নগরকীর্তন

গানের পাখি/ ৫

কলিমকে লুকিয়ে রাখলেন জর্জ

আবীর মুখোপাধ্যায়


স্বর্ণযুগের বাংলা গানের সুর ও কথার মতোই মিঠে সেই সব গান তৈরির গল্পও। সুরকার, গীতিকারদের সঙ্গে শিল্পীদের সম্পর্ক— জন্ম দিয়েছে যামিনি পটে জড়ানো বিচিত্র উপাখ্যানের। এই ধারাবাহিকে আমরা ফিরে ফিরে শুনব হারানো দিনের মনকেমনের গান। চেয়ে চেয়ে অপলক দেখব সুরের আকাশে শুকতারা। আর একলা হয়ে নিবেদন করব একে অপরকে গানের রেকাব।


একটি গান সকাল থেকে মর্মে বেজে চলেছে।
রবীন্দ্রনাথের ৬৪ বছর বয়সে লেখা পিলু ও বারোয়াঁয় অপরাহ্ণের সুরে গাঁথা একটি গান। সুরের মধ্যে প্রশান্ত বিষাদ-মাখা। ‘‘পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে।/ পিছিয়ে পড়েছি আমি, যাব যে কী করে?’’
শিল্পী কলিম শরাফী। কেই এই কলিম?
উত্তর খুঁজতে খুঁজতে দাঙ্গার দিনকালে যাই! ছেচল্লিশের দাঙ্গা।
একে একে পার্টির সকলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
কেউ গোয়াবাগানে। কেউ পার্কসার্কাসে। কেউ কলকাতার বাইরে থেকে গোপনে শহরে ঢুকে আশ্রয় নিচ্ছেন ভবানীপুর অঞ্চলে। বাইরে পা রাখাই দায়! মানুষ মানুষকে মারছে নৃশংসভাবে। এরইমধ্যে কয়েকজন সহৃদয় দলেরই এক মুসলিম যুবককে বাঁচাতে ব্যস্ত। জোর করে ধুতি পরিয়ে একটা রেসকিউ বাসে তুলে দিল তারা। বাসটা যখন রাসবিহারী পার হচ্ছে, তখন সেই যুবক টুক করে নেমে পড়ল। মোড়ের মাথা শুনশান। যুবক আর দেরি না করে চারদিক দেখে, সোজা চেনা একটা বাড়িতে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়ল। দরজা খুললেন জর্জ বিশ্বাস! দরজার বাইরে আগন্তুককে দেখে খুব ভয় পেয়ে গেলেন তিনি। তারপর ঘরের ভিতর টেনে নিয়ে, যুবককে লুকিয়ে রাখলেন খাটের নীচে!
কে এই যুবক?
কলিম শরাফী। একটি ইন্টাভিউতে এ ঘটনা নিজেই বলেছিলেন কলিম।
কলিমের সহযোদ্ধা খালেদ চৌধুরী লিখছেন, ‘‘কলিম এসে দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়িতে আশ্রয় নিল। জর্জদা তো ওকে খাটের তলায় লুকিয়ে রাখলেন। ওঁর দু’জন কাজের লোক ছিল, শ্রীকান্ত আর অনন্ত। ওদের জর্জদা বলতেন, “আমার একজন বন্ধু আসবে, দুজনের জন্য খাবার রেখে যেও।” ওরা খাবার দিয়ে গেলে দরজা বন্ধ করে খাটের তলা থেকে কলিমকে বের করে খাওয়াতেন। তারপর আবার খাটের তলায় পাঠিয়ে দিতেন। ওই খাটের ওপর শম্ভু মিত্র তৃপ্তি মিত্র ছিলেন। তখন শাঁওলি জন্মাবে। এই অবস্থায় ওঁরা প্রায় দিন সাতেক ছিলেন। রায়টে তীব্রতা কমে এল। রাস্তাঘাটে বাস ট্রাম চলতে শুরু করেছে। ওই সময়ে শম্ভু মিত্র একদিন কলিম-কে ওখান থেকে বের করে বাসে তুলে ডেকার্স লেনের কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে দিয়ে আসেন। কলিম প্রাণে বেঁচে গেল।’’
টিকটক আর সোশ্যাল সাইটে দিবারাত্রির কাব্যে বসত করতে করতে বাঙালি বেমালুম ভুলে গেছে অনেক বিশিষ্টের সঙ্গে এই প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীকেও। শুধু শিল্পী নন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রথম সারির ব্যক্তিত্বও। কলিমের জন্ম বীরভূমের সিউড়ির  খয়রাডিহি গ্রামে এক পীর বংশে, ১৯২৪ সালের ৮ মে। বাবা সৈয়দ সামি আহমেদ, মা বেগম আলিয়া। ৪ বছর বয়সে তিনি তাঁর মাকে হারান।
’৪২ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্রাবস্থায় তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ছিলেন তৎকালীন ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের অন্যতম কর্মী। সুভাষচন্দ্র বসুর ‘হলওয়েল মনুমেন্ট মুভমেন্ট’ নামে যে আন্দোলন হয়, তাতেও যোগ দিয়ে কিছুদিনের জন্য জেল খেটেছিল। পুলিশের লাঠিচার্জের মাথা ফেটে যায়, সেই দাগ রয়ে যায় আজীবন।
সিউড়ি জেলে ১৫ মাস কারাবন্দি থাকার পর মুক্তি হন। সেই সময়ই রানী চন্দের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। রানী ছিলেন শান্তিনিকেতনের কলাভবনের ছাত্রী। তাঁর প্রেরণায় কলিম গণসঙ্গীত শিখতে আগ্রহী হন। কারাবাসের সেইসব দিনকাল মেলে কলিমের স্মৃতিকথায়। ‘‘শিউড়ি জেলে যাদের সঙ্গে পরিচয় হয় তাদের মধ্যে সেকালের অনেক নামকরা রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। এছাড়াও অনেকে যারা সাংস্কৃতিক জগতের লোক, তাঁরাও শান্তিনিকেতন থেকে ধরা পড়ে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে সেখানে ছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শ্রীমতী রাণী চন্দ, যিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপর লিখিত বই ‘ঘরোয়ার জন্য বিখ্যাত। শ্রীমতী নন্দিতা কৃপালিনী (বুড়িদি) রবীন্দ্রনাথের নাতনি। এছাড়া সুহাস দে - প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ও কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ মুকুল দের ছোট ভাই - তিনি নিজেও একজন চিত্রশিল্পী। মহারাষ্ট্রের দীনুকর কৌশিক, যে শান্তিনিকেতন কলাভবনের ছাত্র ছিল, পরবর্তীতে কলাভবনের অধ্যক্ষ ও নামকরা চিত্রশিল্পী হিসেবে পরিচিত। এছাড়া প্রণব গুহঠাকুরতা, আমার সমবয়সী, যার সঙ্গে গভীর হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল। তার কণ্ঠে রবীন্দ্র সংগীত শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে যেতাম। জেলে সে সবসময়ই রবীন্দ্র সংগীত গাইত এবং আমাকে গাওয়ার জন্য প্রবলভাবে উৎসাহিত করত।’’
কারা-পর্বেই কলিমের মনে গণ-সঙ্গীতের বীজ উপ্ত হয়। সিউড়ি জেলেই পরিচয় হয় অনেক রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গেও। শিল্পী তাঁর স্মৃতিকথা ‘স্মৃতি অমৃত’-তে লিখছেন, ‘‘রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে যাদের নাম মনে পড়ছে তারা হলেন শ্রীকামদা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়- বীরভূম জেলা কংগ্রেসের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। যার পুত্র শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে ভারতের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। এছাড়া হেনাদি, যিনি কুমিল্লা অভয় আশ্রমের একজন উৎসাহী কর্মী ছিলেন। শ্রী নৃসিংহ সেন বীরভূমের একজন বিখ্যাত কবিরাজ, তিনিও আমাদের সঙ্গে ছিলেন...।’’
’৪২ সালেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন কলিম। ১৯৪৩ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সূচনা ঘটলে বহুরূপী নাট্যদলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে শম্ভু মিত্রের নেতৃত্বে বিভিন্ন গানের স্কোয়াডে যোগদান করেন এবং পাশাপাশি নাটকেও অভিনয় করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি ক্যাপিটাল মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন। কিন্তু গণনাট্য সংঘের হয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হলে তাঁর ডাক্তারি পড়া থেমে গেল। গান গেয়ে গণ-সংগ্রামের সেই কলকাতার ছবিতে ফিরি— আইপিটিএ-তে গণসংগীতই ছিল প্রধান। তবে কিছু কিছু রবীন্দ্রসংগীতও ছিল। যেমন ‘হবে জয় হবে জয়’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই’ কিংবা ‘বাঁধ ভেঙ্গে দাও বাঁধ ভেঙ্গে দাও’—এমন কিছু গান। এসব গান ছিল রেপার্টরিতে।
কলিম এমন সব গান গাইতে ভালবাসতেন। রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি এত দরদ থাকলে, জেল থেকে শান্তিনিকেতন গেলেন না কেন?
এমন প্রশ্নের উত্তরে কলিম বলেছিলেন, তিনি গিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে ‘সংগীত ভবন’-এ ভর্তি হতেই গিয়েছিলেন। কিন্তু কমিউনিস্টদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার অপরাধে আর ভর্তি হওয়া হয়ে ওঠেনি! শেষে ‘দক্ষিণী’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে ছিলেন। বন্ধুদের বলেছিলেন, “শান্তিনিকেতন আমাকে ফিরিয়ে দিলেও আমি কিন্তু দমিনি। দক্ষিণী’তে আমার সংগীত শিক্ষার হাতে খড়ি। আমি ওদের প্রথম ব্যাচ। শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলাম শুভ গুহঠাকুরতা, সুবিনয় রায়কে।” দেবব্রত বিশ্বাস, সুনীল রায়ের কাছেও গান শিখতেন।
কলকাতা তখনও ভাল নেই। একের পর এক ঢেউ আছড়ে পড়ছে। খালেদ চৌধুরী শব্দে এঁকেছেন সেই অভিশপ্ত দিনকাল!
‘‘তখন কলকাতার কী অবস্থা সে এক মাত্র তারাই জানে যারা ঐ সময় উপস্থিত ছিল। অন্যরা সেই বীভৎসতার চেহারা কিছু জানে না। আস্তে আস্তে রায়টটা ধাতস্থ হয়ে গেল। বুঝতে শুরু করলাম—কোন সময়ে বাইরে যাওয়া উচিত; কোন সময় লুকিয়ে থাকা উচিত; কোথায় লুকিয়ে থাকা উচিত। যাক, সেই অবস্থাতেই আমরা আই পি টি এ-র কাজ শুরু করলাম। পার্কসার্কাসে যখন থাকতাম, তখন ধুতিকে ভাজ করে লুঙ্গির মতো করে পরতাম। পরে ট্রামে করে চলে যেতাম। আবার যখন ওয়েলিংটনের কাছে। যেতাম তখন সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতাম। সবাই তো আড়চোখে সবার দিকে তাকাচ্ছে—কারও হাতে হয়ত ছোরা আছে। এসপ্লানেড গেলে নিশ্চিন্ত। ওখানে কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে গিয়ে ধুতি খুলে কাছা দিয়ে উত্তর কলকাতায় চলে যেতাম। সেখানে গিয়ে নাম পাল্টে ফেলতাম। আমি খালেদ হতাম কালী চৌধুরী আর কলিম শরাফী হত কল্যাণ মিত্র। সবাই জানত শম্ভু মিত্র’র ভাই কল্যাণ মিত্র।’’
সকাল গড়িয়ে এখন দুপুর। গগনে মেঘ ছেয়ে এসেছে। পিলু ও বারোয়াঁয় এখনও বেজে চলেছে— ‘‘এসেছে নিবিড় নিশি, পথরেখা গেছে মিশি— সাড়া দাও, সাড়া দাও আঁধারের ঘোরে॥’’

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments