নগরকীর্তন

গানের পাখি/ ৩

গানের লীলার সেই কিনারে

আবীর মুখোপাধ্যায়


স্বর্ণযুগের বাংলা গানের সুর ও কথার মতোই মিঠে সেই সব গান তৈরির গল্পও। সুরকার, গীতিকারদের সঙ্গে শিল্পীদের সম্পর্ক— জন্ম দিয়েছে যামিনি পটে জড়ানো বিচিত্র উপাখ্যানের। এই ধারাবাহিকে আমরা ফিরে ফিরে শুনব হারানো দিনের মনকেমনের গান। চেয়ে চেয়ে অপলক দেখব সুরের আকাশে শুকতারা। আর একলা হয়ে নিবেদন করব একে অপরকে গানের রেকাব। এই পর্বে ফিরে পড়ব প্রায় হারানো, আমার একটি লেখা।


নতুন কারও সঙ্গে আলাপ হলে যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আমি সহজে কথা চালিয়ে যেতে পারি বা ভালোলাগে তার একটি রবীন্দ্রনাথের গান বা সে গানের কোনও শিল্পী। কেন না, এই গান কেবল আর শুনতে কিংবা পড়তে ভাল লাগে না আমার। বরং দিনে দিনে এই গান-কেন্দ্রিক ব্যক্তিগত অনুভব শুনতে অথবা শোনাতেই ব্যাকুল মন।
কতক্ষণ যে কথা বলি... উল্টো দিকের মানুষ তেমন তেমন হলে কখনও কিচ্ছুটি বলি না। দু’জনেই প্রিয় গানটির কথা ব’লে, হয়তো মনে মনে শুনি!
হয়তো বা, সুরের চলন বাঁক, অলস মায়ায় মীড়ে গড়িয়ে যেতে যেতে গোপনকে ছুঁয়ে ফেলা, কোমল স্পর্শস্বরে গাঁথা সঞ্চারীর বেদন-রাগ কিংবা গানের কিনারে একটি দুটি শব্দের কাছে এসে চুপ করে যাওয়া— এই সব ঘুরতে থাকে কথাবার্তায়। আরও একটা বিষয় ইদানিং এসে পড়ছে। সে হল শিল্পীর দায়। ‘দায়’ কথাটা সব সময় যে আলোচনায় ঘুরতে থাকে তেমন নয়। তবু এসেই পড়ে। ব্যর্থতা-সফলতা, নিজের গানকে অক্ষত রাখতে কবির নিজের উদ্যোগ... নানা প্রসঙ্গ।
বহুদিন পরে কাল তেমন একজনের সঙ্গে আলাপ হল, যিনি দুই পারের রবিঠাকুর শোনেন।
লক্ষ্মীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। অধুনা ফরাক্কার বাসিন্দা সুভদ্র লক্ষ্মীবাবু জর্জ শোনেন। কলিম শরাফীও শোনেন। পেশা ও রাজনীতির জগতে বিপুল যোগাযোগের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গান শোনার পরিধিও আদিগন্ত। হেমন্ত, সাগর সেন, অর্ঘ্য সেন, মোহর-কণিকা, চিন্ময় থেকে মোহন সিং খাঙ্গুরা!
প্রায় দ্বিপ্রহর, রোদ এসে পড়েছে রেলিং-এ। কালোর দোকানে এখনও কেউ কেউ। গরম হাওয়া মাঝে মাঝেই সামনের পাকুড় গাছের পাতায় পাতায় ঝড় তুলছে। পাক খেয়ে ধুলো উড়ছে রতনপল্লির মাঠে, পূর্বপল্লির নির্জন রাস্তায়। বইওয়ালায় বসে কথা হচ্ছিল লক্ষ্মীবাবুর সঙ্গে।
কার কবিতা পড়েন?
এখন রবীন্দ্রনাথ। আমি রবীন্দ্রনাথের কবিতাই পড়ি।
তাঁর বলার মধ্যেই আমার চমকের অভিজ্ঞতা। ভেবেছিলাম শক্তি-সুনীল-শঙ্খের কথা শুনব। কেন না, তার একটু আগেই কবিতার র‍্যাকের দিকে তাকিয়ে উনি বলছিলেন, ‘একসময় কবিতা নিয়েও কম মাতামাতি করিনি।’ সাহস পেয়ে গানের কথা জিজ্ঞেস করি।
আর গান?
রবীন্দ্রনাথ!
ক্রমে এমনি করেই তাঁর সঙ্গে আমার কথা এগোয়। রবীন্দ্রনাথের গানের এমন একজন শ্রোতার সন্ধান পেয়ে মনে মনে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই। জর্জ ও কলিম শরাফীর কথা বলছিলেন উনি।
ওঁর বলার মধ্যে আমার মনে পড়ছিল ‘জর্জ’ বইটির কথা। বছর দেড়েক আগে সৌভাগ্য হয়েছিল এই গ্রন্থের লেখক বাসব দাশগুপ্তের সঙ্গে আলাপচারিতার। বাসববাবুর স্ত্রী মানে, জর্জ বিশ্বাসের ভাগ্নী পারমিতাদির ইন্টারভিউ করতেই সে বার যাওয়া ওঁদের বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথের গান ছুঁয়ে জর্জ নিয়ে সেই কথোপকথন স্মৃতি রইল এখানে।
জর্জকে প্রথম দেখলেন... সেটা কবে?
‘আমি দেখেছি মৃত্যুর কিছুকাল আগে। সেটা আশির দশক। এর আগে আমি যা দেখেছিলাম, সেভাবে পরিচয় ছিল না। একজন শ্রোতা হিসাবে একজন গায়ককে যেমন দেখে।’
পারিবারিক যে আত্মীয়তার জায়গা?
‘তখনও সেটা হয়নি। পারমিতার সঙ্গে বিয়ে তখনও না হলেও সেটা হওয়ায় একটা সম্ভবনা তৈরি হয়েছিল। সেই সূত্রে যাওয়া। এবং দেখা। একটা ছোট কাগজ করতাম। তার ইন্টারভিউ নিতে রাসবিহারীর ছোট্ট ঘরটায় পারমিতার সঙ্গে ঢুকে পড়েছিলাম একদিন।’
প্রথম দিনের আলাপি কথার কিছু মনে পড়ছে, শুনেছি খুব মজার মানুষ ছিলেন?
‘তেমন কিছু নয়। ঠাট্টা করলেন। ওকে বললেন, ‘ব্যাপারটা কি? তুই ওরে লইয়া আইছিস ক্যান?’ ও তো তখনও বাড়িতে বলেনি, আমার সঙ্গে সম্পর্কের কথা। বললেন, ‘এত শিল্পী থাকতে আমার উপর উৎসাহ ক্যান? আসলে তো আমার উপর উৎসাহ না, আপনার উৎসাহ অন্যদিকে।’
সে সময় তো ও বাড়িতে খোকন রয়েছেন সঙ্গে। আপনাদেরও কি নিত্য আসা-যাওয়া ছিল?
‘খোকন সঙ্গেই থাকতেন। খুব ভালবাসতেন ওকে। চিকিৎসার জন্য ভিয়েনা পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন। খোকন মারা গেলে গান প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই সময় ওনার সঙ্গে পারমিতার দাদা, পরে দিদি থাকতেন। উনি নিজেই পারমিতাকে ভর্তি করে দেন শান্তিনিকেতনে। সেখান থেকে পারমিতা এসে বাড়ি না গিয়ে দৌড়োতেন মামার কাছে। দু’জনের মধ্যে সম্পর্কটা নিছক মামাগভাগ্নীর নয়। ওঁদের চিঠিগুলো পড়লে বোঝা যায় সম্পর্কটা পিতার সঙ্গে কন্যার মতো। পারমিতা গান গাইত। উনি শেখাতেন, উৎসাহ দিতেন। কিন্তু বলতেন, ‘প্রফোশনালি গান গাইবি না। বড় কাদার জায়গা। তুই পারবি না সহ্য করতে।’
ট্রাইঙ্গুলার পার্কের বাড়ির অভিজ্ঞতা মনে পড়ে এখন আর...!
‘ওঁর ছিল হাঁপানি। বৃষ্টিতে ভেজা একেবারেই নিষেধ। তো ওঁর বাড়ি যেতে একটা গলি পড়ত। কিন্তু বৃষ্টি নামলে, ওদের নিয়ে গলিতে ইজিচেয়ারে বসে, ছাতা মাথায় বৃষ্টি দেখতেন। আর বর্ষার গান গাইতেন। একের পর এক গান... সামনে বসে না শুনলে ঠিক বিশ্বাস হয় না!’
সে সময় কারা আসতেন ঘরে?
‘যারা খুব আস্থাভাজন ছিলেন। গায়ক-গায়িকাদের মধ্যে অবশ্যই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আসতেন। খালেদদা আসতেন। জর্জ ওঁকে খুব ভালবাসতেন। কথা শুনতেন ওঁর। কি যে জেদ ছিল ওঁর। সে জেদ ভাঙাতে পারতেন খালেদদা। ওঁর দুটো বই, কেমন হবে, কোন লেখার পর কোন লেখা, সব খালেদ চৌধুরীর। দুটো বইয়ের প্রচ্ছদও খালেদ চৌধুরীর করা।’
ওঁর চলে যাওয়ার...!
‘সে দিন খবর পেয়ে আমরা গিয়ে দেখি লোকারণ্য। ঢোকা যায় না। বহু শিল্পী, সংস্কৃতির লোক। ছিলেন অর্ঘ সেন। উনি গোরা বলতেন। কবেকার কথা। অর্ঘ্য সেন ভাল সেলাই করতেন। পারমিতার মার কাছে শুনেছি। প্রায় ৩০ বছর গান শিখেছেন ওঁর কাছে। সে দিন সকালে অনন্ত এসে খবর দিয়ে যায়। রেডিওতে তার আগেই ঘোষণা হয়েছে।
উনি শেষ দিকে বলতেন। তোরা একদিন শুনবি। দেবদুলাল রেডিওতে বলছে, ‘আজ ভোরে কুখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মারা গিয়েছে’। সেই হল। মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে পারমিতা গিয়েছে। তখনও শরীর ভালো নয়। ওকে বলেছেন, ‘আয় তোকে দেখিয়েদি, কোথায় কি টাকা পয়সা আছে। খুব যে শরীর খারাপ তেমন নয়। গায়ে জ্বর ছিল। আসলে অ্যাজমার জন্য খুবই কষ্ট পেতেন। দু’ তিন দশক বিছানায় শুতে পারেরনি। ইজিচেয়ারেই সারা সারা রাত বসে থাকতেন।’
ওঁর শেষ কৃত্য করার জন্য ৫০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়েছিল শুনেছি।
‘সে চাঁদা ফেরত দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এসে বললেন, ‘সব ভার সরকারের।’ ওঁর দেহ নিয়ে যাওয়া হল রবীন্দ্রসদনে।
সে নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। কেন না, তার কিছুদিন আগেই উত্তমকুমারের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর দেহ সদনে রাখা হয়নি। একটা বিরাট শোকযাত্রা হাঁটছিল শশ্মান পর্যন্ত। কত লোক। শোকে-কান্নায় রোল উঠছে। পারমিতাই মুখাগ্নি করে। সন্ধে হয়ে আসছে, তখন চিতায় তোলা হল।’



Post a Comment

0 Comments