রবিবার


বইওয়ালার রবিবার/ ৩

করতলে এত রং, জামাল!

আবীর মুখোপাধ্যায়


এমন কখনও হয়নি! কখনও কোনও বই পড়তে গিয়ে, বই নিয়ে লিখতে গিয়ে কখনও এতো রঙ লাগেনি করতলে! দেখতে দেখতে সেই রঙে রাঙা হল মন। তবু রং যেন উদাসীন!
বইটির নাম ‘জামাল’। ‘জামাল’ আদতে শিল্পী জামাল আহমেদের শিল্প-চর্চার একটি দুর্লভ সৃজন-সংগ্রহ। প্রতি প্রতি পৃষ্ঠায়, কাদাজল মাখা মানুষ-পশু-পাখি-ঘাসফুলের জন্য উদার অভ্যর্থনা।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের ছবিতে ছবিতে ছয়লাপ। শতাধিক পৃষ্ঠার ‘জামাল’ যতো দেখি, আর দেখি অন্তর্চেতনের ভিতর এলোমেলো অপার নিসর্গ এসে দাঁড়ায়। ঠিক যেন নন্দলালের মতো মাটির বৈভবে পূর্ণ। কখনও মনে হয়, জয়নুল আবেদিন সাহেবের মতো। যাঁর ছবি নিয়ে এদেশের এক অগ্রজ শিল্প-রসিক লিখেছিলেন, ‘আবেদিন সাহেবের ছবি নদীর মতো, প্রান্তরের মতো, চষা ক্ষেতের মতো, বহমান জীবনের মতো ব্যাপক-বিস্তৃতই নয় শুধু, ছবিতে ছবিতে প্রকৃতি আর মানুষের জয়গান এমনই ছন্দিত, মন্ত্রিত অথবা শিল্পীত, যার তুলনা এই উপ-মহাদেশে বিরল’! 
দু’ মলাটের ভিতর ধরে রাখা শিল্পীর সারা জীবনের সু-নির্বাচিত কাজের সংকলন। প্রচ্ছদ ও গ্রন্থ পরিকল্পনা করেছেন ও কথামুখ লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক নিসার হোসেন। নিসার সাহেব ভূমিকায় জামালকে নিয়ে লিখছেন, ‘জামালের কাজের সবচেয়ে বড়গুণ হচ্ছে বিষয়বস্তু এবং কম্পোজিশনের সারল্য, যার কারণে যে কোন দর্শকই খুব দ্রুত ওঁর ছবির সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়েন’।
এই গ্রন্থে জামালের ছবি নিয়ে লিখেছেন, অধ্যাপক টনি কে স্টির্য়্যাট, মইনুদ্দিন খালেদ, চিত্র-সমালোচক শোভন সোম। গ্রন্থের শেষে জায়গা করে নিয়েছে শিল্পীর সম্মাণনা তালিকা, বিভিন্ন প্রদর্শনীর সাল-তামামি এবং সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি।
বাংলাদেশের জল-মাটি-হাওয়ার টেক্সচারকে এই সময়ের যে শিল্পী; শিল্পের সাতমহলে এনে ফেলার কৃতত্ব রাখেন, তিনি জামাল আহমেদ। বর্ষা দিনের উথাল-পাথাল খরস্রোতের ব্যাকড্রপে তাঁর ছবিতেই সফেন লাবণ্য দেখি আমরা। কখনও সে অ্যাক্রেলিকে আঁকা ‘ফেরি’, তো কখনও ‘মুনসুন’ সিরিজ। বাদল দিনের ছবিতে বৃষ্টি-ভিজে হাওয়ার মাতন কেবল ছবির মোটিফ ছাতাকে নয়, কোন সুদূরে- জলভরা মেঘে উড়িয়ে নিয়ে চলে আমাদের। রঙের প্রলেপে প্রকৃতির আলো-অন্ধকারের সখ্য, বাস্তব ছুঁয়ে নতজানু ডিটেলিং আর নিজস্ব টেক্সচারে জীবন-শিল্পের নিয়ত সন্ধান; জামালকে স্বতন্ত্র করে নিসর্গ নির্মাণে।
কেমন করে আঁকেন এমন নিসর্গ?
শিল্পীর কলকাতা সফরে, স্যাটার ডে ক্লাবের লবিতে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা করেই ফেলেছিলাম। সস্নেহে কাঁধে হাত রেখেছিলেন জামাল। দিব্য মনে পড়ছে বলেছিলেন, ‘ছবি আসলে একটা ঘোর। তুমি জোর করে এঁকে ফেলতে পারবে না। আমিও পারি না। একটা সময় ক্যানভাস তোমাকে দিয়ে ঠিক আঁকিয়ে নেবে। কতবার হয়েছে, অর্দ্ধেক এঁকে রাত্তিরে ঘুমোতে গিয়েছি। মাঝরাতে উঠে ফের ক্যানভাসের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছে’।
শিল্পের ঘোর বুঝি এমনই বেপরোয়া হয়। যেমন ছিল, জয়নুল-কামরুল-সুলতানের শিল্পে। এমন ঘোরেই ছবি আঁকতেন রামকিঙ্করও। সত্য ও সুন্দরের মেলবন্ধনে তাঁর জল রঙে ছবিজুড়ে হাজির মানুষের ঢল। সে ঢলে নন্দলালের মতো শিকল ছেঁড়া উল্লাসকে পোষ মানানো নেই। বরং চরম উদ্দামতা ভর করেছে। আর এই খানটিতে রামকিঙ্করের গতিময়তা। যে গতিময়তার ভঙ্গিটি কিউবিস্ট। জামালের ছবিতেও এক আশ্চর্য উদ্দামতা-গতিময়তা। ‘গোয়িং হোম’ ছবিটি যেমন। ছবিতে দেখা যায়, নদী চরে নৌকো এসে থামতে পারের দিকে রওনা দিয়েছেন এক সহজিয়া মানুষ। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী, যার কোলে একটি শিশু। হাঁটার ভঙ্গিতে দারুণ এক গতি। চরের হাওয়া কেটে, বালি ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার সে গতি শিল্পীর মনোবেগ।
জামালের ছবির বড় অংশজুড়ে রয়েছে নারী। তবে, ‘তার নারীরা কখনো আত্মরূপমুগ্ধ; যেন তারা পার্থিব কামনা-বাসনা ভুলে স্বপ্নিল জগতে লীন হয়ে আছে। নারীর তন্দ্রাহত চোখের দৃষ্টি আর মসলিনের মতো নরম স্বচ্ছ বসনে আবৃত যৌবনের রূপ-মাধুরি চিত্রিত করে জামাল রূপকথার মতো আবহ সৃষ্টি করেছেন’।
মইনুদ্দিন সাহেবের লেখা পড়তে পড়তে মনে পড়ছে, রামকিঙ্করের ন্যূড স্টাডির কথা। যে নগ্নিকার স্টাডি নিয়ে রামকিঙ্করের ওপর খানিকটা বিরক্তই ছিলেন একসময় নন্দলাল! কিন্তু কিঙ্কর ছিলেন ভালবাসায় ভাস্বর। মনে করতেন, ‘যতক্ষণ না তার মধ্যে প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যায়, ততক্ষণ ভালবাসার কোনও অস্তিত্বই কেউ উপলব্ধি করতে পারে না। একজন শিল্পীর মৃত্যু পর্যন্ত ভালোবাসার তৃষ্ণা থেকে যায়’। কিঙ্করের এই উপলব্ধির জন্যই তাঁর নগ্নিকারা সকলেই আদিম আবেদনে চঞ্চল হয়েও চোখের দীপ্তিতে, রেখার উজানে অনন্যা।
জামালের নারীরাও রঙের পুরু টেক্সচারে তুখোড় যৌবন-রাগ বহন করে। প্রথমে পোল্যান্ডের ওয়ার্সস্থ একাডেমি অব ফাইন আর্টস ও পরে জাপানের সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফুমেইকার কাছ থেকে দীক্ষিত হলেও জামালের নারীরা আমাদের চিরচেনা বাংলাদেশের মেয়ে। তেল রঙে আঁকা ‘আর্টিস্ট এবং মডেল’ শীর্ষক ছবিটিতে নগ্নিকার বসে থাকার মতোই সহজাত তাদের মুদ্রা। অপলক দেখি, পেনসিলে ‘ফতিমা’, অ্যাক্রেলিকে ‘সিডাকশন’ সিরিজ, চারকোলে ‘স্লিপিং ওম্যান’ এবং চারকোল প্যাস্টেলে ‘ওয়াটিং’ সিরিজ!
এমন অপেক্ষার ছবি, বাংলাদেশ আর কবে দেখেছে?
যেন রবিঠাকুরের সেই বিচিত্র পর্যায়ের কাফি রাগে গাঁথা নবতালের গানটির মতো। ‘দুয়ার মম পথপাশে, সদাই তারে খুলে রাখি/ কখন তার রথ আসে, ব্যাকুল হয়ে জাগে আঁখি’। এখানেই বাংলাদেশে জনপ্রিয় জামাল আহমেদের শিল্পের মুক্তি। এ গ্রন্থের সার্থকতাও সেখানেই।
শিল্পীর পর পর ছবি দেখার এ এক বিরল সুযোগ!
সে সুযোগ মিলল, বাংলাদেশের অপেক্ষার ছবিগুলিতে। অপেক্ষার সে ছবি একলা ঘরে বিনিদ্র বসে থাকা, হাঁটুতে থুতনি রেখে পথের সাড়া শোনা, দুয়ার পাশে দাঁড়িয়ে প্রিয়-পথিকের জন্য ব্যাকুলতায় জাগায় মৌন-মুখর।
অপেক্ষা জাগরুক—, ছবির রঙে-রেখায় তাঁর স্খলিত-বসন মেয়েদের ভরাট স্তনের দৃঢ়-আগ্রহে, শরীরি বাঁক-উপবাঁকের ভুবনে, নিভৃত নয়ন-ঠামে! 

Post a Comment

1 Comments