স্মৃতির সখ্য

আমার জীবন বিশুদ্ধ ভালবাসার

দেবাশিস চন্দ


‘আমার উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুট/ পায়ে ছেঁড়া চটি/ বার করি নানা কবিতার বই/ কম্পোজ করি নিজেই ছাপাই/ যখন যা পাই মুড়ি ছোলা–ভাজা/ শিশির জ্যোৎস্না আমার খাদ্য’— যাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন জ্যোতির্ময় দত্ত, কবিতার জন্য জীবন–জীবিকা তাচ্ছিল্য করা সেই কবি শম্ভু রক্ষিত, আমাদের প্রিয় শম্ভুদা চলে গেলেন। দু’বছর ধরে ভুগছিলেন পারকিনসন রোগে। হাঁটাচলা তো দূরের কথা, বসার শক্তিও হারিয়েছিলেন। নিজের খুব ঘনিষ্ট একজনকে সাড়ে ছ’বছর এই রোগে ভুগতে দেখেছি। দেখেছি যতদিন যায় এই রোগ কীভাবে উপরে ফেলে শরীরকে। চোখের সামনে যা দেখা এক দুঃসহ মানসিক যন্ত্রণা। সেদিক থেকে শম্ভুদার এই চলে যাওয়া এক অর্থে মুক্তি। নশ্বর এই জীবনে একদিন না একদিন তো সবাইকেই যেতে হয়। হবে। এবং তথ্যের খাতিরে বলে নেওয়া যাক তাঁর বয়স হয়েছিল ৭২ বছর।
তথ্যের খাতিরে আরও কিছু শুরুতেই। যেহেতু তিনি তথাকথিত ‘সেলিব্রিটি’ নন, তাই তাঁর জীবন–তথ্যও নয় রকেট গতিতে বহুল প্রচারিত।
২৯ মে, শুক্রবার সকাল ৮টায় পৈতৃকবাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের বিরিঞ্চিবেড়িয়ায় প্রয়াত হন। রেখে গেছেন স্ত্রী, দুই কন্যা, এক পুত্র, নাতি এবং অসংখ্য অনুরাগীকে। শম্ভু রক্ষিতের জন্ম ১৯৪৮–এর ১৬ আগস্ট হাওড়ায় ১১ ঠাকুরদাস দত্ত বাই লেনে মামাবাড়িতে। বাবা নন্দলাল রক্ষিত কাজ করতেন স্বনামখ্যাত আলামোহন দাশের লোহার সিন্দুকের কারখানায় দাশনগরে। মা রাধারানী দেবী ছিলেন গৃহবধূ। প্রাথমিক শিক্ষালাভ সুতাহাটার পূর্ব শ্রীকৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বৃত্তি পরীক্ষা পাস করে এলেন হাওড়ার কদমতলার ব্যাঁটরা মধুসূদন পাল চৌধুরী স্কুলে।  প্রথাগত শিক্ষায় অনাগ্রহী কবি হাওড়ার নরসিংহ দত্ত কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভরতি হলেও পড়াশোনা শেষ করেননি। তারপর থেকে কবিতা এবং পত্রিকা প্রকাশই ছিল তাঁর সর্বক্ষণের যাপন। কোনও চাকরিবাকরি, স্থায়ী রোজগারের ধার ধারেননি। ।
লেখালেখির শুরুয়াত ১৯৬৪–৬৫–তে স্কুলের হাতে লেখা পত্রিকায়। তাঁর লেখালেখির পেছনে উৎসাহ ছিল স্কুলের বাংলা শিক্ষক ব্যোমকেশ লাহার। স্কুল–পত্রিকা এবং ‘মা’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা দিয়ে তাঁর সম্পাদক জীবনের হাতেখড়ি। হাংরি জেনারেশন নিয়ে ‘ব্লুজ’ নামে একটি সাময়িকী প্রকাশ করেন কলকাতা থেকে। ১৯৭০–এ শুরু করেন ‘মহাপৃথিবী’, এবছরের গোড়ায় যে পত্রিকার ৫০ বছর পূর্তি উৎসব হয়ে গেল। ‘মহাপৃথিবী’ থেকে বের করেছেন অনেকের বই। কম্পোজ করা, প্রুফ দেখা, লেআউট—সব কিছু নিজেই সামলাতেন। জরুরি অবস্থার সময় রাষ্ট্রশক্তির রোষানলে প্রখ্যাত সাংবাদিক, ‘কলকাতা’ পত্রিকার সম্পাদক জ্যোতির্ময় দত্তর সঙ্গে আত্মগোপন করতে বাধ্য হন। পরে ধরা পড়ে ৭ মাসের হাজতবাস। 
তাঁর বইয়ের তালিকা— ‘সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ’ (১০৭১), ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’ (১০৭৩), ‘রাজনীতি’ (১০৭৫),  পাঠক, অক্ষরগুলি (১০৮২), ‘সঙ্গহীন যাত্রা’ (১৯৯১), ‘আমার বংশধররা’ (১৯৯৭), ‘আমি কেরর না অসুর’ (২০০৪), ’ ’‘ঝাড়বেলুনে জোট’ (২০১৩), ‘শম্ভু রক্ষিতের শ্রেষ্ঠ কবিতা’। অন্যান্যদের সঙ্গে— ‘সাম্প্রতিক তিনজন (১৯৭৩), উত্তর দক্ষিণ (১৯৭৪), সুব্রত রুদ্র শম্ভু রক্ষিত (১৯৭৫), সমসূত্র (১৯৭৯), স্বরাহত নিষাদ (১৯৯০)। একমাত্র উপন্যাস ‘অস্ত্র নিরস্ত্র’ এবং গল্প সঙ্কলন ‘শুকনো রোদ কিংবা তপ্তদিন অথবা নীরস আকাশ প্রভৃতি’। কবি, সম্পাদক চন্দন দাস তথ্যচিত্রে ধরে রেখেছেন কবির জীবন ও সৃজন। চন্দন দাসের উদ্যোগে সী বুক এজেন্সি থেকে কবিতা সংগ্রহ প্রকাশের কাজ শুরু হয়েছে।
না কোনও বড়ো সরকারি বেসরকারি পুরস্কার তাঁর কপালে জোটেনি। যিনি চিরকাল সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিকতাকে অবহেলার ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন, কারুর কাছে পাতেননি হাত তাঁর দিকে যে কেউ হাত বাড়াবেন না, তাঁকে পুরস্কৃত করবেন না সে তো জানাই। এক দিক থেকে ভাবতে গেলে ভালই হয়েছে। তাঁর বিদ্রোহী কৌমার্য থেকে গেছে অক্ষত। হ্যাঁ, লিটল ম্যাগাজিনের লোক তিনি, তাঁকে বাংলার লিটল ম্যাগাজিন ভুবন সম্মান জানিয়েছে দু’হাত ভরে। তার মধ্যে কয়েকটি— পশ্চিমবঙ্গ লিটল ম্যাগাজিন মেলার ‘মধুপর্ণী’ পুরস্কার, ‘শব্দগুচ্ছ’ ও ‘তিতীর্ষু’, ‘আপনজন’ সম্মান।
অন্যদের সঙ্গে একজন সৃজনশীল মানুষের তফাৎ এটাই যে মৃত্যুর পর থেকেই তিনি আবার নতুন করে বেঁচে ওঠেন তাঁর রেখে যাওয়া বিবিধ সৃজনের মধ্যে। শম্ভুদার প্রয়াণের পর থেকে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে তাঁকে নিয়ে যে ঢেউ উঠল, বিশেষ করে তরুণ কবিদের মধ্যে, তাতে এটা নিশ্চিত বাংলা সাহিত্যের উঁচু পাঁচিলে শম্ভুদার নাম সূর্যমুখী ফুলের মতো উজ্জ্বল। তরুণদের মধ্যে শম্ভুদাকে নিয়ে লেখালেখি, উচ্ছ্বাস দেখে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর আজকাল দৈনিকে মতি নন্দীর লেখার কথা মনে পড়ছে। মতি নন্দীর বক্তব্য ছিল, শ্যামলকে দেখতে তরুণদের যে ভিড় হয়েছিল তাতে তিনি নিশ্চিত শ্যামল বাংলা ভাষায় টিকে গেল। কারণ তরুণরাই তো আগামীর পতাকা বহন করে। হাতের সামনে সেদিনের কাগজটা নেই। আফসোস, হুবহু লেখাটা তুলে দিতে পারলাম না। শম্ভুদার মৃত্যুর পর তরুণদের কুসুমিত ওম বুঝিয়ে দিয়ে গেল প্রিয় কবি বাংলা সাহিত্যে ঠিকঠাক জায়গাতেই ইটটা পেতে গেছেন। যা সরানোর সাধ্য নেই কারুর। বেশ পোড়া, শক্তপোক্ত ইট।  ভাল কবিতা, সাহিত্য তো সেরকমই হবে। হয়। জলের মতো তরল তো হবে না। সাবানের ফেনার মতো কবিতা তো রোজই এই বঙ্গভূমিতে প্রসব হচ্ছে। এবং মিলিয়েও যাচ্ছে। এই অবস্থাতেও কোনও কোনও কবি তাঁদের স্বেচ্ছা ক্ষমতায় মৃত্য্ুঞ্জয়ী। শম্ভু রক্ষিত তাঁদের একজন। তাঁদের জন্য মিডিয়ার ফাঁপানো প্রচার, আস্ফালন কিছুই কাজে আসে না। দেবেশদা (দেবেশ রায়) একটি বিখ্যাত সাহিত্য সাপ্তাহিক, পরে পাক্ষিক কাগজের নাম করে বলতেন, ওরা লেখক তৈরি করতে পারে না। দেবেশদা কিন্তু জলপাইগুড়ি থাকার সময় ওই সাময়িকীতে নিয়মিত গল্প লিখতেন। তাহলেও তিনি তো বাস্তব অস্বীকার করতে পারেন না। তাই তাঁর এই সত্য কথন। এ কথা আরও সত্যে হয়ে গেছে এই বহু মাধ্যম যুগে। সামাজিক মাধ্যমের জোরালো প্রচারে। কোনও কাগজেরই আর এখন লেখক তৈরির ক্ষমতা নেই। 
শম্ভুদার কথা মনে হলেই চোখে ভেসে ওঠে আলুথালু, ভদ্রলোকদের ভাষায় ‘নোংরা পোশাক’–এ চেয়ারে এক পা তুলে কফি হাউসের মাঝখানে অর্থাৎ ঢুকেই বাঁদিকে বসে আছেন একেবারেই নিজস্ব ভঙ্গিতে। বিড়ি ধরিয়ে আরাম করে ধোঁয়া ছাড়ছেন মহাশূন্যে। যে ভঙ্গির মধ্যেই শহুরে তথাকথিত বাবুয়ানা, ভদ্রতার মেকি আচ্ছাদনকে টুঁটোফাটা করার নীরব সন্ত্রাস। যাবতীয় স্থিতাবস্থাকে নাড়িয়ে দেওয়া। মহাপৃথিবীর প্রুফ বা মহাপৃথিবী থেকে বেরোতে যাচ্ছে এরকম কোনও কবিতার বইয়ের প্রুফ দেখছেন। বা কারোর সঙ্গে কথা বলছেন। রকমারি সেই সব কথার মধ্যে আশ্চর্য় শোনালেও সত্যি যে কবিতা নিয়ে বিশেষ কিছু বলতেন না। ওই রকম অবিশ্বাস্য ভাষা ও আঙ্গিকের কবির কাছে থেকে কবিতা নিয়ে প্রায় কোনও কিছু না শোনাটা অবাক লাগত। নিজের ইচ্ছে হলে হয়তো দু’একটা কথা বললেন, নয়তো নয়। দুপুরবেলা আসতেন। আর বিকেল বিকেল চলে যেতেন ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরবেন বলে। দুপুরবেলাও যে একটানা থাকতেন তা নয়। মাঝেমধ্যে উধাও হয়ে যেতেন। আসলে যেতেন প্রেসে বা অন্যত্র। না, কোনওদিন কারুর সম্পর্কে কোনও অভিযোগ শুনিনি। কারুর সম্পর্কে কটূ মন্তব্য বা বিরোধিতাও শুনিনি কখনও। তাতালেও লাভ হত না। খুব বেশি হলে বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘ওর ব্যাপার। তোমার কী! তুমি কী করবে সেটা তোমার সিদ্ধান্ত। ছাড়ো তো এসব। যত্তো সব।’ তাঁর কবিতার মতোই কেমন যেন এক রহস্যময় পুরুষ মনে হত তাঁকে। যাঁর কাছে একটা স্তর অবধি যাওয়া যায় যায়। তারপর নয়। কীভাবে যেন এক অদৃশ্য প্রাচীর ঘিরে রাখত। নিজের মতো করে ‘মহাপৃথিবী’ সম্পাদনা করেছেন। কারুর কোনও মতামতে ধার ধারেননি। শেষ দু’পাতা জুড়ে থাকত নিজের কবিতা। নিজের কোনও স্থায়ী রোজগার নেই, অথচ কোন এক অদৃশ্য ম্যাজিকে নিয়মিত বের করতেন ‘মহাপৃথিবী’। এবং অবাক কাণ্ড— ‘মহাপৃথিবী’ থেকে বের করতেন কবিতার বই। কবিদের কাছ থেকে কোনও টাকা না নিয়ে। বাংলা বাজারে টাকা নেওয়াটাই যেখানে দস্তুর সেখানে তাঁর জীবনযাপনের মতোই শম্ভু রক্ষিত এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রমী। চলুন এই প্রসঙ্গে কবি–সাহিত্যিক তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা শুনি, যা তিনি শম্ভুদার প্রয়াণের পর ফেসবুকে লিখেছেন—‘একবার হঠাৎ বলল, একসঙ্গে ষোলটা কবিতা দাও। তোমার জন্য একফর্মা বরাদ্দ। আমার পক্ষে অভাবনীয়। পরের সংখ্যা ছাপা হওয়ার পর বলল, আরও চব্বিশটা কবিতা দাও। ছাপা কবিতাও দিতে পারো।
আমি বুঝিনি কেন। দিলাম। তার মাসখানেক পর হঠাৎ বিশ–পঁচিশটা বই দিয়ে বলল, তোমার বই করে দিলাম। বইয়ের প্রচ্ছদে লেখা ‘মা বনবিবির হাজার বাহন’।
আমার তৃতীয় কবিতার বই। আগের দুটো বই নিজের পয়সায় ছেপেছিলাম। বললাম, কত খরচ হয়েছে, বলো।
বলল, কিছু দিতে হবে না। তোমার বই বিক্রি করে আমি টাকা তুলে নেব।
শম্ভু রক্ষিতের দারিদ্র্যের কথা আমরা জানতাম। হাওড়ায় থাকত মামার বাড়িতে।
আমি এই ঘটনায় খুব অস্বস্থিতে। জোর করেও কোনও লাভ হয়নি।’     
এই ভাবে শতাধিক বই বের করেছেন। যাঁর নিজের কোনও রোজগারের ঠিক নেই , তাঁর এই ভালবাসা, মায়া জড়ানো কাজের দিকে তাকাতে তাকাতে মনে হয় এই পৃথিবীতেই কি এসব ঘটেছিল! কী রকম যেন অলীক লাগে। যদিও এ ঘোর বাস্তব। আসলে শম্ভু রক্ষিতদের মতো প্রতিভাদের কোনও মানবীয় ওজনের নিক্তিতে মাপতে যাওয়া বোকামি।     
একবার কবিদের দলে ভিড়ে যাচ্ছিলাম এক জেলা সদরে। একথা সেকথা পর শম্ভুদার সমসাময়িক এক কবি ঠাট্টার সুরে বলেছিলেন—কী যে হাবিজাবি লেখে। কিছু বোঝা যায় না। শব্দের মাথামুণ্ডু নেই। নেই ছন্দের কারিকুরি। আমি কিছু বলতে গিয়েই থমকে গেলাম। কারণ ওই গাড়িতেই ওই কবির সমর্থক জুটে গেল। যেভাবে তরলদের যায় আর কী। না, তাঁর মতো কবিদের দরকার নেই বোঝার। বুঝতে গেলে মাথা ঘামাতে হয়। তরল পদার্থ তো রোজ হাতের সামনেই পাচ্ছেন তাহলে মাথা ঘামাবেন কেন! বাংলা সাহিত্য সমকালে জীবনানন্দ দাশ, বিনয় মজুমদারকে বোঝেনি, শম্ভু রক্ষিত তো কোন ছাড়—ছিল আমার সংক্ষিপ্ত উত্তর। শম্ভু রক্ষিতের কবিতা মহাবিশ্ব, মহাকালের আখরে লেখা। এর পাঠোদ্ধারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে কত শতাব্দী কে জানে। ১৯৭১–এ প্রকাশিত তাঁর দ্বিতীয় বই ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’ নিয়ে শম্ভুদা নিজেই তো বলে গেছেন, ‘পাঁচহাজার বছর পরে হরপ্পার মতো আবিস্কৃত হবে এই বইয়ের কবিতা’। জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ও কি সবাই বোঝেন? নাকি সবার জন্য লেখা? কিছু লেখা থাক না অধরা। বোদ্ধা পাঠকের জন্য। মেধার গভীরে অজানা ঘুঙুরে বেজে ওঠার জন্য। সে জন্য চাই চর্চা। চাই পড়াশোনা। মাত্র ২৩ বছর বয়সে লেখা  মহাকাব্যিক, সেই সঙ্গে অলৌকিক বই ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’র জন্য চাই দীক্ষিত পাঠক।   
এখানেই যোগ করতে চাই কবি, সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দত্তের পর্যবেক্ষণ, ‘যিনি আমাদের কবিদের মধ্যে, বলা চলে যে সবচেয়ে পাগল, সবচেয়ে অনন্য, যার জীবনযাত্রার প্রণালী, যার লেখার ভঙ্গি, যার হাঁটা সবকিছু আমার কাছে মানুষ হিসেবে একদিকে হিরো, অন্যদিকে চার্লি চ্যাপলিন। অতি আশ্চর্য কবিতা বইয়ের লেখক ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’।
তাঁর কবিতা অতি রহস্যময়, দুর্বোধ্যতাঁর ভাষা বিচিত্র এবং অনন্য। শব্দ চয়ন অন্যলোকে। মনে হয় অনেকটা বাংলায় কিন্তু এটা গন্ধর্বদের ভাষাও হতে পারে।’
যে বাঙালি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতে গিয়ে বলে, ওরে বাবা, এ বিরাট ব্যাপার। চর্চার দরকার। ব্যাকরণ না জানলে এ বোঝার চেষ্টা করা উচিত নয়। সেই বাঙালিই সাহিত্যের কাছে কেন কোনও দীক্ষা আশা করে না? কেন আশা করে কোনও চর্চা ছাড়াই বুঝে যাবে সাহিত্যের গলিঘুঁজি? শম্ভু রক্ষিতের মতো কবিদের বুঝতে গেলে চর্চা করতে হবে। অনুশীলন করতে হবে। এ ছাড়া কোনও পথ নেই আর।
বাংলা সাহিত্যের অলিগলি, চর্চার চোরাবালিতে দাঁড়িয়ে শম্ভু রক্ষিত নামক এক মহাপৃথিবীর আলোকবর্তিকার স্থানাঙ্ক নির্ণয় হবে কীভাবে? ভাবীকাল তাঁক মনে রাখবে কীভাবে? ভাষার নানা স্তর থাকে। কোন স্থরে একজন কবি–সাহিত্যিক পিনাকেতে টঙ্কার লাগাবেন তার ওপর নির্ভর করে তিনি টিকে থাকবেন কিনা। শম্ভু রক্ষিত তাঁর সৃজনের পর সৃজনে ভাষার গভীরে, আঙ্গিকের অভ্যন্তরে, বাক্যের পর বাক্যের নিবিড় নির্মাণে এমন এক আশ্চর্য় পৃথিবী, এক অদ্ভুত পরিসর বিছিয়ে রেখে গেছেন যে পাঠক আবিস্কার করবেন, আপনাকে এই জানা ফুরোবে না, ফুরোবে না। এবং এই না ফুরনো থেকেই নানা ভাবে নানা রূপে আবিস্কৃত হবেন শম্ভু রক্ষিত তাঁর সমস্ত রং রূপ রস নিয়ে। ভাষা এবং ভাবনার অসীম পরিসর আর সীমার মাঝে অসীমের চিরকালীন দ্বন্দকে তিনি কবিতায় রূপ দিলেন। এবং নানা রকম শব্দ নিয়ে এলেন বাংলা কবিতায়। জ্যোতির্ময় দত্ত যাকে বলছেন, ‘অনেকটা বাংলায় কিন্তু এটা গন্ধর্বদের ভাষাও হতে পারে’। 
রবীন্দ্রনাথ যে বিশ্ব চরাচরের ভাবনার কথা বলেছেন, লিখেছেন শম্ভু রক্ষিত যেন সেই ভাবনায় পাখা মেলেছেন।       
শুরু থেকেই নিজস্ব আদর্শের আলপথ ধরে এগিয়েছেন। যতই হোঁচট খান না কেন সরে আসেননি। ‘আমার জীবন বিশুদ্ধ ভালবাসার’—এই বিশ্বাসে হেলায় উপেক্ষা করেছেন যাবতীয় জাগতিক ঐশ্বর্য। অবর্ণনীয় দারিদ্র্যের মধ্যেও মুখে অপার্থিব হাসি লেগে থাকা শম্ভু রক্ষিত মনে করতেন, পৃথিবী জুড়ে কেবল একটিই মহৎ কবিতা লেখা হচ্ছে আর প্রত্যেক কবি তাতে যোগ করছেন তার লাইন।
এই বছরের গোড়ায় ‘মহাপৃথিবী’র ৫০ বছর পূর্তি উৎসব উপলক্ষে কবি, সম্পাদক চন্দন দাসের উদ্যোগে যে উদ্‌যাপন হয় সেই সময় জ্যোতির্ময় দত্ত তাঁর শুভেচ্ছা বার্তায় যা লিখেছিলেন সেটাই আমাদের মনের কথা, সারা বাংলার কথা, ‘আজকের দিনটা যেন প্রতি বছর তিথিতে পরিণত হয়। এই কবির নামে মেলা, নানা কবিতা পত্রিকা, আর কবিতার অনুশীলন যেন হয়।’ প্রতি বছর হোক শম্ভুদার নামে হোক সাহিত্য মেলা, বের হোক কবিতা পত্রিকা, হোক অনুশীলন কবিতার। 

Post a Comment

3 Comments

  1. এই লেখার জন্য ধন্যবাদ জানবেন। শুধু একটা জায়গায় 'শম্ভু রক্ষিতের মতো কবিদের' লেখা হয়েছে, এখানে আমার আপত্তি রইল। শম্ভু রক্ষিত এর প্লুরাল হয় না। 🙂

    ReplyDelete
  2. দেবাশিসবাবুর লেখাটি চমৎকার।

    ReplyDelete