লকডাউনের দিনলিপি

মেস বন্দির দুইমাস্যা 

মৃদুলকান্তি ঘোষ



ফল। ফুল। সবজি। চিকেন। মাছ।
সদর দরজায় ফেরিওয়ালার প্রাত্যহিক রুটমার্চ। লকডাউনে মেস—বন্দি জীবনে ওঁদের ডাকেই সকাল। সন্ধেবেলা গরম সিঙাড়া। এই হাঁক আগে কখনও শুনিনি। দমদমের ফকির ঘোষ পাড়া।
ফ্রিজে আদা শেষ। পড়শি গৃহকর্তা দাঁড়িয়ে আছেন বারান্দার রেলিং ধরে। দশ মিনিটেই চিরাগের জিনের মত হাজির সবজিওয়ালা। ঠেলা গাড়িতে সবজি বেচা চলতি রেওয়াজ। লকডাউনের হাওয়া বদলে সাইকেলেও ঝাঁকা বেঁধে হোম ডেলিভারি। স্কুটারে চাপিয়ে ফল বেচছেন কাজ হারানো যুবক। রিকশাওয়ালারাও পেশা বদলে সবজি অথবা ফলের কারবারি। পাড়ার মোড়ে সস্তা দরে বিকোচ্ছে দুধ, পনির, ঘি।
চতুষ্কোণের ফাঁদে আটকা জীবন। মার্চের ২৪ থেকে মে—র ২৫। চলছে লকডাউন ফোর। ফাইভ নিয়ে জল্পনা বাড়ছে। গ্রামের বাড়ি অথবা বন্ধুর ফোন। কখনও উদ্বেগ। কখনও কথার পরশে ভাল থাকার চেষ্টা। বিকেলের ছাদে নগর—কীর্তন। নারী—নরের সত্তর দশকীয় সমীকরণ।
করোনা মোকাবিলার বিধি মেনে চারদেওয়ালে অলস যাপন। জীয়নকাঠি মোবাইল। জগৎ দর্শনের যান্ত্রিক দর্পণে মুখ গুঁজে কাটছে দিন। রান্নার মাসি একবেলা। বেতনও ছেঁটে অর্ধেক। রাতের রাঁধুনি আমরাই। মেসের অবশিষ্ট সপ্তরথীর নৈশ পাতে আলু, ডাল, ডিম।
কাট টু দুপুর। তক্তপোশে টানটান বসে অপু। বীরভূমীর সন্তান। মহানগরের তেভাগা রুমে লড়ছে করোনার বিরুদ্ধে। সামনে ল্যাপটপ। হাতের ইঙ্গিতে বোঝাল, ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম।’ পাশের ঘরে হেঁইও, হেঁইও শব্দ। ব্যায়াম করছে মালদার সমীরণ। একঘেঁয়েমি কাটানোর টোটকা। ডেটল জলে ডুব দিয়ে মেঝেয় শুকোচ্ছে বাজার ফিরতি দশ, কুড়ি, শয়ের নোট। স্যানিটাইজ হয়ে লিচু, আম, বিস্কুটের প্যাকেট, সিগারেটের প্যাকেট গা এলিয়ে বারান্দায়। টি—মেকারে ফুটন্ত আদাজল। ইমিউনিটিই মহাঔষধ! কোভিড ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা কত বাড়ল দেশে। মোবাইল বার্তায় কপালে ভাঁজ। কখনও ক্লান্তির দীর্ঘ নিশ্বাস। শহর চষে করোনা এখন গ্রামের পথে। মুর্শিদাবাদে ৪০, মালদায় ৪৫। দুশ্চিন্তার পালকে নতুন সংযোজন।
আমফানের ঝাপটায় চুরমার পরিষেবা। আমরা লাকি। নেট স্লো ছাড়া কোনও দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। পাড়ার পার্টি অফিসে বাড়ছে ভিড়। খাবার বানিয়ে ত্রাণ দেওয়ার উৎসাহে শিকেয় দূরত্ব বিধি। রক্তদান শিবিরে গা ঘেঁসাঘেঁসি শ’খানেক লোকের উপস্থিতি।
আমিও ওদের মত। মেসে বসে। বাঘ মারি। ফেসবুকে ফোঁস করি!
বন্দি দুই মাস— দিন গুনছি পথে নামার।

Post a Comment

0 Comments