ব্লগ : ওদের কথা/ ৪

ওদের কথা/ ৪

লাইন বাড়ির মণি

মঞ্জীরা সাহা



শ্যামনগরের ডানবার কটন মিল। মিল বন্ধ হইয়ে গেছে ২৫/২৬ বছর হল। ফাঁকা মিলের বিল্ডিং আগাছা জঙ্গলায় ভরে গেছে। মিলের কোয়ার্টারগুলো ভরে গেছে মানুষে। কোয়ার্টারের সেই একখানা চিলতে ঘর দেওয়াল ঢাকা রান্নার জায়গার ফর্মটা বদলে গেছে। ইটের দেওয়াল টিন প্লাস্টিক টানিয়ে জোড়াতালি দিয়ে ঘরের সামনে পেছনে ফাঁকে আরও কত কত ঘর উঠে গেছে। ডানবার কটন মিলের পড়ে থাকা বেকার মানুষগুলো বদলে গিয়ে কোথা কোথা থেকে কারা সব এসে থাকতে শুরু করেছে। আশপাশের ফ্ল্যাট বাড়ির আবাসিকেরা ওই পাঁচিল ঘেরা কোয়ার্টার এলাকাকে এখন বলে ‘লাইন বাড়ি’। ভেতরের লোকেরা বলে ‘ডানবার মিলের কোয়াটার’।
ওই কোয়ার্টারের ভাঙা গেট দিয়ে রিকশ ভ্যান চালিয়ে ছেলেরা বেরোয়। আশপাশের ফ্ল্যাটে মেয়েরা বাসন ধুতে আসে। মণি ওদের দলের একজন।
লাইন বাড়ির ভেতরে মণির ঘরখানাতে বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে আছে চৌকিখানা। টিনের ফাঁক ফোঁকর ঢাকতে পার্টির নেতার নমস্কার করা হাত সমেত মাথাটা উলটে আছে ফ্লেক্সে। দুপুর বেলা টিনের দরজাটা খোলা থাকলে মণির আর ওর মরদকে দুটো ইটের উপর হাঁটু মুড়ে বসে চটকে ভাত খেতে দেখা যায়। থালায় ভাত পেঁয়াজ লঙ্কা ডাল যাই থাক ঘর থেকে গন্ধটা পাওয়া যায় অন্য কিছুর— চোলাইয়ের।
মণির বয়সে যৌবন সামান্য হেলে এলেও চেহারায় হেলে পড়েনি। কোমোরে আঁট করে কাপড়ের আঁচল গুঁজে ও যখন বাসন মাজতে বেরোয় টাইট চেহারায় শরীরের ভাঁজ খাঁজগুলো স্পষ্ট ফুটে ওঠে। ঠোঁটের আসল রঙটা গুটখার মাখামাখিতে কখনও দেখা যায় না। মাথা ভর্তি কুচকুচে কালো কলপে সিঁথিও ঢেকে থাকে। চামড়ার ফাঁকে লাল কমলা কোনও সিঁদুরের নাম বংশ না দেখে ফ্ল্যাট বাড়ির বৌদিরা সমবেত আসরে মণিকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে।
লোকে বলে ছাপড়াতে মণির প্রথম বিয়ে হয়েছিল। সেখান থেকে এক ব্যাটাকে নিয়ে মণি পালিয়ে এসে ঢুকেছিল এই লাইনবাড়ির একটা পুরনো ঘরে। তারপর ঘর বদলে মরদ বদলে টিনের এই ফুটো ওয়ালা ঘরটায় মণি কোনও রাতে যেন ঢুকে পড়ে। আগের মরদ এখনও এই লাইন বাড়িরই বাসিন্দা। মণির আসল বর নকল বর আগের ঘর পরের ঘর গায়ের ঘামের সাথে মিশে থাকা চুল্লুর গন্ধ, সন্ধের পর ফ্ল্যাটবাড়ির বৌদিদের গল্পে প্রসঙ্গ হয়ে ঢুকে পড়ে। সকাল বেলা মণি না এলে ফোন যায় বৌদিদের ফোন থেকে। মণির হাতের রান্নায় টেস্ট আছে। রান্নার পর এঁটো বাসনগুলো ও মাগনা ধুয়ে দিয়ে যায়। ওর হাতের ডলায় কড়াইএর কালি উঠে যায় ঝট করে। এ ও তার কাছে মণির খোঁজ পড়ে খুব ।
মেইন রোডে বাজারে মূলাজোড় কালীবাড়িতে মণিকে দেখে না দেখার ভাণ করে। সব কথা হয় ও যখন কিচেনে এসে ঢোকে।
এসব ছাড়া বছরের একটা সময়ে ওই ফ্ল্যাট বাড়ির বৌদিরা মণির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। লাইন বাড়ির ছট্‌ পূজার প্রসেশন যায় ফ্ল্যাটবাড়িগুলির পাশ দিয়ে। মণি নাচে। ডি জে মিউজিকে চারপাশ চমকে দিয়ে হিট বইয়ের হিট গান বাজে। মণির পা মাথা হাত পুরো শরীর উদ্দাম ভাবে নড়ে নড়ে ওঠে খোলা আকাশের নীচে। ওকে ঘিরে ক্লাবের ছেলেরা নাচে।
প্রসেশনের লাল নীল হলুদ সবুজ আলো পড়ে মণির শরীরে। শাড়ির চুমকিগুলো ঝলমল করে ওঠে। ঘামে ভিজে যায় ও। প্রসেশনের চড়া আলোর পাশে ফ্ল্যাটবাড়ির আলোগুলো ফিকে লাগে। বৌদিরা ব্যালকনির কাচের ভিতর গ্রিলের জানালার ভিতর থেকে হাঁ করে তাকিয়ে দেখে। ফ্ল্যাট বাড়ির ব্যালকনির হাল্কা আলোয় কোন বৌদি কোথায় দাঁড়িয়ে আর দেখা যায় না।
অন্ধকারে মিউজিকে ওদের হাত পা নড়ে উঠলেও দেখা যায় না।
চোখগুলো থেকে যায় মণির দিকে।
মণি নাচতে নাচতে পাস করে যায় কালীবাড়ি ফ্ল্যাট বাড়ি তেমাথা চার মাথা পাঁচমাথা রোডের পর রোড… রোডের পর রোড…!

Post a Comment

0 Comments