনার জাদুকর, আলি আকবরের সঙ্গে যুগলবন্দির মিথ, বিটলস জর্জ হ্যারিসনের গুরু, বিদেশে হিন্দুস্থানি সংগীতের প্রচারের অগ্রদূত, সত্যজিতের অপু-কাবুলিওয়ালা-গান্ধির মতো ছবির পথিকৃৎ সংগীতরচয়িতা, আইপিটিএ, ব্যালে-কনচের্তো, অস্কার-গ্রামি-ভারতরত্ন-লিজিয়ঁ দ্য অনর, সৃজনে এবং প্রেমে অক্লান্ত এপিকধর্মী জীবন...!’’ তিনি রবিশঙ্কর।
৭ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে, আমার পূর্বত‌ন অফিসে সেদিন মনিং। ততক্ষণে বিবিএমে কিংবদন্তী শিল্পীর মৃত্যুসংবাদ ঢুকে পড়েছে। ফিরে পড়ছি— সংগীত বিষয়ে অনুসন্ধানী লেখক অতনু চক্রবর্তীর নেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ভিত্তিক রবিশঙ্করের ওপর একটি গ্রন্থ ‘মুখোমুখি রবিশঙ্কর’। প্রকাশক প্রতিভাস। অপূর্ব এক পাঠ-অভিজ্ঞতা!
এই নির্বাসনে বসেও, ফিরে পড়তে পড়তে ইচ্ছে করছে, অতনুবাবুর অনুপম লেখনী।
কেমন ছিল শিল্পীর ছেলেবেলা?
অতনুবাবুর প্রশ্নের উত্তরে রবিশঙ্কর লিখছেন, ‘‘...খুব ছেলেবেলার রাতে চিত হয়ে ছাদে শুয়ে, আকাশের তারা দেখতাম আর মায়ের গাওয়া গান শুনতাম। কী গান তখন জানতাম না, পরে বুঝেছি গহরজান-জোহরাবাইয়ের ঠুংরি গাইতেন মা। শিখে গাইতেন না, শুনে শুনে।...মায়ের গলা ভারী মিষ্টি ছিল- লোকসংগীত, কাজরী, দাদরা এসব গানের টুকরো টাকরাও গাইতেন... আমাদের কাশীর বাড়িতে অনেক বাদ্যযন্ত্র ছিল- শৈশবে খেলতে খেলতে খেলার সেসব নিয়ে টুংটাং করেছি।’’
বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাদার সাহচর্যে জ্যাজ, ফ্রেঞ্চ-জার্মানি-রাশিয়ান-স্প্যানিশ- মিউজিক শুনেছেন এবং একইসঙ্গে তিমিরবরণ, বিষ্ণুদাস শিরালির বাজানো ভারতীয় রাগসংগীতে কান তৈরি করেছেন। এরপর পরই সেতারে হাতেখড়ি। কার কাছে? ওস্তাদ বাবা আলাউদ্দিন খানের কাছে। রবিশঙ্কর নিজের সম্পর্কে মজা করে জানিয়েছেন, ‘‘এর আগে আমি দেখে বা শুনে শেখা সেতার সরোদ দিলরুবা এসরাজ বাঁশি তালবাদ্য সবই একটু আধটু বাজাতাম। হাতুড়ে মিউজিশিয়ানের মতো আর কী!’’
কেমন ছিল প্রবাদপ্রতীম শিল্পীর প্রথম সেতার শেখার শেখার দিনগুলি?
স্মৃতির সরণীতে হেঁটে শিল্পীর জবানীতে অতনুবাবু লিখছেন, ‘‘খুব সাধারণ একটি সেতার আর সুরবাহারে আমার তালিম শুরু হয়। সুরবাহারে তো আলাপ জোড় ঝালাই বাজে- আমি গৎ-তোড়া-ঠুংরি-ধুন সবই বাজাতে চাইতাম, ফলে সেতারটাই প্রধান হয়ে উঠেছিল। তবে সুরবাহার তালিমের  হাত ধরে সেনি ঘরানার বীণ, রবাব, সুরশৃঙ্গার বাদনশৈলী অনেকটা রপ্ত হয়েছে। ... কানাইলালের তৈরি খরজ আর খরজ পঞ্চমের সেতার বাজিয়েছি একসময়।’’
নাগাড়ে রেওয়াজের কথা পাই থীমা থেকে প্রকাশিত রেবা রায়চৌধুরীর ‘জীবনের টানে শিল্পের টানে’ স্মৃতি-লেখাতেও। রেবা লিখছেন— ‘‘১৯৪৫-এর শেষে কি ’৪৬-এর গোড়ায় হঠাৎই রবিশঙ্কর আমাদের স্কোয়াডে যোগ দিলেন, উদয়শঙ্করের আলমোড়া কেন্দ্র ভেঙে যাবার পর সস্ত্রীক আন্ধেরীর সহজ সরল জীবনের মাঝখানে চলে এলেন। রবিশঙ্কর আলাউদ্দিন খাঁ-র কন্যা অন্নপূর্ণাকে বিবাহ করেছেন। এমন অমায়িক গুণী মহিলার সংস্পর্শে আমি কোনও দিন আসিনি। রবিশঙ্কর আর অন্নপূর্ণা বউদির সাত-আট ঘণ্টা একনাগাড়ে একাত্ম হয়ে রেওয়াজ শুনবার পর নিজেদের তিরস্কার করতাম। মাঝে মাঝে রবিশঙ্কর আর অন্নপূর্ণা বউদি চাঁদের আলোয় বসে সেতার বাজাতে বাজাতে সারা রাত কাবার করে দিতেন। মাঝখানে শুয়ে ঘুমোত শিশুপুত্র শুভ, তাঁদের একমাত্র সন্তান।... রবিশঙ্কর যখন প্রথম এসেছিলেন, তখন সে কী অবস্থা। তাঁর থাকার জায়গা নেই, খাওয়ার জায়গা নেই। তখন এই রকমই একটা ঘরে রবুদা থাকতেন, স্ত্রী আর একটা বাচ্চা ছেলে নিয়ে। নিজের কাপড় নিজে কাচছেন, বাসন মাজছেন। অনেক সময় আমরাও বাসনকোসন মেজে দিতাম। এই রকম একটা সিম্প্ল লাইফ।’’
কলকাতা তাঁর ‘প্রিয় এবং বিশেষ’। কলকাতার বহু শিল্পীর সঙ্গে তাঁর ভাল সম্পর্কও ছিল। তেমন একজন ওস্তাদ মানস চক্রবর্তী। মনে পড়ছে— তাঁর মৃত্যু সংবাদও পেয়েছিলাম প্রায় একই সঙ্গে, একইদিনে!
কলকাতায় রবিশঙ্কর প্রথম বাজান একটি ঘরোয়া আসরে, বউবাজারে। শিল্পীর সঙ্গে তবলা বাজিয়েছিলেন কেরামতুল্লা খাঁ। শিল্পীর স্মৃতি ‘‘পুরিয়া ধানেশ্রী বাজিয়েছিলাম এখনও মনে আছে- তখন সাধারণত তিনতালে গৎ বাজত, আমি বাজিয়েছিলাম ঝাঁপতালে।’’ শুরু থেকেই সংগীতের সাধনার নানা পর্বে ছিল এই এমন নিরীক্ষা। অতনু তাই লিখছেন, ‘‘সংগীতের ‘উপজ’ অঙ্গের কাজকেই শুধু নয়, সংগীতের নানা ক্ষেত্রে তাঁর নিরন্তর যাত্রাপথ নির্মাণের কাজটিকেই ‘ইমপ্রভাইজেশন’ হিসেবে চিহ্ণিত করেছেন রবিশঙ্কর।’’ গ্রন্থের চারটি পর্যায়ের প্রথম পর্বে ‘প্রাককথন’-এ থেমে যেতে হয়। অতনুবাবু এরপরই বিশদে লিখছেন,... জীবন ও সংগীত নিয়ে ক্রমাগত নিরীক্ষা করে গেছেন, যার ফলে গোটা চালচিত্রটি হয়ে উঠেছে এপিকধর্মী’। বাস্তবিক শিল্পীর এ নিরীক্ষা তাঁর দীর্ঘ জীবনজুড়েই। আমৃত্যু বিরুদ্ধ সমালোচনাকে এড়িয়ে মগ্ন থেকেছেন শিল্পের সাধনায়। কেমন সেই নিরীক্ষা, তাতে নতুনত্ব-ই বা কোথায়?
নিজের বাজনা সম্পর্কে বরাবরই মিতভাষী ছিলেন রবিশঙ্কর। তিনি মনে করতেন, ‘‘শুধু নুম তুম করে গেলে কজন শুনবে? আজকের জলসায় ধ্রপদি মেজাজের শ্রোতা কজন? তাই আলাপ হল, বিলম্বিৎ গৎ হল, দ্রুত হল, তারপর ঠুংরি চালের একটা কিছু, সেই সঙ্গে ‘প্লেয়িং ফর দ্য গ্যালারি’ খানিকটা থাকবেই। সওয়াল জবাব, তবলার সঙ্গে মারপ্যাঁচ, মাইকটা বাড়িয়ে দেওয়া, সব মিলিয়ে একটা উত্তেজনা।’’
অতনু লিখছেন, ‘‘...রবিশঙ্করের বাদ্যযন্ত্র সংস্কার, বিশিষ্ট ধ্বনিময়তার উদ্ধার, ধ্রুপদ থেকে ধুন, বা বীণ থেকে রবাবী অঙ্গের সুরবিহার, আলাপ এবং জোড় অঙ্গে দক্ষিণী বৈশিষ্ট আত্মস্থ করবার নৈপুণ্য, লয়কারী বা ছন্দময়তার জাদু, সরোদের নির্যাস সেতারে তুলে আনার কৃতি- সব ব্যাপারেই ‘অভূতপূর্ব’ কিছু সংযোজন ঘটেছে’। সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’-তে বহুশ্রুত সেতারে ‘দেশ’ রাগে বর্ষা ইমেজারি বা, তারসানাইয়ে সকরুণ মিড় সংযোজনেরই একটি নজির!’’

Post a Comment

0 Comments