লকডাউনের দিনলিপি

অন্তরিন বা করোনার অসুখ

সঞ্জয় ঘোষ


চারপাশ জুড়ে এক অদ্ভূত নিস্তব্ধতা... একটা নিদারুণ শূণ্যতা... একটা মানুষ থেকে আরেকটা মানুষের মধ্যে ছফুট ব্যবধান? আমরা কি কাফকার ‘মেটামরফসিসে’র মতন সবাই পোকা হয়ে গেছি? একটা অন্ধকারের সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে আমাদের যাতায়ত? ‘দূরে কাছে কেবলি নগর, ঘর ভাঙে;/ গ্রামপতনের শব্দ হয়;/ মানুষেরা ঢের যুগ কাটিয়ে দিয়েছে পৃথিবীতে, দেয়ালে তাদের ছায়া তবু/ ক্ষতি, মৃত্যু, ভয়,/ বিহ্বলতা ব’লে মনে হয়’।
যেদিন আমরা চীনের হুয়ান প্রদেশে প্রথম করোনা ভাইরাসের কথা শুনেছিলাম, আমরা জাগতিক নিয়মে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলাম, আমরা ভেবেছিলাম যে ওইসব অসুখ এদেশে আসবে না কোনওদিন, আমরা ভাবিনি, ‘এ কি শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা?’ এবং সে এল, জাঁকিয়ে বসল, আর আমরা সবাই এক সর্বনাশের প্রান্তরের সামনে এসে দাঁড়ালাম।
১৮৪৯ সালের ওরান শহরে যে প্লেগ মহামারীর অন্ধকার ছায়া ঘনিয়ে এসেছিল, তার বর্ণনা ১৯৪০ এ লেখা কাম্যুর উপন্যাসে পড়ে আমাদের হাড় হিম হয়ে আসে। আর এই মুহূর্তে আমরা যেন প্রতক্ষ্য সাক্ষী তার, সেই উপন্যাসের আমরা যেন এক একটা চরিত্র আজ।
প্রথম প্রথম ‘থ্রিলিং’ লাগছিল বেশ! লকডাউনের প্রথম দিনগুলোয় রাতগুলো মনে হচ্ছিল বেশ পরিপূর্ণ অবকাশ, একটা নিটোল ছুটি। মনে হচ্ছিল ‘এ জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের’। বেশ লিখছিলাম, আঁকছিলাম, গান শুনছিলাম, ফিল্ম দেখছিলাম। এতদিন যে সময় ধরা দেয়নি, নিজের সঙ্গে দেখা হওয়ার যে সময় পাওয়া যায়নি এতকাল, তার সব প্রতিশোধ নিয়ে ফেলব আজ। সময়ের ঘোড়াকে বশ মানিয়ে এই নতুন লাগামহীন পথে যাত্রা শুরুর আদর্শ মুহূ্র্ত যেন আজ।
কিন্ত কয়েকদিন পরের থেকে এই স্বাধীন ভাবনা, এই মুক্তির স্বাদ যেন একটু একটু করে পালটে যেতে লাগল। মনের মধ্যে একটা আশঙ্কা, একটা ভয় চেপে বসতে লাগল। এই অসুখ যেভাবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, শেষপর্যন্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে পৃথিবীর কতজন? মানুষকে হারাতে হবে তার কত প্রিয়জনকে? কত বদলে যাবে মানুষের ভুগোল আর ইতিহাস? কত মানুষ কাজ হারাবেন? একটা দুর্ভিক্ষ কি হানা দেবে এর পর? সেইসঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে বন্ধুবান্ধব, পরিচিতদের সঙ্গে সামনা সামনি দেখাশোনা না হওয়া, কথাবার্তা না বলা থেকে এক অদ্ভূত একাকিত্ব তৈরি হতে থাকে মনের মধ্যে। শুধু মোবাইল, শুধু ভিডিও কলের কৃ্ত্তিমতা কখনো পূরণ করতে পারে না এই ‘কমিউনিকেশান গ্যাপ’। আর চলে গেছে ভ্রমণের স্বাধীনতা, এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াবার অধিকার। প্রিয় বাসভূমি শান্তিনিকেতন, যেখানে মাসে যাতায়াত করি দুতিনবার, গত দেড়মাস না যেতে পেরে জল ছাড়া মাছের মত অবস্থা। মনে হয় যেন কোন দ্বীপে নির্বাসিত হয়ে আছি। এই নির্জন অন্তরীণ তো চাইনি কোনওদিন।
এই নির্বাসিত দিনগুলোতে তারকভস্কিকে আঁকড়ে ধরি। তাঁর ‘ইভান’স চাইল্ডহুড’, ‘নস্টালজিয়া’, ‘মিরর’ প্রভৃতি ছবিগুলি নিবিড়ভাবে দেখে যেতে থাকি। ইভানের সেই স্বপ্ন, বৃষ্টি্র মধ্যে ট্রাকের ওপরে আপেল হাতে নিয়ে কিশোর-কিশোরীর নিষ্পাপ হাসি, যুদ্ধের ভয়ংকর পটভূমিতে মানুষকে নতুনভাবে বাঁচার প্রেরণা দেয়। জীবনের গভীরে খনন করে তারকভস্কি যে দর্শন ছড়িয়ে দেন সেলুলয়েডের পাতায় পাতায় তা যেন এই দুরারোগ্য সময়ে আমাদের জন্যে বিশল্যকরণী বয়ে নিয়ে আসে।
এবং মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের জীবনের ডিপ্রেশনের দিনগুলোর কথা। নোবেল প্রাইজ পাবার ঠিক পরে রামগড় পাহাড়ের নির্জন গিরিপথে রবীন্দ্রনাথের নিজের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখেছেন পরবর্তী কোনও চিঠিতে, ‘...দিনরাত্রি মরবার কথা এবং মরবার ইচ্ছে আমাকে তাড়না করেছে। মনে হয়েছে আমার দ্বারা কিছুই হয়নি এবং হবে না। আমার জীবনটা যেন আগাগোড়া ব্যর্থ।... রামগড়ে যখন ছিলু্ম তখন থেকে আমার conscience-এ কেবলই ভয়ঙ্কর আঘাত করচে যে বিদ্যালয় জমিদারী সংসার দেশ প্রভৃতি সম্বন্ধে আমার যে কর্ত্তব্য আমি কিছুই করিনি... কেবলি মনে হচ্ছিল যখন এ জীবনে আমার  ideal কে realize করতে পারলুম না তখন মরতে হবে,... মনের মধ্যে এইরকম সুগভীর অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে’। মানুষের নিজের মুখোমুখি হবার এই গোধূলিসন্ধিতে মানুষ হয়তো এইভাবে ঋণাত্বক মানসিকতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মতন উপনিষদ-বিশ্বাসী মানুষও এর হাত থেকে ছাড় পাননি।
চোখে পড়ে যায় এডভার মুংকের আঁকা ‘দ্য স্ক্রিম’। সেই রক্তরঙা আকাশের ব্যাকগ্রাউন্ডে একজন অপার্থিব ভয়ার্ত মানুষের দিগন্ত-কাঁপানো আর্তনাদ, বাতাস-চেরা চিৎকার। সেই চিৎকার, সেই আর্তনাদ যেন আজ পৃথিবীর দিকে দিকে। ১৮৯৩ সালে আঁকা এই ছবি কি গভীর অর্থবহ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজকের পটভূমিতে। মুংকের জীবন, তাঁর অসুস্থতা, তাঁর মানসিক টানাপোড়েন, তাঁর অসংখ্য ছবির সঙ্গে বার্তা বিনিময় হতে থাকে আমার, এই দুর্যোগের দিনরাত্তিরে।
প্রকৃতির ওপরে এতদিন যে অবিচার করে এসেছি আমরা তারই হয়তো প্রতিশোধ নিচ্ছে আজ প্রকৃতি ভয়ংকরভাবে। তবু ওই প্রকৃতিই হয়তো শেষ আশ্রয়, শেষ ভরসা হয়ে দাঁড়াবে আমাদের। শিলাইদহের পদ্মাপারে অবসাদগ্রস্ত রবীন্দ্রনাথ শুশ্রুষা খুঁজে নিচ্ছিলেন প্রকৃতির কোলে, প্রকৃতিকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়ে, ‘থাক না তোমার লক্ষ গ্রহ-তারা/ তাদের মাঝে আছ আমায় হারা/ সইবে না সে সইবে না/ টানতে আমায় হবে পাশে/ একলা তুমি, আমি একলা হলে’। হয়তো প্রকৃতিই শেষপর্যন্ত পথ দেখাবে আমাদের, হয়তো ‘এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে’।

Post a Comment

0 Comments