রবিবার

বইওয়ালার রবিবার/ ৫

শেষ হয়ে হইল না শেষ

আবীর মুখোপাধ্যায়


১৮৭৩-তে ‘বঙ্গদর্শন’-এ প্রকাশিত ‘মধুমতী’ কি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম ছোটগল্প?
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাহিত্যে ছোটগল্প’-র ভিতর তা হলে তেমন করে বাংলা ছোটগল্পের কথা এল না কেন? সাহিত্যের ইতিহাসবেত্তারা কেউ কেউ অবশ্য দাবি করেন, বাংলা সাহিত্যে এই নব-সাহিত্য ধারাটির জন্ম পাশ্চাত্য প্রভাবে। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পেও রয়েছে সেই প্রভাব। একটু পরের দিকে হলেও রূপ ও রীতি নিয়ে সেই অর্থে সে প্রভাব কাটিয়ে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পই বাংলা সাহিত্যে প্রথম নিজস্বতায়, ‘প্রতীতির সমগ্রতা’-য় উত্তীর্ণ। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট থেকে কবির তেমন তিরিশটি ছোটগল্প নিয়ে প্রকাশিত সংকলন গ্রন্থ ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’। 
‘গল্পগুচ্ছ’, ‘লিপিকা’ এবং ‘গল্পসল্প’ মিলিয়ে প্রায় দেড়শো ছোটগল্প লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সাময়িকপত্রের দিক থেকে মূলত দুটি পর্বে ভাগ করা হয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পকে। প্রথম পর্ব, হিতবাদী-সাধনা-ভারতী পত্রিকাকে ঘিরে। এবং দ্বিতীয় পর্ব সবুজপত্রকে ঘিরে। ট্রাস্টের গ্রন্থটি সু-সম্পাদনা করেছেন ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার বাংলা সাহিত্য বিভাগের প্রধান ব্রতীন দে। ছোটগল্প ও রবীন্দ্র ছোটগল্প নিয়ে এই গ্রন্থের মূল্যবান ভূমিকা লিখেছেন অধ্যাপক উজ্বলকুমার মজুমদার। গ্রন্থ পরিকল্পনায় দেবব্রত সরকার, সমরেশ চট্টোপাধ্যায়, সবিতা সারোভা। সু-শোভন এই সংকলনের প্রথম গল্প ‘দেনাপাওনা’, শেষ গল্প ‘ভূলস্বর্গ’।
উজ্বলবাবুর ভূমিকাটি এই সংকলনের জন্য একটি অত্যন্ত জরুরি অবতারণা। শুরুতেই সাহিত্যের এই শিল্পরূপটির একেবারে আদি-সময়ের কথা লিখেছেন তিনি। ম্যাথিউসের ‘দি ফিলোজফি অব শর্ট স্টোরি’ বা, বিস্মৃতপ্রায় নগেন গুপ্তর ‘সংগ্রহ’-র কথা কিংবা স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘নবকাহিনী’-র কথা নিবিড় পাঠকদের সুনিশ্চিত ভাল লাগবে। দেড়শো গল্পের মধ্যে কেন তিরিশটি গল্প বেছে নেওয়া হল এই সংকলনে?
উজ্বলবাবু সংকলনের ভূমিকায় লিখেছেন সে উত্তর, ‘যে তিরিশটি গল্পকে এই সংকলনে বেছে নেওয়া হয়েছে তার বাইরেও ভালো গল্প থেকে গেল। নির্বাচনে দ্বিধা-সংশয় থেকেই যায়, এবং সেই দ্বিধা-সংশয় নিয়েই এইটুকু বলতে পারি, ভালো গল্পের কথা ভেবেই নির্বাচন করা হয়েছে। বিষয়বৈচিত্রের কথা ততটা ভাবা হয়নি’। 
ছোট গল্পে ‘প্রতীতির সমগ্রতা’- কথা বলেছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘সাহিত্যে ছোটগল্প’ গ্রন্থে। এ আদতে স্টাইলের বন্ধন। কেন না, বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পে ‘স্টাইলগত পরিপূর্ণতা এসেছে বস্তু-নির্বাচনে, বিন্যাসে, ভাষা-কৌশলে, সিদ্ধান্তে এবং সর্বাত্মক সামঞ্জস্যে’। সুতরাং ‘গল্পে এই ‘প্রতীতির সমগ্রতা’ রক্ষার প্রধান দায়িত্ব হল স্টাইলের; ভালো স্টাইল না হলে ভালো গল্প লেখা হতেই পারে না’। এখানে ভালো গল্পের মানদন্ডে ১৮৭৪ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘ভিখারিণী’-কে কেউ কেউ বলে থাকেন ‘অল্প বয়সের আবেগে আপ্লুত অপরিণত রচনা’। সেদিক থেকে আরও একটু পরের দিকে, অর্থাৎ ৮৪-তে ‘ঘাটের কথা’ বা, ‘রাজপথের কথা’-ও সেই অর্থে ছোটগল্প বলতে চান না কেউ কেউ।
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে এই ‘স্টাইল’-এর ‘উৎসমুখ খুলে যায়’ ১৮৯১ থেকে। পরবর্তী পাঁচ বছরে কবি ৪৪টি গল্প লিখেছেন। যার মধ্যে ‘দেনাপাওনা’, ‘পোষ্টমাষ্টার’, ‘একটি আষাঢ়ে গল্প’, ‘দালিয়া’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘ছুটি’, ‘সুভা’, ‘সমাপ্তি’, ‘নিশীথে’, ‘অতিথি’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর মতো গল্প রয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ খুব সুন্দর করে এই ‘স্টাইল’ কথাটার মানেও করেছেন। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর বিশদ ব্যাখায় লিখেওছেন সে কথা। ‘অনুকৃত ফ্যাশন’ আর ‘মৌলিক স্টাইল’-এর পার্থক্য দেখাতে গিয়ে বলছেন, প্রথমটি হল ‘মুখোশ’, দ্বিতীয়টি ‘মুখশ্রী’। প্রথমটি বেমানান প্রসাধন, দ্বিতীয়টি সহজাত লাবণ্য। তো এই লাবণ্যময়তাই রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের প্রাণ।
এ গ্রন্থের নাম ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’। রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কাব্যের ‘বর্ষাযাপন’ কবিতা থেকে এই লাইনটি সম্পাদক গ্রন্থের নাম হিসাবে তুলে নিয়েছেন। এই কবিতাটিতেই ছোটগল্পের চরিত্র খুব সহজ ও সুন্দর করে বলেছিলেন কবি। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লিখছেন, ‘খাঁটি ছোট গল্পের এই হল সহজসুন্দর কাব্যিক ব্যাখ্যা’। তিনি লিখছেন, ‘কাহিনীর ধূপ নিবে যাবে, কিন্তু তার ভাবের সৌরভটি মোহ বিস্তার করতে থাকবে ধীরে ধীরে’। সম্পাদকের সু-সম্পাদনায় সংকলনে যে তিরিশটি গল্প স্থান পেয়েছে, সেগুলি রবীন্দ্র-ছোটগল্পের রূপ ও রীতির উজ্বল-উদ্ধার। ভূমিকায় দেখি, উজ্বলবাবুর সে দাবি, ‘খুব সহজেই পাঠক ‘ভারতীয় সাহিত্যের আধুনিক গল্প-শিল্পের অনত্যম পথিকৃৎ রবীন্দ্রনাথের গল্প রচনার দক্ষতার পরিচয়’ পাবেন’।
রবীন্দ্র-ছোটগল্পের এই সংকলন শিলাইদহ এবং শান্তিনিকেতনের ল্যান্ডস্কেপ দিয়ে সাজিয়েছেন সম্পাদক।
শিলাইদহ কেন?
শিলাইদহে জমিদারীর কাজে গিয়ে কবি তাঁর রোমান্টিক ধ্যানের জগত থেকে নিত্য দিনের চাওয়া-পাওয়ার সংসারের সংস্পর্শে এসেছিলেন। পদ্মার চর, ছায়া নিবিড় গ্রাম, নানা চরিত্র, পার্বণ, লোক-বিশ্বাস এসব উঠে এসেছিল এই শিলাইদহ পর্বেই তাঁর ছোটগল্পে। রবীন্দ্র-সাহিত্যের নিষ্ঠ পাঠক-সম্পাদক ব্রতীন সেই পদ্মাপারের ল্যান্ডস্কেপকে তাঁর নিজের লেন্স দিয়ে ব্যাপ্ত পটভূমিতে সাজিয়ে দিয়েছেন গ্রন্থে সেই কারণেই। ছবিগুলি বিভিন্ন সময়ে শান্তিনিকেতন ও বাংলাদেশ সফরে তাঁর নিজেরই তোলা। প্রায় সাড়ে চারশো পাতার রয়্যাল সাইজের এই গ্রন্থ আদতে সংগ্রহযোগ্য এক সংকলন। দীর্ঘ লকডাউনের এই দিনে ফিরে পড়ার জন্য এ এক বড় প্রাপ্তি!

সম্পাদনা : ব্রতীন দে, প্রকাশক : ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট

Post a Comment

1 Comments