তাঁর গান, নাস্তিককেও নাড়া দিত


গানের পাখি/ ৭

তাঁর গান, নাস্তিককেও নাড়া দিত

আবীর মুখোপাধ্যায়

স্বর্ণযুগের বাংলা গানের সুর ও কথার মতোই মিঠে সেই সব গান তৈরির গল্পও। সুরকার, গীতিকারদের সঙ্গে শিল্পীদের সম্পর্ক— জন্ম দিয়েছে যামিনি পটে জড়ানো বিচিত্র উপাখ্যানের। এই ধারাবাহিকে আমরা ফিরে ফিরে শুনব হারানো দিনের মনকেমনের গান। চেয়ে চেয়ে অপলক দেখব সুরের আকাশে শুকতারা। আর একলা হয়ে নিবেদন করব একে অপরকে গানের রেকাব।


ম্ভু মিত্র IPTA থেকে বেরিয়ে এসে নতুন নাটকের দল শুরু করেলেন। কলিম শরাফী তাঁর প্রথম সঙ্গী। একদিন শম্ভু মিত্র কলিমকে বললেন,
“তুমি কয়েকটা ছেলে দেবে?’’
কলিম একটু ভাবছেন। শম্ভু মিত্র বললেন—
‘‘যারা খুব ডিভোটেড, খুব অনেস্ট, যারা কখনও নাটক করেনি, আমি ওদের শিখিয়ে নেব। নাটক করতে চায়, নাটক ভালোবাসে এরকম ছেলে।”
স্মৃতি থেকে ইতিহাস তৈরির গল্প শুনিয়ে সমসাময়িক যোদ্ধা খালেদ চৌধুরী লিখছেন, ‘‘কলিম তখন রেজিস্ট্রার অফ জয়েন্ট স্টক-এ চাকরি করত (পরে শুনেছিলাম যে, সেখানে ইউনিয়ন করতে গিয়ে কলিমের চাকরি যায়)। কলিম ওখান থেকে তিনজনকে এনেছিল। মোহাম্মদ জাকারিয়া, অমর গাঙ্গুলি আর অশোক মজুমদার। এই তিনজনকে নিয়েই ‘বহুরূপী’র সূত্রপাত। কলিমকে নিয়ে শুরু করলেও পথিক’ নাটক ছাড়া আর কোনও নাটকে কলিম অভিনয় করেনি। অভিনয়-প্রবণতা ওর ছিল না। ও ছিল গানের লোক।’’
‘গানের লোক’ হলেও কলিমের জীবন ছুঁয়ে ছিল শিল্পের নানা দর্শনে। রাজনীতির দীক্ষায় তাঁর বিশ্বাস ছিল অটল। কলিম লিখছেন, ‘‘রাজনৈতিক দীক্ষার ফলেই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প কখনো স্পর্শ করতে পারেনি আমাদের। রাজনৈতিক এই চেত-নাই আমাদের বুঝতে শিখিয়েছে যে, সাম্প্রদায়িকতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার জন্য দায়ী কে? এবং যারা এই প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব যারা রাখছেন তারা প্রকৃতপক্ষে দেশপ্রেমিক তো ননই, তাঁদের অন্য ভাষায় বলা যেতে পারে যে, সাম্রাজ্যবাদের দালালীই করছেন তারা। সামাজ্যবাদকে শক্তিশালী করবার জন্য যারা সহায়তা করেছেন তাদেরকে পরবর্তীকালে আমরা চিনেছি এবং তাদের বিরুদ্ধেই আমরা লড়াই করেছি এই বাংলাদেশেও।’’


দেশ বিভাগের পর কলকাতায় আবার শুরু হল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ১৯৪৯-৫০ হবে, কলিম তখন বিয়ে করেছেন। পিতা হলেন। কিন্তু কাঠ বেকার!
বন্ধুদের কথায়, কলিমের এমনই অবস্থা একটা টিউশনি পর্যন্ত পাচ্ছেন না। সে সময় বন্ধুরাই তাঁকে বলেন, পাকিস্তানে চলে যেতে। তাতে অবশ্য মন নেই কলিমের। স্ত্রী কামেলা খাতুন ও একমাত্র শিশুকন্যাকে নিয়ে তবু যেতে হল। তখনও বাংলাদেশ হয়নি। প্রবল এক জীবনযুদ্ধে নেমে পড়লেন কলিম। ঢাকায় ক্যাজুয়াল আর্টিস্ট হিসেবে যোগ দিলেন রেডিওতে। তারপর ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম। সেখানে গড়ে তুললেন ‘প্রান্তিক’ নামে একটি সংগঠন। ১৯৫৬ সালে শেরে বাংলার মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে সেকশন নাইনটি টু জারি করার ফলে কলিমকে আত্মগোপন করতে হয়। সেই বছরের শেষ দিকেই তিনি ঢাকায় ফিরে এলেন। আরও একটি সংগঠনের জন্ম হল। নাম ‘হ-য-ব-র-ল’। এবং এই সংগঠনের ব্যানারেই মঞ্চস্থ করলেন রবীন্দ্রনাথের ‘তাসের দেশ’। সে সময় কলিম শরাফীর সহযোগী ছিলেন ড. আনিসুর রহমান ও ড. রফিকুল ইসলাম। ১৯৫৭ সালে চলচ্চিত্রে গাইলেন কলিম। রবীন্দ্রনাথের গান। গান শুনে কথা হারা বাংলাদেশ!
সে সময় ঢাকার জীবন সুখের ছিল কলিমের। ঢাকা রেডিও স্টেশনে ক্যাজুয়াল আর্টিস্ট হিসাবে কাজ করতে করতে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যুক্ত থাকার অপরাধে তাঁকে নানাভাবে হেনস্থা করা হয়। রেডিওতে তাঁর গান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, সুকান্ত ভট্টাচার্যর ‘অবাক পৃথিবী’ গাওয়ার অপরাধে! গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপন করতে হয়েছিল তাঁকে। ষাটের দশকে পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হল! সে সবের পরেও রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চললেন কলিম। খালেদ চৌধুরীকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে কলিম তাঁর রবীন্দ্র দর্শন নিয়ে বলছেন, “মুখে যে যাই বলুক না কেন রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে কোনও কিছুই ভালোভাবে চিন্তা করা যায় না। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস ভালো কিছু করতে গেলে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আসতেই হবে। রবীন্দ্রনাথের গানে যে জীবন দর্শন পাই, যে-কোনও সভ্য মানুষ তা গ্রহণ করতে বাধ্য, এত যুক্তি কোথাও নেই। প্রেম বল, পূজা বল, স্বদেশ কোথাও অযৌক্তিক কিছু নেই। ‘তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে...’— এ গান অতি বড় নাস্তিককেও নাড়া দিতে বাধ্য। এইখানে রবীন্দ্রনাথের সার্থকতা। চিরন্তনতা।”
একদিকে জীবন যুদ্ধ। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের গান। আসলে কবির গানেই তাঁর মুক্তি। সেই গান গেয়েই পথ চলা। দুঃখ-শোক ভুলতে সুরের নিরাময়।


৯০ এর দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীদের সংগঠিত করার কাজ করেন তিনি। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গণআদালতে সম্পৃক্ত হওয়ায় ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় কলিম শরাফীকে আসামি করা হয়। এত বিড়ম্বিত জীবন বয়েও, সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক জীবনে কলিমের ৫টি অ্যালবাম রয়েছে— এই কথাটি মনে রেখো, আমি যখন তার দুয়ারে, কলিম শরাফীর যত গান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান এবং জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের কথা ও সুরে নবজীবনের গান। গড়ে তুলেছিলেন ‘সঙ্গীত ভবন’ নামে একটি সঙ্গীত বিদ্যালয়। একাধিক চলচ্চিত্রে গান করেছেন ৷ লিখেছেন ‘স্মৃতি অমৃত’-র মতো স্মৃতিকথা।
খালেদ লিখছেন, ‘‘সে-সময় যাঁরা আধুনিক বা রবীন্দ্রসংগীত গাইছেন তাদের সম পর্যায়ের গাইয়ে ছিলেন কলিম শরাফী। স্ট্রাগলটা এত বেশি ছিল যে, গলা বাঁচানোর বা নিজেকে গাইয়ে হিসেবে বাঁচানোর ব্যাপারটা রক্ষা করা সম্ভব হত না। ফলে গলার কোয়ালিটি এত ভালো থাকা সত্ত্বেও কোথাও একটা জায়গায় অবহেলিত ছিল। যখন তাকে সম্মান দেওয়া হল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে! বাংলাদেশ হওয়ার পর রবীন্দ্রসংগীতের স্থান হয়েছে সম্মান হয়েছে, রবীন্দ্রসংগীত সংস্কৃতির একটা অঙ্গ হয়েছে। তখন কলিম শরাফীর গলা পড়তির দিকে, শরীর ভেঙ্গে গেছে। অনেকের জীবনেই বোধ হয় ঘটে এটা, অনেক সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। কলিমের জীবনেও তাই ঘটেছে। পরিস্থিতিটা যদি একটু অনুকূল হত তাহলে আমরা তার কাছ থেকে হয়তো অনেক রেকর্ড পেতাম। তার সতেজ একটা গলা ছিল। বিনা চর্চায় গলাটা ছাড়লে যে সোনালী স্বর বেরিয়ে আসত তা অত্যন্ত কম লোকের হয়।’’

Post a Comment

0 Comments