বিশেষ নিবন্ধ

কাঁদিছে সকলে 

মৌমন মিত্র


ভেজা আকাশের নিচে একটা সোঁদা-বাতাস থাকে। তারও নিচে মাটির অবকাশ। আর এই অবকাশ নিরবিচ্ছিন্ন হলে? অনেক ফাটল চোখে পড়ে। ছোট, বড়, কালো, সাদা— অ্যাসিমটম্যাটিক। আছে; তবু জানান দেয় না, নেই, অথচ আছে। আজ দূরে, উঠোনের ওই পাশে, যেন বার বার চোখ চলে যায়। যেখানে দৈনন্দিন আমি নাইরবির ওই মহিলাকে দেখতে পাই। কোমরে হাত, পরণে এক খানা পুরনো নোংরা সোয়েটার। ধুসর-রঙ্গা। চোখে অদ্ভুত খিদে। রাগ। বিদ্বেষ! যেন প্রচণ্ড খিদেতে কাতরাচ্ছে। ওঁর সামনে লম্বা লাইন। ওঁর পিছনে আরও  অজস্র খিদে। ঠাঁয় একদৃষ্টে। সাফারিং। আমি ওঁর শরীরে ভয়ানক এক আশু-জীবন দেখতে পাই।
আগামী দিনের আরেক প্যানডেমিক, আমাদের দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। ক্ষুদার প্যানডেমিক। অশিক্ষা এবং দারিদ্র্যের প্যানডেমিক।
ফরমার সাউথ ক্যারোলিনার গভর্নর এবং ইউনাইটেড নেশান ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের এক্সিকিউটিভ ডিরেকটার, ডক্টর ডেভিড বেসলে, সিকিউরিটি কাউন্সিল-কে এক বিশেষ বিপদসঙ্কেত দিয়েছেন। বিশ্বের ৩৬-টি দেশে দুর্ভিক্ষ আসছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধর পর; এই পৃথিবী পুনরায়, সব চাইতে গম্ভীর হিউমানিটেরিয়ান-ক্রাইসিস এর সম্মুখীন হতে চলেছে।
উন্নত দেশগুলি চারিদিক দিয়ে আষ্ঠেপৃষ্ঠে আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়বে। যেমন, তার জনাকীর্ণ বস্তি এবং হেলথ সিস্টেমস। যেখানে ডাক্তারের সংখ্যা অত্যন্ত কম। ভেনটিলেটরস, প্রায় নেই বললেই চলে। আফ্রিকার দশটি দেশে, এই পরিস্থিতে, কোনও ভেনটিলেটর নেই।
আমরা মানুষকে নির্দেশ দিই; করোনা ভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষা করতে, সাবান ও জল দিয়ে হাত ধুতে। বিশ্বে, ৫ বিলিওন মানুষের সেলফোন রয়েছে, কিন্তু ৪.৮ বিলিয়ন মানুষের বাড়িতে সাবান ও জল দিয়ে হাত ধোওয়ার উপায় নেই। ইউনাইটেড নেশানের এসটিমেট অনুযায়ী, সারা পৃথিবীতে, প্রতি দশ জনের মধ্যে চার জন মানুষের বাড়িতে, সাবান ও জল দিয়ে হাত ধোওয়ার ব্যাবস্থা নেই। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে, শুধু যে মাস্কের অভাব চলছে এমন নয়, তার এক তৃতীয়াংশ হেলথ-সেন্টারে, সামান্য হাত ধোওয়ার ব্যাবস্থা পর্যন্ত নেই।
আমরা এই অবধি জেনেছি, করোনা-ভাইরাসে অধিকাংশই আক্রান্ত হচ্ছে বয়স্ক মানুষ, মুলত যাদের শরীরে কোনো প্রি-এক্সিস্টিং  মেডিকাল কানডিশান রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের তথ্য অনুসারে, বুরকিনা ফাসও, অ্যানগলা অথবা কেনিয়ায় ২% মানুষের বয়েস ৬৫ ওপরে। হাইতিতে ৫%, ভারতবর্ষে ৬%। পাশাপাশি ইতালিতে ২৩% এবং আমেরিকায় ১৬% মানুষের বয়েস ৬৫-র বেশি। এছাড়া,৭০% আমেরিকান জনসংখ্যা ওভার -ওয়েট। উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় এই সংখ্যা অনেকটাই বেশি।
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে, স্কুল বন্ধ হওয়ার সঙ্গে শিশুদের ভিটামিন-ডি  বিতরণ বন্ধ করা হয়েছে। ভিটামিন-ডি  ছোটোদের সুস্থ শরীর ও চোখের দৃষ্টির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশে ফ্যাকটারি  ওয়ার্কর-দের আয় কমেছে ৭৯%, ড্রাইভারদের ৮০%, বাড়ির কর্মচারীদের ৬৮%, রিকশা চালকের ৭৮%। বহু দেশে স্কুল বন্ধ করা হয়েছে। ফলে; পরিস্থিতি কোনোদিন স্বাভাবিক হলে, বিশেষত মেয়েরা আর কোনওদিন স্কুলে ফিরবে না। ফিরতে দেওয়া হবে না।
ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম জানিয়েছে, যে, এই প্যানডেমিকের পর, দুর্ভিক্ষ বাড়বে দ্বিগুণ। ইনফ্যানট এবং ট ডলার শিশুরা ম্যালনারিশড  থাকলে, তাঁদের মস্তিস্ক ঠিক মতো বাড়তে পারে না। এর থেকে সারা জীবন একটা শিশুর কগনিটিভ ডিফেকটস রয়ে যায়। আগামী বহু শতাব্দী; এরা এবং এদের দেশ, মর্মান্তিক ভাবে পিছিয়ে পড়বে যদি আমরা এই ২০২০ সালের হাঙ্গার-ক্রাইসিস সঠিক ভাবে অ্যাড্রেস না করতে পারি।
এই পর্যন্ত স্ক্রোল করে, পাঠকদের মনে, খুব স্বাভাবিক একটি প্রশ্ন, এই মুহূর্তে উদয় হয়েছে। এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার উপায় তাহলে কী?
আজকাল; কোনও সেলেব্রিটির মৃত্যু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল করেছেন, প্রচুর, বলা বাহুল্য, অধিকাংশ মানুষের প্রবণতা কি? সেই মৃত মানুষটি শ্মশানে পৌঁছনোর আগেই, ফেসবুক পোস্ট। নিজের, সেই মৃত ব্যাক্তির সঙ্গে কোনও এক কালে, কোনওভাবে তোলা একটি ছবি পোস্ট করা। এর ঠিক ভুল আমি বিবেচনা করছি না। কিন্তু, ভাবুন কেন? কেন মানুষ এই সমস্ত করছেন? ভাবুন এর অন্তর্নিহিত অর্থ কী?
আসলে; আমরা নিজদের বিখ্যাত, প্রতিভাবান প্রমান করতে ব্যাস্ত। প্রচণ্ড ব্যাস্ত। এই ধরনের মানুষ লকডাউনে বাড়িতে বন্দি হয়ে অধৈর্য হয়ে পড়ছেন। এর থেকে সমস্যা আগামী দিনে আরও গাঢ় হওয়ার সম্ভবনা।
অথচ, ভেবে দেখুন, অনেক অনেক কিছু করতে পারি আমরা, এই বন্দিদশায়। যারা একা তাঁদের ডিসট্যানসড-কনট্যাকট দিতে পারি। নিজেদের জীবন যাপনে কিছু সুক্ষ বদল ঘটাতে পারি। গোটা একটা বছরের জন্য প্রাইভেট-ট্রাভেল, স্থগিত রাখতে পারি। সব চাইতে জরুরি; বাজারে এসেনশিয়াল এবং নন-এসেনশিয়াল পণ্য ভাগ করা যেতে পারে। আমেরিকার বহু শহরে, গ্রসারির দোকানে, কেবল এসেনশিয়াল খাবার যেমন দুধ, ডিম, রুটি, চাল, আলু, ডাল— এইটুকুই পাওয়া যাচ্ছে। এরও আবার পরিমান মাপা। এই ভাগটা যেমন ভিড় সামলাতে সাহায্য করে, আবার আমি মনে করি, প্রয়োজনে আমাদের মনে সংযমও আনতে পারে। আসলে নন-এসেনশিয়াল পণ্য ভোগ করতে করতে, আমরা জীবনের এসেনশিয়ালসের এসেন্স ভুলতে বসেছি!
প্রাইভেট প্লেজার নয়; মহামারীতে আদতে, কালেকটিভ-সারভাইভাল করা, অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজন। আজ? ম্যান্ডেটরিও বলা যায়।
‘ফড়িঙের ডানাতেও এ জীবন দেয় ডাক
বেঁচে থাক সব্বাই, হাতে হাত রাখা থাক’
সুমনের কথায়, এ পৃথিবী ‘সাড়া দাও’। রাজনীতি, আত্মমগ্নতা, উদাসীনতা— পড়ে থাক আগামীর জন্য। আপাতত হাতে হাত রেখে, ‘সাড়া দাও’। তবেই; দেখা হবে তোমার-আমার, দুর্ভিক্ষের কোনও পরে। জীবাণু-মুক্ত চারিধারে!

Post a Comment

0 Comments