রবিবার

বইওয়ালার রবিবার/ ৬

রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব ও কবিতা পত্রিকা

আবীর মুখোপাধ্যায়


‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসুর অগ্রন্থিত গদ্য সংকলনের সম্পাদনা করতে গিয়ে প্রথম খণ্ডের ‘প্রাক-কথন’-এ সম্পাদক দময়ন্তী বসু সিং লিখেছিলেন, ‘বুদ্ধদেব বসুর ‘‘কবিতা’’ পত্রিকা এমনই একটি রত্নখনি যে মনে হয় অবিরাম খননেও বুঝি তা নিঃশেষিত হবে না’।
বিন্দুমাত্র বাড়িয়ে বলেননি দময়ন্তী। এক, দুই করে তাঁর সু-সম্পাদনায় ‘কবিতা’ থেকে সিরিজের তৃতীয় খণ্ড। বুদ্ধদেব বসুর অগ্রন্থিত গদ্য সংকলনের এই পর্যায়ের বিষয়, ‘প্রবন্ধ ও বিদেশী সাহিত্য’।
সম্পাদকের নিজের কথায়, ‘‘কবিতা’ পত্রিকার প্রথম দিকে সম্পাদক “বিদেশী সাহিত্য” নামে একটি আলাদা বিভাগ করেছিলেন।
সে সব রচনার চরিত্র বিচার করলে স্পষ্ট দেখতে পাই বুদ্ধদেব বসুর আদি ও অকৃত্রিম পরোপকারস্পৃহা: আমি যা জানলাম অন্যরাও জানুক, আমার যা ভাল লাগল, অন্যরাও সেই ভাল লাগার শরিক হোক।
একদা তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মধ্যে একজন প্রচারক আছে’। সারসত্য সে কথা। সেই প্রচারক পঞ্চাশ-ষাটের দশকে আমাদের চিনিয়েছেন বোদলেয়ার, রিলকে, হ্যেল্ডারলিনকে... বিশ্বসাহিত্যের অলিগলি ঘুরে যে সব মণি-মুক্তো তিনি খুঁজে পান এনে উপস্থিত করেন পাঠকের দরবারে। নানা সংবাদ দেন, অনুবাদ করেন পাতার পর পাতা, কবিতার পর কবিতা- গদ্য, পদ্য, পত্র- আপনারা শুধু জানুন এঁদের, সম্পাদকের অনুরোধ শুধু সেটুকুই’।
এ গ্রন্থে দময়ন্তী বুদ্ধদেবের দশ’টি প্রবন্ধ রেখেছেন।
প্রবন্ধগুলি ১৩৪২ থেকে ১৩৬৬-র মধ্যে লেখা। যার মধ্যে আটটি ‘কবিতা’-র নিয়মিত সংখ্যায় প্রকাশিত ও দুটি বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত। প্রথমটি ১৩৪২-এর ‘কবিতা’-র আশ্বিন সংখ্যায় প্রকাশিত লেখা, ‘কবিতায় দুর্ব্বোধ্যতা’।
এই প্রবন্ধ কিংবা, ‘কবিতার পাঠক’ বা, ‘প্রেমের কবিতা’ পড়তে পড়তে মনে হয়, বুদ্ধদেবের গদ্যভাষায় আশ্চর্য মোহজাল ছড়ানো।
সেই গদ্য-জাল কেটে এই অস্থির সাইবার সময়েও ওঠা যায় না।
পড়িয়ে নেন বুদ্ধদেব।
‘প্রেমের কবিতা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি যেমন।
“প্রেম ও যৌনসঙ্গম পরস্পরবিরোধী, প্রত্যেক শিক্ষিত সপ্তদশবর্ষীয় যুবা কোনও-না-কোনও কালো চোখের মোহে প’ড়ে এই ধারণা কিছুকাল অন্তত লালন করেছে। শিক্ষিত বললুম এই কারণে যে মূঢ় গ্রাম্যজনের পক্ষে এ-হেন ভ্রান্তি অসম্ভব, শ্রমোপজীবীর কঠোর পরিমণ্ডলই তাকে বাস্তবচেতন করে। কিন্তু শিক্ষিত, গ্রন্থবিলাসী, অবস্থাপন্ন যুবার মনে এ-মোহ সঞ্চারিত না-হওয়াও প্রায় অসম্ভব; দেশ-বিদেশের সাহিত্য তখনকার মতো এ-ধারণারই পুষ্টিসাধন করে, এবং দৈব্যক্রমে যদি তার কলম চালাবার চুলবুলানি রোগ থাকে, তাহ’লে এই মর্মেই সে প্রেমের কবিতা লিখবে যে তার অভীস্পিতা এই মরলোকের নয়, কল্পনার দুহিতা”।
শুধু এই অংশটি যদি ধরি, প্রতিটি শব্দের ব্যবহার যদি দেখি, দেখব, প্রতিটি শব্দের জরুরী প্রয়োগ। এবং ওজনদার সেই শব্দগুলি এসেছে লেখকের বক্তব্যের যুক্তি ধাপে ধাপে প্রতিষ্ঠা এনে দিতেই। কবিতা কি ও কেন – এই সাদামাটা প্রশ্নের আড়ালে লেখক যখন, আমাদের সামনে কবিতার চরণ তুলে বিশ্লেষণ করেন, তখন কোথাও মনের মধ্যে ‘প্রাবন্ধিকের দুর্বোধ্য যুক্তি-জাল’ ভেবে আমাদের পালাতে হয় না। বরং আমরা পড়ি।
'বিদেশী সাহিত্য' পর্যায়ের লেখাগুলিতেও এমনতরো ধরন।
এই পর্বে বুদ্ধদেবের ১৬টি লেখা সংকলিত হয়েছে।
যার মধ্যে শেষেরটি ‘পত্র প্রবন্ধ’।
পাস্তেরনাক প্রসঙ্গে কবি অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা এই চিঠিটির পাশে এই একই প্রসঙ্গে অমিয় চক্রবর্তীর দুটি চিঠিও পরিশিষ্টে সংকলিত করেছেন সংকলক। তিনটি চিঠি মিলিয়ে পড়তে বেশ লাগে। পাস্তেরনাকের গদ্যভাষার নির্মিতি সম্পর্কে দু’ জনের বিশ্লেষণ জানতে পারে পাঠক। ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি রলাঁ’, ‘এলিয়ট ও কিপলিং’- এর মতো লেখাগুলি পড়তে গিয়ে মনে হয়, দময়ন্তী তাঁর ‘প্রাক-কথন’-এ ঠিকই বলেছিলেন।
বুদ্ধদেব ‘বিশ্বসাহিত্যের অলিগলি ঘুরে যে সব মণি-মুক্তো তিনি খুঁজে পান এনে উপস্থিত করেন পাঠকের দরবারে’- যথার্থ উক্তি। শুধু বিদেশী লেখকের কথায় নয়, তাঁদের কাব্য অনুবাদ ও বিশ্লেষণেও বুদ্ধদেবের অনুভব পাঠকের কাছে তাঁকে শ্রদ্ধাশীল করে রাখবে। ধন্যবাদ সম্পাদককে, বাংলা সাহিত্যের ‘রত্নখনি’–তে বুদ্ধদেবের হারিয়ে যাওয়া ‘মণি-মুক্তো’-গুলি তিনি তুলে এনেছেন পাঠকের আম-দরবারে।

Post a Comment

0 Comments