লকডাউনের দিনলিপি

ভালো থাকা নয়, ভুলে থাকা

ধনঞ্জয় ঘোষাল


সামাজিক দূরত্বের কথা শুনে আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল প্যারিসের তাহলে কী হবে? যে শহরটাকে ঠিক দশ বছর আগে দেখেছি এবং প্রথম দেখাতেই যে-শহরকে প্রেম ও চুমুর শহর বলে মনে হয়েছিল, প্রতি মুহূর্তে যেখানে আলিঙ্গন ও চুমুর হন্ম হয়, সে শহরে চুম্বনের সিগনেচার কি মিলিয়ে যাবে? প্যারিসের প্রেম পড়ে থাকবে বিষণ্ণ বেহালার মতো? ধূসর নিস্তব্ধতায় ডুবে যাবে মঁমার্ত, ল্যুভর, আইফেল অথবা নাইট-ক্লাব? মনটা ভারী হয়ে উঠেছিল খুব। আমাদের এখানে ঠিক যে-সময়ে লকডাউন শুরু হল, সেই সময়টায় ইতালি এপিসেন্টার হয়ে উঠেছে মহামারীর, মৃত্যুর খবর আসছে স্পেন, ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইতালি, আমেরিকা থেকে।
লকডাউনের খবর শুনে চাল, ডাল, আটা, মুড়ি, ম্যাগী, মদ সংগ্রহ করার সঙ্গে সঙ্গে কি বই সংগ্রহ করেছি? না, করিনি, করতে পারিনি। তারমানে বই এখনো বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠেনি নিজেই বুঝতে পারলাম। অথচ বই নিয়েই আমাদের কারবার, বই লেখা নিয়েই নিন্দে-মন্দ, গালি-গালাজের সঙ্গে কিঞ্চিত খ্যাতি ও যশ। অথচ এই অখণ্ড অবসরে বই ছাড়া উপায় নেই চলার। প্রথম দিকে লকডাউনের বিষয়টি ভালই লাগছিল অনেকের, কিন্তু ধীরে ধীরে ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর খবরে শুনে সত্যি বলতে কি বন্ধুদের কথা কমে গিয়েছিল, একটা হতাশা, একটা আতঙ্ক তাড়া করে ফিরছিল। কার কখন মৃত্যু হবে তা জানা নেই বলেই মৃত্যু নিয়ে আমার ভাবনাটা কম। মন এক প্রকার প্রস্তুত হয়ে উঠেছে যে, জীবনে অপরিহার্য বলে আর কিচু নেই। এখন সবাই আমরা আয়ুর ভিক্ষুক। তবে না পড়া প্রয়োজনীয় বই-এর তালিকাটাও আমার দীর্ঘ। সংগ্রহে থাকা সেই বইগুলো এখন আমার সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার সঙ্গী। পড়েও চলেছি এক নাগাড়ে।
লকডাউনের বাড়তি পাওনা ফেসবুকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভাল ভাল লাইভ। আসলে আমরা কেউ এখন ভালো নেই। ভাল-খারাপ অজস্র ইউটিউব স্রোতের মতো ভাসছে, এই সব করে ভুলে থাকার একটা চেষ্টা বলেই মনে হয়েছে আমার।
লকডাউন আসলে একটা আয়না। নিজেকে দেখা এবং অন্যকেও দেখে নেওয়া। একটা আত্মশুদ্ধির উপায়, ত্রুটি সরিয়ে ফেলার চেষ্টাও বটে। আমরা মনের মতো করে অপর মানুষকে পেতে গিয়ে হতাশ হই। কিন্তু মানুষ নিজেকেই কি নিজের মতো করে পায়? তাহলে অন্যে আমার মতো হয়ে উঠবে এ ভাবনা অপ্রাসঙ্গিক, সেটাই এই লকডাউন বুঝিয়ে দিয়েছে হয়তো। উপভোগ থেকে উপলব্ধিতে পৌঁছে যাবার একটা অনুশীলন দিয়ে গেল এই অতিমারী। এক দল মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছে সাহায্যের জন্য, যুগ যুগ ধরে এই সব মানুষ থাকে বলেই থার্ড-ওয়ার্ল্ডে কিছু না থেকেও প্রাণ আছে বোঝা যায়, লড়াই করার হিম্মত আছে প্রমাণ হয়, মানবিকতা দেখে নেয় এগিয়ে থাকা দেশের বন্ধুরা। উপায় থাকলে আমরা সেখানেও ছুটে যেতাম ভরসা দেবার জন্য।
পরিবেশ বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার সুবাদে বেশ কয়েক মাস আমি নিয়িমিতভাবে কর্মস্থলের বাইরে। ঘরে বসেই নিজের কাজ ও প্রয়োজনে বেরোনো ছিল। কাঙাল হরিনাথ মজুমদারকে নিয়ে আমার সম্পূর্ণ হওয়া গবেষণাটি একুশ শতক থেকে বেরোনোর কথা ছিল পয়লা বৈশাখে, বেরোলো না। বলাকা নামক যে-পত্রিকাটি আমি সম্পাদনা করি সেটার এবারের বিষয় ছিল প্রাক-স্বাধীনতা সময়ে বাঙালির সভা-সমিতি-প্রতিষ্ঠান, সেটার কাজও মাঝপথে। জানি না শেষ অবধি কে কোথায় পৌঁছব, তবু ভালো থাকার ভরসা নিয়েই লিখতে বসি, আকাশের দিকে চেয়ে ভাবি সব ঠিক হয়ে যাবে, আবার দেখা হবে আমাদের, আবার আড্ডা, গান, গল্প ও আলিঙ্গন, ফিরে যাই অসমাপ্ত বন্ধুতার কাছে। অমল জড়িয়ে ধরে আবার সুধাকে চুমু খাবে প্যারিসের রাস্তায়।
লেখাটি শেষ করি ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, সমাজকর্মী ও দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষের প্রতি নতজানু শ্রদ্ধা রেখে। আমিও তো সেই দিন-আনা দিন-খাওয়া পাবলিকেরই মতো পরিযায়ী, বুঝি এই কষ্টের মধ্যে বেঁচে থাকার আনন্দ।


Post a Comment

0 Comments