লকডাউনের দিনলিপি

সবাইকে ভাল রেখো

আবীরা সাহা


‘‘নিন না দিদি খুব ভালো শাক।’’
‘‘মা নাও না গো পুঁইশাক তো খুব ভালো।’’
বুঝলাম এটা ক্ষেন্তি এফেক্ট। সবে পুঁইমাচা শেষ হয়েছে। মাঝে মাঝেই পুঁই চারা লাগানোর বাসনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। কিন্তু আমার কোনও পক্ষপাতিত্ব নেই পুঁই শাকের প্রতি। ওদিক থেকে ‘নিন না দিদি’, এদিক থেকে ‘নাও না মা’র চাপে নিয়েই ফেলি একবোঝা। ডাঁটাগুলো লাগালে গাছ হবে কিনা ভাবতে ভাবতে দাম মেটাই। গুটিকয় উচ্ছে, ঝিঙে আর টমেটো আজকের সংগ্ৰহ। আর কিছুই নেই। মাঝে মাঝে সাইকেলে করে সবজি নিয়ে আসছে ছেলেটি। পেশায় দিনমজুর। এখন কাজ বন্ধ। এমন কত কিছুই যে বন্ধ। সব বদলে যাচ্ছে, জীবন জীবিকা।
ছুটি ছুটি একটা আমেজ, এটা ওটা রান্না, একটু হাতের কাজটাজ, বেশ কাটছিল শুরুর দিনগুলো। তখনও শুধুই চীন। ইতালি লাশ গোনা শুরু করেনি। পরিযায়ী শ্রমিকরা হাজার বারোশো কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়নি। সব বদলাতে থাকল ধীরে ধীরে। কেমন যেন দিশাহারা লাগে। মানুষ পারে? এতটা পথ, এতগুলো দিন, অনাহারে অর্ধাহারে। খবর দেখা কমিয়ে দিই। তবুও চোখ আটকায়। কেনিয়ার মোম্বাসা। এক মা, অভুক্ত অনেকগুলো ছেলেমেয়ে। উনুনে হাঁড়িতে পাথর চাপায় মা। চলে রান্নার অভিনয়। অপেক্ষা করতে করতে একসময় তারা ঘুমের কোলে ঢলে পড়বে, এই আশা। কে যেন খুব জোরে জোরে  ঝাঁকিয়ে দিয়ে যায়।
‘‘মা পড়ো না। থামলে কেন?’’
সেও বন্দি কতদিন। নিত্যদিনের হাসিখেলা থেকে কতদূরে। কথায় কথায় মুখভার, চোখ ছলছল, অকারণে তীব্র অভিমান। আমার কি আর সাধ্য তার ঘরের মধ্যে বাইরেটাকে এনে দেবার। তাই তাক থেকে একে তাকে নামাই একেকদিন। ক্ষেন্তির সঙ্গে যখন দুর্গাকে মিলিয়ে মিশিয়ে কল্পরাজ্য গড়ে তোলে, তখন আমি সব ভুলে যাই। আশঙ্কার ঘন ছায়া মনের ওপর থেকে নিমেষে উধাও। অপুর সঙ্গেই ওর মিল বেশি। অমনি ডাগর চোখে হাজার প্রশ্ন, অমনি অবাক হওয়া, মুগ্ধ হওয়া। কিন্তু ওর ভালোলাগার পাল্লা দেখি দুর্গার দিকেই ভারি। কি জানি বিপরীত প্রকৃতিই হয়তো টানে বেশি। ‘‘...ঘরে একটা দানা নাই। দুটোখানি বাসি চালভাজা মাত্র আছে। অপু কান্নাকাটি করে, তা হবে না’’। রাজী হয় না। ‘‘তবে রাজকাহিনী?’’
‘‘না মা বলো না দুর্গার কি হলো?’’
দুর্গার জ্বর বাড়লে যখন অপু দিদির মাথায় জলপটি দেয় আর করুন সুরে ডাকতে থাকে, ও তখন বালিশে মুখ লুকায়। ওর কেন জানি না ভয় হয়েছে, ক্ষেন্তি বাঁচেনি দুর্গাও বোধহয় বাঁচবে না। ভুলিয়ে ভালিয়ে উঠে পড়ি। পথের পাঁচালি আবার তাকে তুলে রাখি। বরং চাঁপা গাছটা দেখে আসি। বহুদিনের ইচ্ছা একটা শ্বেত চাঁপার গাছ হবে বাড়িতে কিন্তু অত বড় গাছ! তবুও বছর দুয়েক আগে বড় শখ করে টবেই লাগিয়েছি গাছটা। কদিন হল কুঁড়ির মতো কি যেন দেখা দিয়েছে। এত কাছ থেকে তো এর কুঁড়ি দেখিনি আগে। গাঢ় সবুজ সূচালো আর বড্ড শক্ত। ঠিক বিশ্বাস হয় না কুঁড়ি বলে। তার কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস কুঁড়িই হবে। তাই প্রতিদিন দুবেলা চলছে পর্যবেক্ষন। আর দেরিও নেই ফুটল বলে।
‘‘দেখ মা, এবার বোধহয় লাল গুলঞ্চতেও ফুল আসবে।’’ কাছে গিয়ে দেখি সত্যিই তো। ছোট্ট ছোট্ট দুটো মাত্র ডাল।তারই মাথায় একঝাঁক গুজিগুজি কুঁড়ি এসেছে। ঝোপ থেকে একটু ফাঁকা জায়গায় সরিয়ে আনি।
চেষ্টা করি ভাল থাকার। ভাল রাখার।কিন্তু ওই রুটিগুলো! রেললাইনের ওপরে! ভাল থাকতে দিচ্ছে কই। এইসব খবরগুলো আড়াল করি ওর থেকে। কতটুকু প্রাণ।
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল। বেশ কবছর আগের কথা। পুজোর ছুটিতে গেছি গ্রামের বাড়ি। পড়ন্ত বেলার নরম রোদে  উঠোনে বসে আছি সকলে। একটু দূরে একটা বাড়ির উঠোনে কালি ঠাকুর বানানো চলছে। নতুন চোখে অজস্র কৌতূহল। যেতে হল কাছে। প্রতিমা বানানোর কাজ প্রায় শেষ। এবার রঙ হবে। একটাতে শুরুও হয়েছে। সেই প্রথম তার ঠাকুর বানানো দেখা। যারপরনাই অবাক,
‘‘মা ঠাকুর কি মানুষেই বানায়’’— এর চেয়ে আশ্চর্যের কি আর কিছু হতে পারে!
‘‘তবে যে দিদুন বলেছে ঠাকুর নমো করার সময় বলতে— ঠাকুর সবাইকে  ভালো রেখো।’’
আমি সেদিনও নিরুত্তর। আজও তাই। আমিও  তো প্রবল বিশ্বাস করেই বলতে চাই ‘‘সবাইকে ভালো রেখো।’’

Post a Comment

0 Comments