ধারাবাহিক উপন্যাস

নেইবাড়ির মেয়েরা

মেয়েবেলা হারিয়ে গেছে অন্ধকারে। গোল্লাছুটের দুপুর এখন দিগন্তের পাখি। একলা আঁধারে মুখ নেমেছে পথের হাওয়ায়। বাহির থেকে ঘরে ফেরার অশ্রুতপূর্ব-কথার আখ্যান। লিখছেন অঙ্কন রায়


চোদ্দো
এ ভাবেই কাটে আমাদের দিন। নতুন নতুন মেয়েদের নতুন নতুন গল্প এসে জুড়ে যায় আলোকবর্তিকার দেওয়ালে। অনেক কষ্ট, অনেক কান্না লেগে থাকে সেই দেওয়ালের গায়ে। আবার আমাদের নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার আনন্দও আমাদের দিয়ে কত নতুন নতুন কাজ করিয়ে নেয়। এ ভাবেই বসন্ত পেরিয়ে গ্রীষ্ম আসে... আসে শরৎ... আসে শীত...।
শীতের দিন শুরু হবে হবে। এবার আমাদের আলোকবর্তিকা'র মেয়েদের তৈরী হাতের কাজ আর আচার, মোরব্বা ইত্যাদি নিয়ে পৌষমেলায় স্টল দেবার কথা হচ্ছে। কি আনন্দ যে হচ্ছে আমাদের। মেয়েরা দারুণ উত্তেজিত। প্রবল উৎসাহ নিয়ে নতুন নতুন ব্যাগ, কুশন কভার, কাঁথা স্টিচের কাজ করা গায়ের চাদর সব তৈরী করে করে স্টক বাড়িয়ে চলেছে মিনটি, জবা, আশমা, চাঁদনীরা। ওদিকে ভানুদাদা মাঝে মাঝে এসে আমাদের নতুন নতুন শীতের গান শিখিয়ে যাচ্ছেন মেলায় ছোট ছোট অনুষ্ঠানে দল বেঁধে গাওয়ার জন্য। আমাদের এবার সত্যিকারের মুক্তির স্বাদ। পৌষমেলা আমাদের জীবনকে নতুন আনন্দের তরঙ্গে বইয়ে নিয়ে যেতে চলেছে।...
ঠিক যেদিন মেলা শুরু হবে, অর্থাৎ উদ্বোধনের দিন, আমাদের আলোকবর্তিকায় নতুন একটি মেয়ে এল। আমি সেই সময় বাড়িতে ছিলাম না। ভানুদাদা আমায় আর আরও কয়েকজনকে, যারা ভালো গান গাইতে পারে, তাদের নিয়ে গিয়েছিলেন মেলার মাঠে। সেখানে আমাদের হোমের যে স্টল হয়েছে, সেই স্টলের সামনে আমরা কয়েকজন মিলে সমবেত গান গাইলাম। উদ্বোধনী সঙ্গীত। 'আনন্দেরই সাগর হতে এসেছে আজ বান... দাঁড় ধ'রে আজ বোস রে সবাই, টান রে সবাই টান...।' অপূর্ব গান। রবি ঠাকুরের। এই গানের পরের অংশ 'বোঝা যত বোঝাই করি করব রে পার দুখের তরী... ঢেউয়ের পরে ধ'রব পারি যায় যদি যাক প্রাণ...' গাইতে গাইতে মনের ভিতরে এক অন্য শক্তির সঞ্চার ঘটে। উদ্দিপ্ত হই ভানুদাদাকে দেখে। উনিও আমাদের সঙ্গে গাইতে থাকেন আর ওঁর চোখে মুখে এক অনন্য দীপ্তি ফুটে বেরোয়।
'কে ডাকে রে পিছন হতে, কে করে রে মানা... ভয়ের কথা কে বলে আজ? ভয় আছে সব জানা...' সেই জানা ভয়কে আবার নতুন করে জানতে শুরু করলাম ওই নতুন মেয়েটিকে ঘিরে। মেলায় গান গেয়ে আমি তখনকার মত ফিরে এসেছিলাম আলোকবর্তিকায়। আর ঘরে ঢুকেই দেখি আমার খাটের একপাশে গুটিশুটি মেরে বসে আছে অচেনা একটি মেয়ে। দুচোখ চেয়ে জুলজুল ক'রে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মালবিকা মাসি পিছন থেকে এসে আমার কানের কাছে বলে গেলেন, 'এই মেয়েটাকে দেখে রাখিস অহনা। আমাদের নতুন সদস্য। কয়েক ঘন্টা হল এসেছে কিন্তু একটাও কথা বলাতে পারিনি। দেখ যদি বন্ধুত্ব করতে পারিস।'...
অতসী আমার সঙ্গে কথা বলল তিন চারদিনের চেষ্টায়। ওকে আমার সঙ্গে সঙ্গে রাখি। নিজে থেকে কিছু না বললে জোর করি না জানার জন্য। শুধু কাঁদে আর মাঝে মাঝে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। আমি এটা বুঝতে পারছি ও একটু একটু করে আমায় ভালোবাসতে শুরু করেছে। একটু আধটু নির্ভরতাও খুঁজছে আমার কাছে।
একা থাকলেই আমি গুনগুন করে ভানুদাদার শেখানো গানগুলো গাইতে থাকি। অতসী এখন যেহেতু আমার সঙ্গে সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকে, তাই ওর কানেও ঢোকে আমার গানের সুরগুলো। এটা ওর জন্য একটা বড় অষুধ হয়ে দেখা দিল। এই রবি ঠাকুরের গান। আমাদের কাউন্সিলিং এর জন্য সাপ্তাহিক ভিজিটে আসেন যে ডাক্তার দিদি, তিনিও সেদিন এসে বলে গিয়েছিলেন, 'ওকে জোর কোরো না। নিজেই একদিন স্বাভাবিক হবে। আর শুধু ওর কানের কাছে শান্ত সুরের মিষ্টি মিষ্টি গান গাইবে। ওকে শোনাবে। তাতে দেখবে ও খুব তাড়াতাড়ি সহজ হতে পেরেছে।'
সেই সুর শুনতে শুনতে সত্যিই অতসী একদিন সহজ হল। তবে সবার কাছে প্রথমেই নয়। ওর স্বাভাবিক রাগ, ক্ষোভ, ভালোবাসার কথা ও আমায় উজার ক'রে দিতে চাইলো। আমিও দু'কান ভ'রে নিয়ে নিলাম ওর সব কিছু। ওর আগুন নিয়ে খেলার গল্প। ওর জীবনপ্রবাহ।...

পনেরো
ছোট্ট একটা ঘুপচি ঘরে দিন কাটে অতসীর। তবে তার দিনগুলো সব রাতের মত। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। কত আর বয়স ওর। বড়জোর তেরো কি চোদ্দ। এই বয়সেই ও জীবনের বিচ্ছিরি আর পচা দিকগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছে। পরিচিত হয়েছে ঠিক কিন্তু অভ্যস্ত হয়নি। এখনও ওর বাড়ির জন্য মন কাঁদে। এখনও সেই ওর প্রাণপ্রিয় গাঁ নগরহাভেলি'র কথা ভেবে ভিতরটা হু হু করে ওঠে। কোথায় গেল সব! কোথায় হারিয়ে গেল ওর বাবা... মা... পাড়ার বন্ধুরা... স্কুলের দিদিমনিরা... মাস্টারমশাইরা...! ওর প্রিয় সঙ্গী ভুলো কুকুরটা...!
নগরহাভেলি একসময় নাকি বড় শহর ছিল। শহরের মাঝখানে ছিল বড় সড় এক প্রাসাদ। সেই প্রাসাদে থাকতেন রাজা বীরেশ রায়। অনেক অনেক সম্পত্তি ছিল তাঁর। আর ছিল দোর্দণ্ড প্রতাপ। এসব কথা দাদুর মুখে শুনতো অতসী। ও নিজের চোখে অবশ্য দেখত একটা পোড়ো বাড়ির ভগ্নস্তুপ, যেটাই কিনা এক সময় ছিল 'নগরহাভেলি'।
কালের প্রবাহে হাভেলির আশপাশ থেকে সরে যেতে যেতে নগর চলে গেল অনেকটা দূরে...। রাজাদের প্রতাপ, গরিমা এসবও থাকলো না। তাদের পরের প্রজন্ম দেশ বিদেশে ছড়িয়ে গেল। ক্রমশ পোড়ো হতে লাগলো প্রাসাদটি আর তার চারদিকে কিছু ছোটখাট বসতিই শুধু রয়ে গেল, আর নগর থেকে গাঁ হয়ে গেলেও জায়গাটার নাম থেকে গেল 'নগরহাভেলি'।
অতসী স্কুলে যায় আর পাঁচটা ছোট ছেলেমেয়ের মতই কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে। তবে ওদের জলের বোতল সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ নেই। স্কুলের চাপাকল চালিয়ে জল পেয়ে যেত এন্তার। সে জলের স্বাদ ছিল ভীষণ মিষ্টি।
একদিন স্কুলের চাপাকল খারাপ হয়ে গেল। মিস্ত্রি এসে ঠিক করতে করতে বেলা গড়িয়ে যায়। এদিকে অতসী আর ওর দুতিনজন বন্ধু জলতেষ্টার কারণে দিদিমনির কাছে অনুমতি নিয়ে রেখেছিল বাইরে বেরিয়ে কারো বাড়ি থেকে জল পান করে আসার। ওদের স্কুলটা তো বাড়ি থেকে অনেক দূরে, সেই কোন কুরুয়া গ্রামের পাহাড়তলিতে। সেখানে কয়েক ঘর মানুষের মোটে বাস, আর এই স্কুল। তো দিদিমনির অনুমতি মত অতসী, তিনকলি, মায়া'রা বেরিয়ে পড়েছিল স্কুলের গেট দিয়ে। এই স্কুলের সবচেয়ে বড় দিদি ওরা। ক্লাস এইটে পড়ে। আর এখানে স্কুলের সর্বোচ্চ ক্লাস এই ক্লাস এইট টাই।
স্কুল থেকে বেরিয়ে এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে ওরা চলে আসে অনেকটা দূরে। পাঁচমিনারের ভাঙা শিবমন্দিরের কাছে। সচরাচর এই দিকে ওরা কোনওদিন আসেনি। তবে শুনেছে এসব তল্লাটে ভয়ঙ্কর কিছু লোকজনের বাস। তারা আসলে তান্ত্রিক। ছোট ছেলে মেয়েদের একবার ধরে ফেলতে পারলে আর ছাড়ে না ওরা। নানা রকম মন্ত্র তন্ত্র দিয়ে বশ করে নিজেদের কাছে রেখে দেয় বা অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেয় যেখান থেকে আর বাড়ি ফেরা যায় না।
তিনকলি হঠাৎ চারিদিকের নিস্তব্ধতা দেখে ভয় পেয়ে বলল, 'এই, আমরা এখানে চলে এলাম কি ভাবে? চল চল... এই জায়গাটার দারুণ বদনাম।'...
'কি বললি খুকি? দারুণ বদনাম? কেন রে  কেন রে?'
ওরা তিনজনই পিছন ফিরে দেখে এক লাল কাপড় পরা জটাধারী সাধু ওদের দিকে তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। শেষের কথাটা ওই সাধুরই। ওরা তিন মেয়ে একেবারে কেঁপে গেল ভিতর থেকে। ওদের মুখে কথা সরছে না। তার মধ্যেই অতসী একটু সাহস আনার চেষ্টা করে বলল, 'আমরা ভুল করে চলে এসেছি বাবা... আমাদের ছেড়ে দিন বাবা... আর কখনও আসবো না...'
সাধুবাবা হা হা করে হেসে উঠে বলছে, 'জলদি পালাও বাচ্চারা। আর কিছু সময় থাকলেই তোমাদের আমি ভেড়া বানিয়ে দিব।'
অতসীরা পড়ি কি মরি করে ছুটে পালাতে পালাতে পিছনে শুনতে পায় ওই ভয়ানক দেখতে সাধুটার অট্টহাসিতে কেঁপে উঠছে সমস্ত অঞ্চলটা।...

ষোলো
বাড়ির সামনে একদিন বিকেলে খেলছিল অতসী। ওর খেলার সঙ্গী প্রিয় কুকুর ভুলো আর পাড়ার ছোট ছোট বাচ্চারা। বাচ্চাগুলো অতসীদিদি বলতে অজ্ঞান। দারুণ আদরের দিদি ওদের। কুট্টি বলে একটা ছেলে হঠাৎ ডেকে বলল অতসীকে, 'দিদি দেখো, ওই লোকটা তোমায় ডাকছে। 'অতসী তাকিয়ে দেখে দূরে দাঁড়িয়ে আছে সাদা ধুতি আর জামা পরা রোগা মত একটা লোক। অতসীকে লোকটা হাতছানি দিয়ে ডাকছে। অতসী শুনবে কি শুনবেনা করেও এড়াতে পারলোনা লোকটাকে। কি জানি কেন কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, 'আমায় ডাকছেন? কি বলবেন?'
লোকটা দুতিন পা এগিয়ে এসে বলল, 'তোমার নাম তো অতসী? তোমায় আমাদের গুরুদেব একবার দেখা করতে বলেছেন। কাল সকালে যখন ইস্কুল যাবে, তার আগেই পাঁচমিনারের মন্দিরে ঘুরে যেয়ো। কেমন?'
অতসী ওর কথা শুনে তেমন একটা ভয় পেল না এবার। আরও এগিয়ে এসে দাঁড়াল লোকটার মুখোমুখি। তারপর বলল, 'কেন? আমার সঙ্গে আপনাদের কি দরকার? আর আমার নামটাই বা আপনি জানলেন কি করে?'
লোকটা অবাক চোখে অতসীর মুখের দিকে চেয়ে বলল, 'এইটুকু মেয়ে এই ভাবে কথা বলছ? জানো আমাদের গুরুদেব একজন ত্রিকালজ্ঞ পন্ডিত। চোখ বন্ধ করলেই সব কিছু দেখতে পান। জানতে পারেন। সেদিন তোমরা আমাদের ডেরার দিকে গিয়েছিলে বলেই তো গুরুদেব তোমায় দেখে বুঝে গিয়েছিলেন তোমার বিপদ আসছে। কঠিন বিপদ। তোমার বাবা আর মা দুজনেরই মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। তুমি যদি ওদের বাঁচাতে চাও তাহলে আমার কথা শুনে কাল সকালেই যাবে ওখানে। না হলে গুরুদেবের পক্ষে আর ওদের বাঁচানো সম্ভব হবে না। আর শোনো এসব কথা বাড়িতে জানালে ওদের আরও তাড়াতাড়ি মৃত্যু হবে। এবার যা ইচ্ছে হয় কোরো। আমি চললাম।'
লোকটা পিছন ফিরে দ্রুত পায়ে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। বাবা আর মাকে নিয়ে বলা কথাটার জন্য মনটা চিন্তায় ভরে উঠলো অতসীর। কি করবে না করবে বুঝে উঠতে পারছে না। শেষমেশ যাওয়াটাই ঠিক করলো। বাবা আর মা'র জীবনের মূল্য দিতে তাকে তো যেতেই হবে!...
এক একজনের জীবন যেন বাস্তবের দুনিয়া ছাড়িয়ে হয়ে যায় একেবারে অন্য রকম। অতসীর কথা শুনে লিখতে লিখতে আমার তেমনই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ও যেন এক রূপকথার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসেছে, যেখানে ওর চারিদিকে ঘিরে থাকতো শুধুই রাক্ষস আর খোক্কস।
সাধুবাবার ডেরায় গিয়ে বাবা মাকে বাঁচানোর উপায় বের করে আনতে যাওয়ার দিনটাই যে অতসীর জীবনের শেষ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা হবে, তা কি আর ও জানতো! যদি জানতো...
অতসী সাধুবাবার ডেরায় পৌঁছতেই সেই লাল কাপড়ের জটাধারী সাধু ওকে নিয়ে যা যা করতে শুরু করলো, তা লিখতে আমার কলম সরছে না। তবু কিছুটা চেষ্টা করছি। ওই বুড়ো লোকটা তিন চারটে লোকের সাহায্যে ওইটুকু কিশোরী মেয়েকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে গরম জলে স্নান করিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে রীতিমত সম্ভোগ করেছে। মেয়েটা বাকহারা হয়ে গিয়েছিল সেই সময়। ওর শরীরের চেয়েও মনের ধাক্কাটা প্রবল হয়ে উঠেছিল। কোনো শক্তি ছিল না ওখান থেকে উঠে বেরিয়ে আসার। আর তারপর...
তারপর কখন যেন অচৈতন্য অতসীকে নিয়ে ওই সাধুবাবা আর তার সাগরেদরা ওই পাঁচমিনারের ভাঙা শিবমন্দিরের ঠিকানা ছেড়ে কোনও এক অজানা দেশে বা অঞ্চলে পাড়ি দিল।
এরপরের অনেক কটা দিনই অতসী আধো তন্দ্রা আধো জাগরণের মধ্যে থাকতো। কোনও এক অজানা জায়গার অচেনা কুঠুরীতে দিনের পর দিন ওর কেটে যেত বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন লোকের অত্যাচারে। ও তবু মাঝে মাঝে ভাবতো বাবা মা কি জানেন ও কোথায় আছে? ওঁরা কি খোঁজ করেছেন ওর? ওঁরা কি করছেন এখন?...
ভানুদাদা আমাদের শেখাচ্ছেন মালকোষ রাগে 'আনন্দধারা বহিছে ভুবনে...'। অপূর্ব সুরমূর্ছনায় ভরে উঠছে আমাদের আলোকবর্তিকা। সৌভাগ্যক্রমে অসমের এক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উদ্ধার হওয়া অতসী বাউড়ি আমাদের কাছে এসে পড়েছে। আমাদের এই আলোকিত হোমের অদূরেই আছে রবি কবির আশ্রম। তার প্রভাব আমাদের হোমের গায়ে সর্বত্র। আমরা পেয়েছি ভানুদাদার মত মানুষকে, যাঁর সঙ্গে সদা সর্বদা একাকার হয়ে আছে রবি ঠাকুরের গান। আমরা আলোকবর্তিকা'র পুরোনো মেয়েরা যখন যে পরিস্থিতিতে থাকি, রবি কবির গানের লাইনে খুঁজে পাই নিজেকে সামাল দেওয়ার মন্ত্র। আজ প্রথমবার আমাদের সঙ্গে গানের ক্লাসে বসে অতসী মন দিয়ে শুনছিলো ভানুদাদার ভরাট গলায় এই গানের শেষের পংক্তি কটা। 'চারিদিকে দেখ চাহি হৃদয় প্রসারী... ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি... প্রেম ভরিয়া লহ শূন্য জীবনে...
এই প্রেম ভরে নেবার পথেই এক পা এগোলো আমাদের নতুন সহযাত্রী অতসী বাউড়ি।...


সতেরো
আজ সকালে আশমা’র মা এসেছেন। কি সুন্দর যে দেখতে কাকিমাকে... আমরা হাঁ করে তাকিয়েই আছি ওঁর মুখের দিকে। আশমা আজ ভীষণ খুশি। মাকে নিয়ে আলোকবর্তিকার প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা আলাদা ভাবে পরিচয় করিয়েছে।
তারপর মাকে খাওয়াবে বলে স্পেশাল বকফুলের বড়া তৈরি করেছে মালবিকা মাসির সাহায্য নিয়ে। মাসিও উৎসাহ নিয়ে আজ ভাল ভাল খাবার রান্না করিয়েছেন হোমের সব মেয়েদের জন্য। মাংস হয়েছে, ধোকার ডালনা আর সোনামুগের ডাল, সঙ্গে ঝিরঝিরে আলুভাজা। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়ে বসলাম গল্প করতে। আজ রবিবার। ছুটির দিন। তাই আমাদের আজ স্কুল না থাকায় সারাটা দিন আশমা’র সঙ্গে একসঙ্গে কাটাতে পারলাম। আশমা চলে যাবে আজ ওর মা’র সঙ্গে। শুরু হবে ওর নতুন জীবন। আমাদের একটু কষ্ট হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ও যে বাড়ি ফিরতে পারছে, মা’র সঙ্গে আবার থাকতে পারছে, সেটা ভেবে আনন্দই হচ্ছে বেশি। মন খারাপটা তো ওর সুস্থ সুন্দর জীবন গড়ে ওঠায় অন্তরায় হতে পারে না।
বিকেলে ভানুদাদা এলেন। আশমা’র মা’র সঙ্গে আলাপ করলেন। তারপর বললেন, ‘চলো, আজ একটা খুশির দিন উদ্‌যাপন করি। আশমা’র জন্য একসঙ্গে গান হোক। বসন্তের গান। আর ও চলে গেলেও মাঝে মাঝে তো আসবে আমাদের কাছে। অনুষ্ঠান হলে গান করবে। কি রে, করবি না আশমা?’
আশমা আপ্লুত স্বরে বলছে, ‘হ্যাঁ দাদা, নিশ্চয়ই আসব। সবাই মিলে গান গাইব। আনন্দ করব। আজ আমার জন্য তোমরা কোন গানটা করবে বলি?’
‘বল বল, যেটা তোর ইচ্ছে হচ্ছে বল। সবাই মিলে করব। আজ তো তোরই দিন।’ ভানুদাদা বললেন। তারপর ওর পছন্দের গান ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ’ গাইলাম আমরা সবাই মিলে। আমাদের গান শুনে আশমা’র মা আমাদের দিকে উদ্‌ভাসিত মুখে তাকিয়ে আছেন। ওঁর ভেতরটাও বুঝি উদ্দীপ্ত হয়ে উঠছে রবি ঠাকুরের গানে... তার সুরের মূর্ছনায়...
গান শেষ হতে কাকিমা বললেন, ‘আমি একটা ইচ্ছের কথা বলি? আমি তো আশমাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি না। যদি প্রতি সপ্তাহে গানের ক্লাসে যোগ দিতে আসি, যদি আমি সুদ্ধ শিখি ভানুবাবুর কাছে, তোমাদের কি আপত্তি থাকবে?’
সবাই খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল। ভানুদাদা হেসে বললেন, ‘এটা তো দারুণ ইচ্ছে। আপনি আশমাকে নিয়ে অবশ্যই আসবেন। আমাদের যোগাযোগ অটুট থাকবে। আমি জানি হোম কর্তৃপক্ষ কখনঐ আপত্তি জানাবেন না এই ব্যবস্থায়। কারণ ওঁদের ভালবাসা আর আন্তরিকতা মিলেমিশেই এই আলোকবর্তিকার জন্ম। সুতরাং...’
সুতরাং আবার আমরা গান ধরলাম। আর কয়েকদিন পরেই আসছে বসন্তোৎসব। তাই আমরা সমবেত উচ্চারণে ধরলাম আমাদের প্রিয় বসন্তের গান ‘আজি দখিনদুয়ার খোলা... এসো হে... এসো হে... এসো হে... আমার বসন্ত এসো...!’
একটা অন্ধকারের জীবন কাটাতো আশমা তার মা’র সঙ্গে। বাবা ছিল ভীষণ ভীষণই খারাপ মানুষ। যখন ও খুব ছোট, ওর মনে আছে মা’র হাত দুটি দড়ি দিয়ে পিছমোড়া ক’রে বেঁধে বাবা মাকে সরু লিক্‌লিকে একটা বেত দিয়ে পায়ে, পীঠে, হাতের চেটোয় সব খানে মারছে আর বলছে, ‘আমার কাজে বাধা দিলে জানিস আমি কি করতে পারি? পাঁচটা লোককে তোর ঘরে ঢুকিয়ে দেব তারপর বাইরে থেকে তালা দিয়ে দেব। দেখবি তখন কি মজাটা হয়।’
মা কেঁদে চলেছেন আর কেঁদেই চলেছেন। কোনও কথার উত্তর দেবার ক্ষমতা নেই তার। আর ঐ একরত্তি মেয়েটা থামের আড়ালে লুকিয়ে ঠক্‌ ঠক্‌ করে কাঁপছে। ও তো জানে মা কোনও অন্যায় করেনি। শুধু বাবা রোজ রাতে মাকে বকে মেরে পাশের ঘরে একজন দু’জন পিসিদের নিয়ে ঢুকে পড়ে। ঐ পিসিগুলো একদম ভাল না। সারারাত ওদের হি হি হাসি শুনতে শুনতে মা চোখের জল ফেলে আর আশমাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে। ও চোখ বুজে থাকে কিন্তু ঘুমোয় না। ওরও মা’র জন্য খুব কান্না পায়। খুব... খুব...।
মা-ই একদিন ওকে ঐ বাড়ির খারাপ পরিবেশ থেকে বাঁচানোর ঠিকানা পেয়ে ওকে নিয়ে এসেছিলেন আলোকবর্তিকায়। আর আজ মেয়েকে নিয়ে ফিরে গেলেন তাঁর নিজের বাড়িতে। কারণ মাস খানেক হল আশমা’র বাবা ইহলোক ত্যাগ করেছে। মা একটি স্বনির্ভর গোষ্টিতে কাজ পেয়েছেন। সসম্মানে কাজ করে মেয়েকে এবার নিজের হাতে বড় করে তুলতে পারবেন।
সত্যি, কোনও কোনও মৃত্যু মানুষের জীবনে শুভসময়ের সূচনা এনে দিয়ে যায়। খুব খুব ভাল থাকিস আমাদের প্রিয় বন্ধু আশমা। আমাদের আদরের বোন আশমা।


(ক্রমশ...)
অঙ্কন : অর্চিতা মুন্সী

Post a Comment

0 Comments