সম্পাদকীয়

সব হতে দূর

আবীর মুখোপাধ্যায় । ১০ জুন, ২০২০ । শান্তিনিকেতন 


কডাউনের বাজারে জোর করে এই লেখা।
‘জোর’ কথাটা খুব সংগত কারণেই লিখলাম। কেন না, বিশ্বভারতী অথবা শান্তিনিকেতন নিয়ে নিজের অনুভবের কিছু লেখায় এখন আর মন সরে না আমার।
দু’দশক সাংবাদিকতার সূত্রে, ব্যক্তিগতভাবে বেশ কয়েকজন উপাচার্য ও বিশ্বভারতীর অন্দরমহলকে খানিকটা জানার সুবাদে, লেখার কথা এলে, নিভৃতে নিজেকে শুধাই, কাদের নিয়ে লিখব? কার কথা লিখব? কেন লিখব?
এ কথা সত্যি, এখন খুব দরকার না থাকলে শান্তিনিকেতনে যান না কেউ কেউ!
তাঁদের যুক্তি, রবিঠাকুর না পড়া-না জানা, মহর্ষিদেব ও রবীন্দ্রের আদর্শে না হাঁটা কিছু চতুর-মূর্খ লোকের চতুরালি শুনতে-দেখতে আর ইচ্ছে হয় না। এ যেন রবীন্দ্র-আদর্শ ভুলে থাকা অধুনা শান্তিনিকেতন নামে একটি বিষণ্ণ খাঁচা। দেখতে, সামনে নাই বা গিয়ে দাঁড়ালাম! হারিয়ে তো গেছে আমাদের সব-পেয়েছির দেশ!
যখন সভ্য দেশের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের নিয়ে সেই দেশের নাগরিকদের শ্রদ্ধা দেখি, নতজানু হয় মাথা। মনে মনে কুর্নিশ জানাই। এদেশে? কি নেই—কি ছিল না আমাদের? শ্রদ্ধা! একটা গোটা জাতির অস্তিত্বলোপ পাবে? ভয় হয়, বড় ভয় লাগে!
বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘সব-পেয়েছির দেশ’-এ লিখছেন, ‘‘কলকাতার জীবনে বাঁধা সময়ে বাঁধা কাজের অবিরাম উৎকন্ঠার পরে, সাহিত্যিক বাকবিতন্ডার, সামাজিক আচার-ব্যবহারের অফুরন্ত স্নায়বিক টানা-হেঁচড়ার পরে, জীবিকা-অর্জনের ঘৃণ্যতা আর জীবন-রচনায় পদে পদে ব্যর্থতার পরে শান্তিনিকেতনে এসে কী যে ভালো লাগলো।’’
প্রিয় লেখক লিখেছেন, ‘‘এখানে ‘নগরের হৃদয়হীনতা নেই, নগরের নৈর্ব্যক্তিকতা আছে। পাড়াগাঁর ধূর্ত কুটিলতা নেই, অনাড়ম্বরতা আছে। শান্তিনিকেতন গ্রাম নয়, শহর নয়, ঠিক বাংলাদেশও নয়, আবার ভারতের কোনো সুদূর অপরিচিত আশ্চর্য তপোভূমিও নয়, যদিও এক হিশেবে ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী বটে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে যা-কিছু মূল্যবান সব এখানে প্রকাশিত, কিন্তু তাতে মিশেছে নবীন ইওরোপের প্রাণপূর্ণতা।’’ এই ছিল সে দিন কবির সাধনার আশ্রম। যেখানে নিহিত ছিল, ‘উর্মিল লাল কাঁকরের নিস্তব্ধ তোলপাড়’!
আর এখন? হৃদয়হীন মানুষের দালাল নগর! ভুবনডাঙা পেরিয়ে টোটো কোম্পানির মিছিল এগোলে এখন মনে হয়, এ সবই মিথ্যে! কেন যাব আর!
নব্য আধুনিকতা আর বিত্ত-সম্ভোগের অনুপ্রবেশ শান্তিনিকেতন আশ্রমে সেই সত্তরেই!
সত্তরের দশক থেকেই এই লুণ্ঠন। পুঁজির থাবা! যার অনিবার্য পরিণাম, ‘সব-পেয়েছির দেশ’ এখন বহুতল আর রিসর্ট ঘেরা যান্ত্রিক-কংক্রিট নগর। যাতে করে বিস্মৃত এখন শান্তিনিকেতন আশ্রমের ইকোলজি, বিশ্বভারতীর হেরিটেজ, ভুবননগরের উজাড় করা প্রকৃতি, রবীন্দ্র-ভাবনা, মূল্যবোধ! সব, সব এখন অতীত। এ যেন, কবির মৃত্যুর পর তাঁর আশঙ্কাই ধীরে ধীরে মহাসত্যে রূপান্তরিত হল।
এমন যে হবে সত্যদ্রষ্টা কবি যেন সেটা বুঝতে পেরেছিলেন।
১৯৩৮-এ রথীন্দ্রনাথকে একটি উইলের খসড়া চিঠিতে লিখেওছিলেন সে কথা, ‘‘...আমার যা দেবার আছে আমি পাঁচ ভূতের হাতে দিয়ে যেতে চাইনে। বিশেষত আমার অবর্তমানে ভূতের কীর্তন কী রকম হবে এখন থেকে তা কল্পনা করতে পারিনে।... কনস্টিটিউশনের রাস্তা বেয়ে এমন সকল লোক এখানকার কতৃত্ব অধিকার করতে পারে যাতে করে গোলমাল পাকানো অসম্ভব নয়- এইজন্য বিনা দায়ে সমস্ত স্বত্ব রথীদের হাতেই দিতে চাই।’’
রথীন্দ্রনাথের হাতে শান্তিনিকেতনের আশ্রমের ভার দিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
তবু শেষরক্ষা হয়নি। পঁয়ত্রিশ বছর ‘বিশ্বভারতীর বোঝা’ টেনে একরকম তিতিবিরক্ত হয়েই শান্তিনিকেতন ছেড়ে নীরবে চলে যান কবিপুত্র। ৬ বছরের জন্য উপাচার্য নিযুক্ত হয়ে মাত্র দু’ বছরেই হাঁপিয়ে ওঠেন তিনি। উপাচার্য পদ থেকে পদত্যাগ করবার আগে ঘনিষ্ঠ, সাহিত্যের অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ দত্তকে বলেছিলেন, ‘‘আজ আমি ক্লান্ত, আর আমি পারছি না, এবার আমি ছুটি চাই।... কিছুই করিনি, শুধু বিশ্বভারতীর বোঝা টেনে টেনেই জীবন কাটিয়ে দিলাম।... কিন্তু আর নয়, এবার আমি মুক্তি চাই!’’
দিনে দিনে বাড়ল দেনা। বিশ্বভারতী যেমন হারিয়েছে তার গৌরব, শান্তিনিকেতন হারিয়েছে তার ‘সব হতে আপন’ অঙ্গন! অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না! এই খেদ প্রথম যুগের প্রাক্তনীদের স্মৃতি-কথনেও পড়ি! ‘আমাদের শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থে আশ্রমের প্রাক্তনী মহাশ্বেতা দেবী শেষ অধ্যায় ‘কী পেয়েছি, কী বুঝেছি’-তে লিখছেন, ‘‘স্বীকার করাই ভালো। শান্তিনিকেতনে আমি খুব একটা যাই না। ... মনে করি। বিশ্বভারতীকে একটি অন্য চরিত্রের বিশ্ববিদ্যালয় করা যেত... তেমন বিশ্ববিদ্যালয় হলে আয়তনেও বিশাল হত না। অথচ প্রকৃত আগ্রহী ও উৎসাহীজনেরাই আসতেন।’’
শান্তিনিকেতনকে রক্ষার দায়িত্ব তো সবার আগে ছিল বিশ্বভারতীর। কিন্তু, বিশ্বভারতীর সংকট যে তার মূলেই উপ্ত। এক কত্তা যদি বা, রবীন্দ্র-আদর্শে হাঁটার উদ্যোগ নেন, তো অন্য কত্তা এসে রবীন্দ্র-‘ইতিহাস’-এর পাতায় নিজেকে জড়িয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন! সুদূর অতিত থেকে শুধু পৌষমেলা অথবা বসন্তোৎসব-এর ইতিহাস দেখুন, সব উত্তর মিলে যাবে। কর্তাদের এই খামখেয়ালিপনায় সুযোগ বুঝে শিবির বদলান ঘনিষ্ঠরাও। নতুন কর্তার নাম ঘোষণা হওয়ার আগেই এখানে কেউ কেউ আছেন— সোজা এয়ারপোর্ট চলে যান রিসিভ করতে! সঙ্গে রয়েছে পাড়াতুতো রাজানীতি। পরিবারতন্ত্র-দাদারাজ পেরিয়ে যা এখন কেন্দ্র বনাম রাজ্যের রঙে ছোপানো!
বিশ্বভারতী বহরে যতো বেড়েছে, সমস্যার ধরনেও এসেছে বৈচিত্র। যাতে করে শান্তিনিকেতন আশ্রমের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে দিন দিন। সংবাদমাধ্যমের কাছে সেই বিপন্নতার কথা বলে মাঝে মধ্যেই আন্দোলনে নামেন কিছু মানুষ। তাঁরা দাবি সনদে রবীন্দ্র-আদর্শ অথবা আশ্রমের বিপন্নতার কথা নামমাত্র বললেও, প্রধান দাবি হয়ে ওঠে ‘বেতন বৃদ্ধি, চাকরী, ভাতা’-র কথাই।
দশকের পর দশক ধরে এভাবেই কেউ দুঁদে ছাত্রনেতা থেকে ঘনিষ্ঠ আপ্ত-সহায়ক! কেউ পাঠভবনের শিক্ষক থেকে রবীন্দ্র-অধ্যাপক। নব-স্বাক্ষর কর্মী থেকে বিশ্বভারতীর হত্তা-কত্তা-বিধাতা! তেমন অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে, বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য-ইতিহাসবিদ নিমাইসাধন বসু তাঁর ‘ভগ্ননীড় বিশ্বভারতী’- গ্রন্থের ভূমিকায় লিখছেন, ‘‘১৯৫৮ সালের ১৩ এপ্রিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এস. কে. পাতিল শান্তিনিকেতন এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন অতুল্য ঘোষ, অনিল চন্দ প্রমুখ। সকলের সঙ্গে এক আলোচনা বৈঠকে পাতিল জিজ্ঞাসা করেছিলেন বিশ্বভারতী তার বৈশিষ্ঠ্য বজায় রেখে চলবে তো? তা না হলে কী সার্থকতা? উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন প্রভাত মুখোপাধ্যায়। তিনি পাতিলকে জানান ‘খুব চেষ্টা হচ্ছে।’ জানতে ইচ্ছে করে, এখনও!’’
প্রবীরকুমার দেবনাথের ‘অনন্য প্রভাতকুমার’ বই আমাদের জানাচ্ছে, ঐ দিন বাড়িতে ফিরে নিজের ডায়েরিতে কবিজীবনীকার প্রভাতকুমার লিখেছিলেন, ‘বললাম তো বাইরের লোকের কাছে- কিন্তু ছাই (শাক) দিয়ে মাছ ঢাকা যাবে কি?’
ছাত্র-ধর্মঘট, কর্মী অসন্তোষ, অধ্যাপক ও কর্মী বিক্ষোভ দেখতে দেখতে বিশ্বভারতীর অন্দরমহলের সারবত্তা নিয়ে লিখতে গিয়ে নিমাইবাবু লিখছেন, ‘‘রবীন্দ্র-আদর্শ ও উদ্দেশ্য থেকে বিশ্বভারতীর সরে আসা বিচ্যুতি শুরু হয়েছিল স্বয়ং গুরুদেবের সময় থেকেই। তিনি নিজেও এটা উপলব্ধি করেছিলেন। কিছুটা অসহায়ভাবে প্রত্যক্ষ করেছিলেন।’’
কেমন সেই বিচ্যুতি? ‘ভগ্ননীড় বিশ্বভারতী’-তে অনতি পরেই সেই চরম পাঠ!
১৩৪৭ সালের ৮ শ্রাবণ শান্তিনিকেতনের মন্দিরে এক ভাষণে কবির সেই উপলব্ধি, ‘‘যে আদর্শ বহন করে এখানে এসেছিলুম, আমার জীর্ণ শক্তির অপটুতা থেকে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে দৃঢ় সঙ্কল্পের সঙ্গে নিজের হাতে বহন করবার আনন্দিত উদ্যম কোথাও দেখতে পাচ্ছিনে।’’
কিভাবের মাত্র কয়েক দশকে এমন হল?
১৯৯৩-এ প্রান্তিক উপনগরীর জন্ম। ২০০২-এ প্রান্তিক স্টেশন সংলগ্ন খোয়াই ক্ষত-বিক্ষত করে সাত একরের আবাসন। পল্লী সংগঠন, মুক্ত প্রকৃতি-খোয়াই সব কিছুকে মুছে ফেলে চারদিকে শুধু প্রমোদকানন। সেই যে সুধীর চক্রবর্তী লিখেছিলেন না, ‘‘গুরুদেবের শান্তিনিকেতন আজও ‘আমাদের শান্তিনিকেতন’ বা ‘মোদের সব হতে আপন’ হয়ে উঠল না। বরং ব্যথিত অনুভবের সামনে হয়ে উঠল টুরিস্ট স্পট কিংবা আবাসন সৌধ রচনার অবাধ ভূমি। কলকাতা বা অন্য জায়গার স্বচ্ছল উচ্চবিত্ত নাগরিকদের মৃগয়া কেন্দ্র আজকের শান্তিনিকেতন’। লজ্জায় বিমূঢ় হয়ে মুখ ঢেকে যায়! বিশ্বভারতীর ভিতরমহলের পরিবেশ বিষিয়ে ওঠার মূলে কেন বারবার খোয়াই বা শান্তিনিকেতনের পরিবেশ প্রসঙ্গ এসে পড়ে?
তার কারণ বিশ্বভারতীর পঠন-পাঠন, রবীন্দ্র-শিক্ষার মূল নিহিত রয়েছে প্রকৃতি-পাঠ-শালায়! প্রতিটি ভবনের নির্মিতিও ছিল সেভাবেই। যার অনেকটাই এখন লুপ্ত। ছাত্রাবাসগুলিও যেন বহুতল নগরের কথা বলে। খুব কি দরকার ছিল এই বেঢপ নির্মাণের? নিত্য বাড়ছে একের পর এক ভবনে এয়ারকন্ডিশন, ভবন থেকে ভবন যেতে চারচাকার সংখ্যা। উল্টোদিকে কমছে গাছের সংখ্যা। কবির মন-নিকেতন শান্তিনিকেতনকে রবীন্দ্র-আদর্শে রেখেও তো সংরক্ষণ করা যেত। তর্ক নয়, মেনে নিন রবিঠাকুর অনুভবের জিনিষ। আমরা রাখতে পারলাম না— যার জন্য চিরকাল কাঙাল রইল আশ্রম! আপামর বাঙালি!
বিশ্বভারতী এলাকার দু’ হাজার একর জমি শ্রীনিকেতন ও শান্তিনিকেতন উন্নয়ন পর্ষদের নগরায়ন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। এদিকে ১৯৫১ সালের বিশ্বভারতী যে কেন্দ্রীয় আইন সেটি অনুযায়ি, বিশ্বভারতীর এলাকা নির্দেশিত হয়েছে, উত্তরে কোপাই, পূর্বে রেল লাইন, দক্ষিণে বাঁধগোড়া আর পশ্চিমে বল্লভপুর-বাঁধগোড়ার সীমারেখা। পর্ষদ এই এলাকাভুক্ত বনডাঙ্গা-প্রান্তিকের সাঁওতালদের চাষের জমি অধিগ্রহণ করে। এতে করে এই ধূ ধূ মাঠ কয়েক বছরেই হয়ে যায় আবাসন-পল্লি।
দু’ দশক আগে কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের হয় জনস্বার্থে। হাইকোর্ট সেটি খারিজ করে দেয়। এর ঠিক পরেই নগরায়নের কোপ পড়ে খোয়াই অঞ্চলে। প্রান্তিকের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। খোয়াই আন্দোলনে সরব হয়েছিলেন বিশিষ্ট জনেরা। হাইকোর্টের দ্বারস্থ হলে, হাইকোর্ট সেই জনস্বার্থ মামলাটিও খারিজ করে দেয়। বুদ্ধিজীবিরা সুপ্রিমকোর্টের দ্বারস্থ হলেন। সুপ্রিমকোর্ট বিধান দেয়, শান্তিনিকেতনের বৈশিষ্ট আর রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সুপারিশ মেনে পরিবেশের ভারসাম্য মেনে নির্মাণ করতে হবে শান্তিনিকেতন এলাকায়। সর্বোচ্চ আদালত জানায়, ‘The West Bengal Pollution Control Board stated increasing constructional activity in Sriniketan-Santiniketan area may cause serious disruption in natural drainage system. Urbanization will have impact on ambient air quality. The suspended particulate matters even on some days of December was more than the permissible in sonar taree Area’. এমনকী সুপ্রিম কোর্ট এই মর্মে দূষণপর্ষদের সুপারিশ উল্লেখ করে বলে, ১।  No more housing projects are undertaken until SSDA’S santiniketan development perspective plan.. was approved. ২। Project to ensure minimal damage to the remaining Khowai so as to preserve the natural beauty, heritage and natural drainage system. ৩। A satellite township be build at a suitable distance from the Visva Bharati area.
প্রান্তিকের লাহা বাঁধ আরেকটি মাইলস্টোন শান্তিনিকেতনের ছবি বদলে। চারপাশে এখন একের পর এক আবাসন প্রকল্প। খোয়াই হারিয়ে নিত্য তৈরি হচ্ছে নির্মাণ। সোনাঝুড়ি এলাকায়, বন কেটে একের পর এক রিসর্ট-রেস্তোরাঁ নির্মাণ হচ্ছে! শান্তিনিকেতনকে একসময় সাঁওতালদের অরণ্যের অধিকারে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে দেখেছিলাম! লাল মাটির দেশে কোথায় যে গেলেন তাঁরা! শ্যামলী খাস্তগীর, সোমনাথ হোড়— কোথায় যে গেল সেই সব মানুষরা! মনে পড়ছে, রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর ভবিষৎ নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন হয়েই লিখেছিলেন, ‘Accept this institution under your protection, giving it an assurance of permanence if you consider it to be a national asset’. গান্ধীজি উত্তরে লিখছেন, ‘The touching note put in my hands as we parted has gone straight into my heart. Of course, Visva Bharati is a national institution’. এই তার ভবিতব্য! বিশ্বভারতীর ভবিতব্য কি? এর প্রয়োজন কি ফুরিয়েছে?
তাঁর গ্রন্থের শেষে এমন একটি দরকারি প্রশ্ন তুলেছিলেন নিমাইবাবু। এই লেখার শেষ পর্বেও এমন একটি উত্তর খুঁজতে গিয়ে নিমাইবাবুকে ফিরে পড়ি। উনি, রবীন্দ্রউক্তি ‘হৃদয় কর্ম ও জীবন দিয়ে নানা কর্মীর সহায়তা’-র কথা বলে বলছেন, ‘বিশ্বভারতীর সবচেয়ে বড় প্রয়োজন, সবচেয়ে বড় অভাব সেই সহায়তা, সহমর্মিতা’। প্রাক্তন উপাচার্য লিখছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ, তাঁর আদর্শ, তাঁর শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের প্রতি মমতা ও কর্তব্যবোধের দৈন্য’।
এই প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখতে তাঁর নিদান, ‘কিছুরই প্রয়োজন হবে না।... প্রয়োজন, রাজনৈতিক বিরোধ-বিতর্ক ও ক্ষমতা বিস্তারের জগৎ থেকে বিশ্বভারতীকে মুক্ত রাখা। একটু ঔদার্য, পারস্পরিক সহিষ্ণুতা, সম্প্রীতি ও বিশ্বভারতীর প্রতি আন্তরিক মমতা’।
তাঁর বিশ্বাস, তাহলেই ‘ভগ্ননীড়’ এই আশ্রমে ছিন্ন তার জোড়া হয়ে একদিন ‘প্রাণের সঙ্গে প্রাণ, মনের সঙ্গে মন এক হয়ে বিশ্বভারতী যথার্থই বিশ্বমানবের নীড়ে পরিণত হবে’।
চোখের জলে বিরহ নামে, নিভৃতে প্রতীক্ষায় আছি!

ছবি : সমীরণ নন্দী

Post a Comment

2 Comments

  1. এ যেন রবীন্দ্র-আদর্শ ভুলে থাকা অধুনা শান্তিনিকেতন নামে একটি বিষণ্ণ খাঁচা,আর যত সব ভাঁড়ের বাসা
    এই হচ্ছে এখনকার শান্তিনিকেতনের প্রকৃতরূপ।

    ReplyDelete
  2. খুবই সময়োচিত লেখা। সত্যি শান্তিনিকেতন এখন একটি টুরিস্ট ডাস্টবিনে পরিণত হয়ে।

    ReplyDelete