বিশেষ নিবন্ধ

অন্তরে যে শক্তি

মৌমন মিত্র


আমেরিকায় আসার পর, গোড়ার দিকে যেখানেই বেরোতাম নিজের পাসপোর্ট আর সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বরটি সঙ্গে রাখতে হত। সর্বদা। তারপর যা হয়, ধীরে ধীরে জীবন অন্য ধারায় বইতে শুরু করে। এক একটা ধাপে। সেই শুরুর দিকে এখনও মনে পড়ে নিজের পার্সে পাসপোর্ট, সোশ্যাল সিকিউরিটি কার্ড ঢোকাতে ঢোকাতে নিজেকে বড্ড অসহায়, অচেনা, বিচ্ছিন্ন মনে হত। মনে হত কতটা একাকিত্বে মানুষকে নিজের পরিচয়পত্র বইতে হয় নিজের দৈনন্দিন জীবনে!
এই জাতীয় সময়ের একটা আক্ষরিক ইংরেজি শব্দ আছে। হোমসিকনেস। সারাদিন রেডিওর আমেরিকান অ্যাকসেন্ট পাগলের প্রলাপ মনে হত। ম্যাপেল আর বটের মিল খোঁজা, অহেতুক বন্ধুত্ব পাতানো, লাসানিয়ার পরতে এক্সট্রা চিজ দেখলে কেমন শরীর গুলিয়ে ওঠা। সবই কোনও এক ঠিকানার সন্ধানে। নিজের ঠিকানায় বসে। তখন খুব কলরব খুঁজতাম। ক্যাকাফোনি না হোক অন্তত যানজট, যানজট না হোক ক’টা যানবাহন, যানবাহন না হোক ক'টা শব্দ, শব্দ না হোক, অন্তত— একটা কন্সিস্টেন্ট খোঁজ।
গ্রীষ্মে বিভিন্ন কমিউনিটির ভেতর, ছোট ছোট পার্কের আশেপাশে, স্কুল, লাইব্রেরির কাছাকাছি ঘন্টি বাজিয়ে ঘুরতো এই দেশের আইসক্রিম ট্রাক। এই ট্রাক বোঝাই থাকতো নানা রঙের, নানা ফ্লেভারের বিভিন্ন রকমের আইসক্রিমে। ট্রাকের ঘন্টি বাজলেই দলে দলে শিশু, কিশোর- কিশোরী, তাদের মা-বাবারা এসে হাজির! আইসক্রিম কেনা-বেচা, মায়েদের গল্প, ছোটদের হাসি-কথায় পাড়া তখন জমজমাট। ওই দিন গুলোয় গাছের সবুজ পাতা আর এই আইসক্রিম ট্রাকই জানান দিত আমার আমেরিকান সামার।
আজও এভাবেই এই দেশে গ্রীষ্ম আসে। কেবল ম্যাপেল বনে আর বট খুঁজি না, এখন বট আর ম্যাপেলের সৌন্দর্য্য পাশাপাশি অবস্থান করে। বোধহয় তেমনটাই রাখতে হয়। এখন রেস্তোরাঁয় নিজেই এক্সট্রা চিজ চেয়ে নিই। পডকাস্টে জ্ঞানার্জন করি। অ্যান্ডার্সন কুপার প্রায় অভ্যেস। আর একবার অভ্যেস হলেই তা অভ্যেস। আর অসুবিধে হয় না। বিদ্যুৎ, বিনোদন, খাদ্য তালিকা, বেশ-ভূষা-সবটাই আসলে আমাদের অভ্যেস।
গত শুক্রবার আমার পাড়ায় অমনই এক আইসক্রিম বোঝাই ট্রাক এসেছিল। সেই ঘন্টি বাজিয়ে। আমার সন্তান সহ পাড়ার কোনও খুঁদেই বেরোয়নি। ঘন্টি শুনেও। ওরা জানে বেরোনো মানা। ওরা নিজেদের মধ্যে, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যখন কথা বলে আমি কান পাতলে শুনতে পাই। নিজেদের রেস্ট্রিকশনস আওড়ায় আর নিজেদের দুঃখে আনন্দ খুঁজে নেয়। সরল ও সাবলীল ভাবে।
আসলে ওদের মনে তো কোনও রাজনীতি বা নীতি নেই তাই ওদের ধারণা, যুক্তিগুলি ভীষণ স্পষ্ট। ওরা চট করে খুব স্বচ্ছ ভাবে হ্যাঁ অথবা না— এই দুই দলে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে জীবনের সবটা।
আমার পাশের বাড়িতেই একটি কোরিয়ান পরিবার বসবাস করেন। তাঁদের দুই সন্তান খুবই ছোট। চার এবং দু'বছর তাদের বয়েস। এই ৭২ দিনের লকডাউনে আজ প্রথম আধ মিনিটের জন্য ওদের কোনও একটি শিশুকে কাঁদতে শুনলাম। জানি না ফেসবুক লাইভ, নাচ, গান, রাজনীতি, নাটক, প্রেম, রেষারেষি, প্রতিযোগিতা— ঠিক কীসের মাধ্যমে শিশু দুটি দৈনন্দিন এই লকডাউনে ‘ফান’ করে।
এই বন্দিদশায় আমার চোখে দেখা ভারতবর্ষ এবং আমেরিকার শিশুররা যেভাবে নিজেদের পছন্দ, অপছন্দ,বন্ধু-বান্ধব, পোশাক, খাবার, খেলাধুলো— সব কিছু সময় ও পরিস্থিতির সঙ্গে সমান তালে মানিয়ে নিয়েছে তা প্রশংসনীয়। ওরা নির্দলীয় ভাবে সংগঠিত রূপে লড়াই করছে। অথচ; ওদের এই জীবনটা পাওনা ছিল না। আমরা দিয়েছি ওদের। একটা ফেক, ইকোনোমি-সেন্ট্রিক, প্রকৃতি-বর্জিত, যুদ্ধ-কালীন সময়— আমরা দিলাম ওদের।
কত বড় করে ভাবি আমরা। রাজনীতি, সংগঠন, প্রজন্ম, দারিদ্র, বিক্ষোভ, বিপ্লব, ত্রাণ। যার বদলে ওরা আমাদের বলল, ‘আইসক্রিম ক্যান ওয়েট ফর দা নেক্সট ইয়ার!’ ছোট্ট ভাবনায় শেখালো ধৈর্য, সহমর্মিতা, চিন্তাশীলতা, মনুষত্ব।
ভাগ্যিস! ওরা আমাদের জগৎ বোঝে না। তাই অত গুঁতোগুঁতি নেই। একটু এক্সট্রা স্ক্রিন টাইম চাইলে ওরা অসভ্য ঠিকই। পরবর্তীকালে ওদের অতি সভ্য হওয়ার দৌড় তো বাকি রইলই। যেখানে জীবাণু এলে তেড়ে রাজনীতি ফলাতে হয়, বিপদে বিক্ষোভ, বর্বরতার তান্ডব চালাতে হয়।
ওদের ‘অন্তরে যে শক্তি আছে,’ ওরা, ‘তারই আদেশ’ পালন করেছে। এই ধ্বংসস্তূপ ওদের প্রাণেই স্নাত হবে। ওদের নিটোল শৈশবই আমাদের ত্রাণ। কী নিখুঁত হবে শিশুদের এই ট্যাপ অ্যান্ড স্টেপ প্রসেস! মিলিয়ে নিও অমিত...!

(লেখক নিউ জার্সির বাসিন্দা। কবি, প্রাবন্ধিক)

Post a Comment

0 Comments