নগরকীর্তন

এক ‘শো’, দুই তারা

দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়


এমন বৃষ্টির দিনে পথে পথে নিজের মৃত্যু মনে পড়ার কথা লিখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। গত দু’দিন টানা ঝড়জল। সদ্য পড়েছে মে মাস। লকডাউন ওঠার কথা ছিল। কিন্তু তিন দফার লকডাউন বেড়ে গেল আবারও। করোনার বাজারে আবিশ্ব প্যানডেমিক আর ইনফোডেমিক (ভুল তথ্যের মাহাসাগরের সমাহার বোঝাতে বাজারে সদ্য এসেছে এই শব্দটি) কিছুটা হতাশ, বিরক্ত, ক্লান্ত আমরা।
এমনই দিনে পর পর দুটি মৃত্যুর খবর আছড়ে পড়ল। মুহূর্তে ভরে গেল ফেসবুকের দেওয়াল কান্নার জলছাপে। জানা গেল, মারা গেছেন, অনন্য অভিনেতা ইরফান খান। তার একদিন কাটতে-না-কাটতেই মারা গেলেন ঋষি কাপুর। এখানেই অবশ্য শেষ না। যাবতীয় নস্টালজিয়ার শেষভাগ ছিন্ন করে মারা গেলেন এরপর চুনী গোস্বামী!
প্রত্যাশিত ভাবেই, রেস্ট-ইন-পিসে উপচে পড়ল ফেসবুক। সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা গেল ইরফান খানকে ঘিরে। এর সহজ কারণ, তাঁর আবিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা। দুই, তাঁর আপাত সহজ সারল্য। তিন, মাত্র পঞ্চাশের কোঠায় চলে যাওয়া। শেষ কবে কারও চলে যাওয়ার খবরে এমন স্টেটাস ছয়লাপ হয়েছে, মনে নেই। চুনী গোস্বামী এবং ঋষি কাপুরকে নিয়েও কম শোক জানালেন না নেটিজনেরা। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে গেলেন ইরফান।
সোশ্যাল ডিস্টেন্স বা কোয়ারেন্টাইনের একঘেয়েমির ডিপ্রেশানে সত্যিই সজোর ধাক্কা মেরেছেন ইরফান তাঁর এই প্রস্থান দিয়ে। এ যেন সেই অনিবার্য বমন—, যা গলার কাছেই আটকেছিল, এই শোকপ্রকাশ তাঁকে হালকা করে দিল। হ্যাঁ, এক রকমের ক্যাথারসিস। যা সমাজকে অবদমন থেকে মুক্তি দিল কান্নায়। তাই আকাশ-পাতাল চূর্ণ করে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল সেই খবর। মিম। স্ক্রিনশট। ইরফানের পরিবার জানালেন, এ শোক আর তাঁদের পরিবারের ব্যক্তিগত পর্যায়ে নেই। রাষ্ট্র ও সমাজের সবার কান্না হয়ে ঝড়ছে আজ তাঁর স্ত্রী ও পুত্রদের চোখের জল।
ঋষি কাপুরের বয়স হয়েছিল নিঃসন্দেহে। অভিনেতা হিসেবে তিনি ইরফানের চেয়ে বড় ইনিংস খেলেছেন। মূলত বলিউডের মূলধারার ছবি থেকে শুরু করে ক্রমশ অন্য রকম ছবিতেও জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। রোম্যান্টিক হিরো থেকে উজ্জ্বল বয়স্ক পার্শ্ব চরিত্রে তাঁর ক্রমশ উত্তরণ তাঁকে অনেকটাই মিথ থেকে বাস্তবের মাটিতে এনে ফেলেছে। কাপুর পরিবারের বাকি অভিনেতাদের থেকে বরাবরই ফ্ল্যামবয়েন্ট তিনি। নাগাড়ে প্রেম বা মদ্যপান; তারকার সমস্ত অভ্যাসে এডভেঞ্চারে জড়িয়েছেন তিনি অনেক। তাই তাঁর মারা যাওয়ার খবরে ছড়িয়ে পড়তে দেরি করেনি সুকীর্তির পাশাপাশি গসিপও।
প্রশ্ন উঠেছে, একজন এহেন ফ্ল্যামবয়েন্টকে নিয়ে এত নাচানাচির কি আছে! অন্যদিকে যদিও তাঁর ভক্তরা জানিয়েছেন, এ সত্যিই হাহাকারের মূহুর্ত। ফিরে ফিরে মিডিয়ায় ছড়িয়েছে ‘ববি’, ‘মেরা নাম জোকার’ বা হালের ‘১০২ নট আউট’-এর নানা দৃশ্য। শেষ ভিডিও নামের একটি ভাইরাল ভিডিওতে দেখা গেছে অল্পবয়সী এক ফ্যানের গান শুনে আশীর্বাদ করছেন তিনি। বলছেন, ‘আরও পরিশ্রম কর। বড়ো হও। মানুষ হও।’
২০১৩-র ‘ডি-ডে’র একটি  দৃশ্যর মিমে দেখা গেছে গাড়ির ব্যকসিটে তিনি বসে আছেন স্বয়ং ঋষি  কাপুরের সাথে। এ ছবিতে দুজনেই একসাথে কাজ করেছিলেন। দুজনেই যেন-বা এই ইমেজে স্বর্গ আরোহন করছেন। পরে প্রচারিত আরেকটি মিমে দেখা যাচ্ছে, স্বর্গে স্বয়ং সত্যজিৎ তাঁদের স্বাগত জানাচ্ছেন। মন্দ্রস্বরে স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই জানাচ্ছেন, ‘তোমরা এসে গেছো? চলো তাহলে একটা ছবি বানানো যাক একসাথে!’ ইরফান তাঁকে মানিকদা বলে সম্বোধন করছেন...।
উল্লেখ্য, পরপর দুই এমন জনপ্রিয় তারকার মৃত্যুর পরে পরেই এসে গেছে সত্যজিৎ রায়ের শততম জন্মদিন। কাজেই গণ-শোক প্রকাশের পরেই আমরা আশাতেও পৌঁছাতে চেয়েছি। সে কথা জানাতেই, ফিরে ফিরে আসছে ইরফানের ছবির একটি অংশ। তাতে লেখা, ‘সবসময়ে পিঠে ব্যগ নিয়ে প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে পড়ো। কে জানে, কাল খুব দেরি হয়ে যাবে না তো!’
আসলে ইরফান ঠিক যতটা স্মার্ট আর ক্যাজুয়াল ভাবে ভক্তের মনে জায়গা করেছেন, ঋষি ঠিক ততটাই ছেলেবেলার প্রেমিক-প্রেমিক মিষ্টি এক কিশোর ইমেজ নিয়ে আজও জাগরূক মানুষের মনে। একজনের অভিনয়ের আবেদন বুদ্ধির কাছে, অন্যজনের জনপ্রিয়তার কাছে। পরের জীবনে ঋষি সেই ‘ছেলেমানুষ’ এডোলেসেন ইমেজ ভেঙেছেন ঠিকই, কিন্তু, আজ তাঁর চলে যাওয়ার দিনে কিন্তু ফিরে ফিরে এসেছে তার ক’টা চোখ-খয়েরি চুল আর লাল গালের কিশোর বেলা। সে কখনও অবাক চোখে দেখছে স্বল্পবসনা ডিম্পলকে তো কখনও দেখছে গাছের আড়াল থেকে জলকেলি করে উঠে আসা মিস সিমি গারেওয়ালকে। বয়োসন্ধির পাপে জীর্ণ হচ্ছে ৭০-৮০-র প্রজন্ম। যে প্রজন্মর কোনও কিশোরবেলা ছিল না। কারণ রাস্তায় গুলি চলছিল। আর, ভিয়েতনামে কিশোররা বন্দুক হাতে লড়ছিল আমেরিকার বিরুদ্ধে। সত্যজিৎ এর ছবিতে তেমনই তরুণ মুখে চে গেভারাকে দেখতে পেয়ে চমকে ওঠে তাই। অন্যত্র সে পাথর ছুড়ে ম্যানিকুইন ভেঙেও দেয় রাগে।
এই রাগ, এই প্রতিবাদের আড়ালে ঢেকে গেছিল লাল গালের সেই কিশোর। উত্তাল ৭০-র দশকে তাই ঋষি আমাদের পালানোর শান্তি দেন। দেন, বাতায়ন। সে জানলা দিয়ে জনপ্রিয় বা পপুলার অভিনেতার হাওয়া আসে। অনেকেই সে প্রজন্মে নকল করতে শুরু করে তাকে। বাতাসে বারুদের গন্ধ খানিক ফিকে হয়ে আসে ‘ববি’র জনপ্রিয়তার আড়ালে।
এর ঠিক উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আছেন অবশ্য ইরফান। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ অর্থময় চোখ আর সংলাপহীন বৌদ্ধিক অভিনয়ের আবেদন নিয়ে। ছেঁড়া ডেনিম, এলোমেলো চুল, অসংলগ্ন কথাবার্তা, রুক্ষ চুল ও দাড়ি মিলে তাঁকে কখনও ‘হিরো’ মনে হয় না৷ কাঠখোট্টা বাস্তবটা বারবার চোখ ঘষে দেয়। বেরিয়ে যায় ফুস করে যাবতীয় রোমান্স। মনে পড়ে যায়, আমরা আছি অনুরাগ কাশ্যপের মুম্বইতে। এখানে ইরফান-নওয়াজরাই আজ ‘নায়ক’। কারণ সময় বদলেছে৷ ডিজিটাল উত্তর বামপন্থার এই দুনিয়ায়, এক্সট্রিম ক্যাপিট্যালিজম তথা মৌলবাদী ধাক্কা তদুপরী আবিশ্ব মহামারীর ধাক্কায় সকলেই ধ্বস্ত-ক্লান্ত-বিষণ্ণ। সকলেই সাইকোটিক-ডিপ্রেসড-ডিস্টোপিক। পূর্ণিমার চাঁদ যেহেতু আজ পরিযায়ী শ্রমিকের চোখে ঝলসানো রুটি, তাই তার প্রতিফলনের ছায়া পড়ে আমাদের মুখে। আমরা ভাবতে থাকি একদিন ঠিক আমরা মুক্তি পাব। অনুমোদিত স্বাধীনতায় মাস্ক লাগিয়ে নিই। স্যানিটাইজ করি। গান গাই-ছবি আঁকি-ভিডিও কলে বন্ধুকে জানাই, কেমন আছিস আর আমেরিকা চিনকে হুমকি দেয়, ছড়িয়ে দেয় মিথ্যে কেচ্ছা, যুদ্ধভয়ে মাঝরাতে কেঁদে ওঠে কুকুরের ভয়ার্ত গর্জন! আমাদের ভয় করে। ভয় করে। তাই একে অপরকে আঁকড়ে ধরি যত রাজনীতি-ধনতন্ত্র আমাদের আলাদা করে দেয়, তত আঁকড়ে ধরতে চাই, আর ইরফান আমাদের দেখে হাসতে থাকেন হাহা। ব্যঙ্গের হাসি। যার মানে, তোদের কে বাঁচাবে রে? তোরা এ গ্রহকে কম পুড়িয়েছিস বা*! আসছে এবার, তোদের দেবে... প্রস্তুত হ...।
আসলে, ইরফান আমাদের না-বলা ভাবের আত্মায় হাত রেখেছিলেন, ঠিক পাশের মানুষটি হয়ে... তাই তাঁর চলে যাওয়াও আমাদের সন্দেহ হয়! ব্যপারটা হঠাৎ করোনার বাজারে তার অভিনয়ের মতোই আরেকটা চমক নয় তো! ঋষি কাপুরের মৃত্যু যতটা স্বাভাবিক মনে হয়, ততটাই গিমিক লাগে ইরফানের প্রস্থান! এ যেন মরিচীকা যা ঘাম ও অশ্রুসুলভ ঋষি কাপুরের পাশে বায়বীয় বাষ্প। ইরফানই যেন বনে আগুন ধরালেন, রেস্ট-ইন-পিস লেখা তথ্যের আগুন ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মতোই ঋষির চলে যাওয়ার খবরেও। জলের বেগ বেড়ে গেল বাইরে। আজ থামবে না আর! তাহলে, এই আইসোলেশানের বাজারে কি আমাদের তথ্যের আগুন দিয়েই জ্বলবে তবে সেলিব্রিটি মৃত্যুর দাউদাউ; বিদায়, দুই ‘বর্ন এক্টর’। অপলক দেখব— এক ‘শো’— যেখানে পাশাপাশি কথা বলছেন দুই তারা!

Post a Comment

1 Comments