রবিবার

বইওয়ালার রবিবার/ ২

সে যুগের কেচ্ছা একালের ইতিহাস

আবীর মুখোপাধ্যায়


সে ছিল হুঁকো-খাওয়া সাহেব নবাব, জুড়ি-গাড়ি-চড়া রাজা-বাবুদের আমল। তখন ‘কুলীন ব্রাহ্মণ থেকে নৈয়ায়িক পণ্ডিতকে কেনা’ যেত। বাবু-বিবিদের এই কলকাতায় সমাজের উচ্চবিত্তরা ‘পরকালের জন্য পুণ্য সঞ্চয় করতে গিয়ে ইহকালের দেবতার মূর্তি চুরি করতেও দ্বিধা’ করত না। হুতোমের এই নক্সা-বাজ বাবুরা ‘নিজেদের মধ্যে অনেকেই পতিতালয়ে গমন করলেও বারাঙ্গনাপুত্র লেখাপড়া শিখতে চাইলে ‘গেল গেল রব’ তুলত। এই আঠারো-উনিশ শতকের ‘কেচ্ছা’ নিয়েই লেখক-সম্পাদক-বানান মনোযোগী সুবীর রায়চৌধুরীর গ্রন্থ ‘সে যুগের কেচ্ছা একালের ইতিহাস’। যার প্রথম প্রকাশ সত্তরের দশকে। সে সময় গ্রন্থের প্রচ্ছদ করেছিলেন রঘুনাথ গোস্বামী। অধুনা, ভাষাবন্ধন সংকলনেও সেই প্রচ্ছদের অনুসরণ। 
ভূমিকা বাদ দিলে সুবীরবাবুর এ গ্রন্থে সাতটি লেখা জায়গা করে নিয়েছে। শুরুতেই ‘প্রথম সংস্করণের ভূমিকা’-টি অত্যন্ত দরকারি একটি লেখা এই গ্রন্থের জন্য। ঠিক একেবারে শেষে, লেখকের ‘লেখার তালিকা’-টিও যেমন গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আসলে প্রথার অনুসারী না হয়ে যাঁরা একটু অন্য বিষয় নিয়ে লিখছেন, বই করছেন- নিবিড় পাঠকদের অনুরোধ সেই সব লেখকদেরও জানুন।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে বুদ্ধদেব বসুর জীবনী করতে গিয়ে তাঁর নিষ্ঠা, জগদীশ গুপ্তের গল্প ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা সংগ্রহ সম্পাদনার সময় তাঁর পুনরুদ্ধার, ‘দেশ’ পত্রিকার জন্য তাঁর লেখা ‘কবিতা’ পত্রিকার ইতিহাস বা, বানান-ব্যাকরণ-অভিধান-সাবেককালের কলকাতা নিয়ে তাঁর আগ্রহ এ সব সুবীর রায়চৌধুরীর ভাবনার জগত, কলমের জাত চেনায়। যে কোনও বিষয় নিয়ে এই নিষ্ঠ গবেষক সম্পর্কে তাঁর সুহৃদ সৌরীন ভট্টাচার্য সেই জন্য লিখছেন, ‘গবেষণায় সুবীর ছিল পায়ে হাটাঁ পথের পথিক’।
গ্রন্থের প্রথম লেখা ‘সমাজ আমার সিন্দুকে’। এই লেখা বা, ‘প্রথম বিধবা-বিবাহ’ বা ‘হীরা বুলবুল ও হিন্দু কলেজ’ নিয়ে লেখালিখি নতুন নয়। কলকাতা নিয়ে কতিপয় যে কয়েকজন বাঙালি লেখক কাজ করেছেন, তাঁদের অনেকের লেখাতেই রয়েছে এই সমস্ত ঘটনার কথা। রাজনারায়ণ বসুর ‘সেকাল আর একাল’ গ্রন্থে যেমন ‘সমাজ আমার সিন্দুকে’-র ঘটনাসূত্র ‘কালীপ্রসাদী হাঙ্গামে’-র হদিস মেলে। সুবীরবাবুর লেখার মধ্যে সে কথার উল্লেখ করে শুধু ঘটনাক্রম নেই, লেখার বাঁকে বাঁকে সমাজের নৈতিক-স্খলনের দিকটিও বিধৃত। বিশ্লেষিত।
সমাজের নানা স্তরে সেকালের অকৃতজ্ঞ মানুষেরা ছিল, দুর্জন ‘রাধাকৃষ্ণ’-র দুর্বুদ্ধি, শ্বশুর রামদুলালের বিরুদ্ধে তার কূট-তর্ক, চক্রান্ত সে কথাই কেবল মনে করিয়ে দেয়। রামদুলাল পেরেছিলেন। যে কালীপ্রসাদ দত্ত বিবি আনরের মতো একজন মুসলমান রক্ষিতা রাখে সে যুগে, তাকে জাতে উঠিয়েছিলেন স্রেফ অর্থ এবং পুরুষবিক্রমে!
‘প্রথম বিধবা-বিবাহ’ শীর্ষক লেখাটির কাহিনির সঙ্গে যামিনী পটে জড়ানো নানা ‘কেচ্ছা’ ইতিহাসে সুবিদিত। জাল প্রতাপচাঁদের কথা যেমন, কে না জানেন! এসব বহু চর্চিত গল্পের ভিতরই পোষা পাখির জন্য তেজচাঁদের দরদ, ‘চুপু! হামারা লাল ঘাবড়াওয়েগা’ বা, প্রতাপচাঁদের ‘পরানমামা দড়ি পাকাচ্ছেন’ উক্তি রিলিফ এনে দেয়। এসবের মাঝেই লেখকের নিরুপম গদ্যে গুড়গুড়ে ভট্টাচার্য শাস্ত্রবিরুদ্ধ বিধবা-বিবাহের পৌরহিত্যে বসে পড়েন। আর এভাবেই ‘সেদিন যা ছিল কেচ্ছা, আজ তা ইতিহাস’ হয়ে ওঠে!
নেপালের গণিকা হীরা বুলবুল ও তাঁর পুত্রকে নিয়ে হিন্দু কলেজের কর্তা ব্যক্তি ও শহরের বাবু-বিবিদের মধ্যে বিপুল সোরগোল হয়। যার থেকেই হিন্দু কলেজের রূপান্তর ও প্রেসিডেন্সির যাত্রাও শুরু। যেন পটে লিখা ছবি। ‘হীরা বুলবুল ও হিন্দু কলেজ’ ইতিহাস থেকে নজির তুলে লেখক দেখিয়েছেন সেরকমই। সরস বাক্যের সঙ্গে সেকালের সংবাদপত্রের নাতিদীর্ঘ উদ্ধৃতির জন্য লেখাগুলি সুখপাঠ্য এবং অবশ্যই তথ্যনিষ্ঠ। ‘একটি ডুয়েল লড়ার কাহিনী: প্রেমের জন্য নয়’ এবং ‘মই হাতে অভিসারে ফিলিপ ফ্রান্সিস’ লেখা দুটি এক অন্য কলকাতার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেয়। এই শহরেই প্রেম নয়, বঙ্গদেশে ‘প্রেস’-এর স্বাধীনতার জন্য যে দু’ জন সাহেব ডুয়েল লড়তে পারেন, তা জানতে পারে পাঠক। এ দেশে সংবাদপত্রের গোড়ার কথার অনেকখানি, এই লেখার রসদ।
অন্যদিকে ‘মই হাতে অভিসারে ফিলিপ ফ্রান্সিস’ নিটোল এক প্রেম কাহিনি। সেই মেয়ে দিনেমার অধিকৃত উপকূল শহর ট্র্যাঙ্কিবারের নোয়েল ক্যাথারিন ওয়েরলি। এদেশে এসে ১৭ বছর বয়সেই সে প্রেমে পড়ল ফ্রান্সিস গ্রান্ডের। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই গ্রান্ড এক রাত্তিরে বন্ধুর বাড়িতে ডিনারে গিয়ে খবর পেলেন তাঁর বাড়িতে মই হাতে অভিসারে এসে ধরা পড়েছে ফ্রান্সিস ফিলিপ! সুন্দরীর অধিকার নিয়ে বিবাদ গড়াল আদালতে। ওয়েরলি গ্রান্ডকে ছেড়ে ফিলিপের কাছে থাকলেন কিছুদিন। এরপর ইউরোপে, কেন না সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করে ছিল নয়া প্রেম উপাখ্যান। প্রেমিক নেপোলিয়নের পররাষ্ট্র সচিব তেলিরাঁদ। পড়তে পড়তে সত্যিই ভাবনা হয় গমরঙা মেয়েটিকে নিয়ে। প্রশ্ন জাগে, বালিকা বেলার প্রেমই কি স্থির করে দিয়েছিল এই বালার ভাগ্য-পরিহাস? গঙ্গা থেকে সেইন নদীর ধারে এতো চর্চা! নিঃসন্দেহে সে যুগের এই ‘কেচ্ছা’, এই সময় ইতিহাস। এ লেখার টান পাঠককে নিয়ে যায় শেষ শব্দটির কাছে।   
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভার কথা যাঁরা জানেন, তাঁরা এও জানেন কেমন ছিল সরস সে সভার জমজমাটি। রঙ্গ-তামাসার বাইরে নানা সময় শাস্ত্রের বিধানে ন্যায় তর্কেও জমে থাকত সভা। বিধবা বিবাহের শাস্ত্র-সম্মতি নিয়ে রাজবল্লভের পণ্ডিতদের তর্কে হারাবার জন্য সভায় একটি মেষশাবক হাজির করে যে নজির ইতিহাসে রাখলেন কৃষ্ণচন্দ্র; সে তো কেচ্ছাই! সংক্ষিপ্ত এ লেখার মধ্যে সরস-গদ্য চালটি মন্দ লাগে না লেখকের। চমকপ্রদ লেখা ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ: দেববিগ্রহ চুরির মামলা’। অগ্রদ্বীপের গোপীনাথকে নিয়ে এ লেখায় একদিকে যেমন একটি বিগ্রহ হাত বদলের কথা আছে, অন্যদিকে মুনশি নবকৃষ্ণ দেবে থেকে রাজা নবকৃষ্ণ দেব হয়ে ওঠার কাহিনিও হাজির। কৃষ্ণচন্দ্র এবং নবকৃষ্ণের কোন্দল বা, মহাপ্রভুর বৃন্দাবন যাত্রাকালে পার্ষদ গোবিন্দ ঘোষের গোপীনাথ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা কখনও মূল কাহিনি থেকে পৃথক হয়নি।
লেখক যখন গল্পের সুতো ছেড়েছেন, দেশ-কাল-সাহিত্য-সময়কে ধরে ছড়িয়ে থাকা ‘গল্প’ – সযত্নে সাজিয়ে দিয়েছেন লেখার ভিতর। সেই গ্রন্থনা নির্মেদ। সে লেখা কখনও পড়তে ক্লান্তি এসে পড়ে না। এসে পড়েছে নানা ঐতিহাসিক চরিত্রের মিছিল। মুখের ভিড়ে তবু গল্পের গতি শ্লথ হয়ে পড়ে না। সন-তারিখের কূটকাঁচালিতে সাজানো ইতিহাস-নির্ভর তথ্যনিষ্ঠ লেখা হয়েও সুবীর রায়চৌধুরীর ‘সেযুগের কেচ্ছা’- এই কারণেই একটি সুখপাঠ্য গ্রন্থ। এ গ্রন্থ নির্মাণের সফলতা এখানেই।
 
লেখক : সুবীর রায়চৌধুরী, প্রকাশক : ভাষাবন্ধন

Post a Comment

0 Comments