ছবিজুড়ে স্মৃতির লখনউ নগরী

ছবিজুড়ে স্মৃতির লখনউ নগরী

আবীর মুখোপাধ্যায়


বদুল হলীম ‘শরর্’ লেখা ‘মশরিকী তমদ্দুন কা আখিরী নমুনা’ বা ‘গুযিশ্‌তা লখনউ’ পড়েছেন?
পড়তে পড়তে চোখের সামনে সেলুলয়েডের মতো সরে যায় পুরনো লখনউয়ের অলি-অন্দর, মহফিল, মসনবী-মঞ্জিল!
শুক্রবার লকডাউন সিনড্রোম ভেঙে, শিরদাঁড়া সোজা করে সেই লখনউ নগরীই যেন দেখে ফেললাম সুজিত সরকারের ‘গুলাবো সিতাবো’ ছবিতে। কি নেই সাবেক লখনউয়ের? মির্জা আছে, বেগম আছে। মহল আছে। খানদান-পান-গান— সবই আছে। রিভিউয়ের নামে, সিউডো ইন্টেলেকচুয়াল সেজে আঁতলামি বাদ দিয়ে, কোনও ন্যারেটিভ না খুঁজে বলি এ ছবি— সপরিবারে দেখার। দেখানোর!
‘পিকু’, ‘অক্টোবর’ কিংবা ‘ভিকি ডোনার’-এর থেকে সুজিত সরকারের এ ছবি অনেক অর্থেই আলাদা। এ ছবির ধরতাই পুতুলনাচে। দুটি পুতুল— গুলাবো এবং সিতাবো। অভীক মুখোপাধ্যায়ের ‘জলসাঘর’ স্মৃতি ছুঁয়ে ছুঁয়ে ক্যামেরা এগোলে, এ গল্প আর কেবলই তাদের থাকে না। জরা-জীর্ণ হাভেলি ফতিমা মহলের মালিকানা নিয়ে যুযুধান দুই তরফের সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদেরও মহল্লার গল্প হয়ে যায়। ছবির গল্পে একতরফে, ফতিমা মহলে ভাড়া থাকা কয়েকটি পরিবার। তাদের একজন বাঁকে (আয়ুষ্মান) থাকে তিন বোন ও মাকে নিয়ে। একটি গম ভাঙানোর দোকান চালিয়ে তাদের সংসার চলে। অন্য তরফে মির্জা (অমিতাভ)। খিটখিটে, সন্দেহবাতিক, কৃপণ আশি ছুঁই ছুঁই মির্জা জীবনের প্রান্তবেলায় জানায়, সে ফতিমা মহলের মালিকানার জন্যই তার থেকে সতেরো বছরের বড় বেগমকে বিয়ে করেছিল! এমন তথ্যে চমকে গিয়ে বাঁকে প্রশ্ন করে, ‘‘বেগম?’’ মির্জার মজাকি, প্রেমিক আবদুর রহমানকে ছেড়ে বেগম মির্জাকে বিয়ে করে স্রেফ ‘জওয়ানির’ কারণে!


সিনেমার শেষে, শেষ চিঠিতে বেগমজান অবশ্য জানিয়ে যায়, প্রেমিক রহমানের সঙ্গে লন্ডন না গিয়ে এই হাভেলির জন্যই মির্জার কাছে থেকে গিয়েছিল! দৃশ্যত, হাভেলির অধিকার নিয়েই গল্পের আবর্ত। একদিকে মির্জা অপেক্ষা করে, কবে বেগম মরবে এবং সেই হবে মালিক। অন্যদিকে মরিয়া অন্য ভাড়াটেদের সঙ্গে নিয়ে বাঁকে। এই দোটানায় মাঠে নামে পুরাতত্ত্ব বিভাগের জ্ঞানেন্দ্র শুক্লা (বিজয় রাজ)। ওদিকে মির্জা আইনের সাহায্য নেয় ভাড়াটেদের হাত থেকে নিজের অধিকারের জন্য। কোন্দল শেষ হয়, ছবির শেষ পর্বে। ১ টাকায়, কবেকার প্রেমিক রহমানকে হাভেলি বিক্রি করে বেগমের পালানোর খবরে!
স্যাটায়ারের মোড়কে বলা গল্পের জন্য জুহি চতুর্বেদীকে এখন আলাদা করে চেনা যায়। ঢের পরিণত এবং প্রাপ্তমনস্ক। কোনও কোনও ফ্রেম দেখে ছবিটি হাসির মনে হলেও, সেই বাঁকা হাসির গোপনে বয়েছে ক্ষয়! সারাক্ষণ তীক্ষ্ন হয়ে বিঁধেছে ব্যথা। কুর্নিশ অভিনেতাকে। কুঁজো হয়ে, পা টেনে, নড়বড়ে চলনে, কথা-বার্তায় মির্জা যেন সময়ের কাছে প্রতি মুহূর্তে হেরে যাচ্ছে, ঠকে যাচ্ছে। ছবির একেবারে শেষে যখন সে পথে— টাঙাওয়ালা, গেটের বাইরে বাঁকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দেখে বেগমের জন্মদিন পালিত হচ্ছে হাভেলিতে। চোখের দৃষ্টিতে জেগে থাকে সর্বহারা দেশ-কাল। এরপরই এ ছবির সঙ্গীত পরিচালক শান্তনু মৈত্রের আয়োজনে, ‘দো দিন কা মেলা হ্যায়’— লোকসুরের আবহে দেখা যায়, বদলে যাওয়া ঝাঁ-চকচকে, সফেদ ‘দেশ’। নিত্য সাদাসিধে প্রান্তিক-জনের নিরন্তর ঠকে যাওয়ার রূপকটি আঁকতে গিয়ে পরিচালক দেখান, হাভেলি ছেড়ে আসার সময় মির্জা সঙ্গে করে নিয়ে আসা চেয়ারটিকে আবার। পেটের দায়ে মির্জা সেটি ২৫০ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছিল। এখন যা অ্যান্টিকশপে সাজানো, হাত ঘুরে যার মূল্য— এক লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার!
ইতিমধ্যেই দেশজুড়ে পজিটিভ রিভিউ ছবিটিকে ঘিরে। শান্তনুর বাংলা সুর মিলেমিশে এক হয়ে গেছে পুরনো লখনউয়ের পথে বচ্চন সাহেবের হাঁটার ছন্দে। কেউ কেউ বলবেন ‘বড্ড ঢিমে’। আমি বলব, কিসের এত তাড়া? ঢিমেতাল যে কখনও-সখনও অনিবার্য তেহাই হয়ে ওঠে— এ ছবির ফ্রেমের পর ফ্রেমজুড়ে তার জাদু-বাস্তব। যে লখনউয়ের গল্প ছুঁয়ে ছবি, সেখানে এমন লয়কারি মন্দ কী!
দর্শক উচ্ছ্বসিত অমিতাভ বচ্চন এবং আয়ুষ্মান খুরানার অভিনয় নিয়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোল হতে হতে এখন কৌতুক-বাজ বাঙালির হাঁড়ির খবরে মির্জা-বেগম!
আয়ুষ্মান তাঁর কাজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন ইনস্টাগ্রামে। ‘গুলাবো সিতাবো’র একটি শ্যুটিং দৃশ্য পোস্ট করে তিনি লিখেছেন— ‘‘যখনই এ দেশের কোনও যুবক অভিনয় জগতে পা রাখে, তাদের ইন্সপিরেসেন হন অমিতাভ বচ্চন। আমার শেষ ছবিতে একটা সংলাপ ছিল, যে বচ্চন তৈরি হয় না, বচ্চন তো ব্যস হয়। ছোটবেলায় চন্ডিগড়ে বচ্চনের সিনেমা ‘হাম’ দেখেছিলাম। ওই ছবি শরীরের রক্ত গরম করে দিয়েছিল। সেই জন্যই আজ আমি অভিনেতা। প্রথম টিভির জন্য শ্যুট হয়েছিল সেই জায়গায়, যেখানে অমিতাভজির ‘চুম্মা চুম্মা’ গানের শ্যুট হয়েছিল।... সেই সময় আমার এই হাল ছিল, তাহলে আপনারা বুঝতে পারছেন আমি কোন অনুভূতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। ‘গুলাবো-সিতাবো’তে আমার সামনে এমন একজন ছিল, আর ছবির চরিত্র এমন ছিল যে আমাদের একজন আর একজন অনেক সহ্য করতে হবে। তবে আমার এত ক্ষমতাই নেই যে আমি সেই অভিনেতার সামনে কিছু বলতে পারি। তিনি সামনে আছেন, আমি তাঁর সঙ্গে কাজ করছি, এটা ভাবলেই আমার রোমাঞ্চ হত। এই সমস্ত কিছুর জন্য আমি সুজিতদাকে ধন্যবাদ জানাবো। ... অমিতাভজির সঙ্গে কাজ করতে পেরেছি, এটা আমার জীবনের সব থেকে বড় পাওয়া।’’


ছবি শেষ করে ফের ফিরি ‘গুযিশ্‌তা লখনউ’-এর পাতায়। পড়ছি— লখনউ থেকে এসে মেটিয়াবুরুজে নবাবজাদা ওয়াজিদ আলি শাহ রয়েছেন— সেই সব দিনের কথা। তিনি যেদিন চোখ বুজলেন, ভানুমতির খেলা যেন ভেঙে গেল। আর্তরবে সুর ভেসে এল সুলতানখানা থেকে। ‘খোআব থা জো কুছ ভী দেখা/ জো সুনা আফসানা থা।’ সুজিতের ছবির শেষে, জীর্ণ ফতিমা মহলের পরের দৃশ্যেই ল্যামিনেটেড ফ্রেমে দেশ দেখে কানে এসে যেন লাগল সেই সুলতানখানার সুরই!

Post a Comment

1 Comments

  1. চমৎকার, প্রথাবিরুদ্ধ আন্তরিক এক প্রতিবেদন। আনন্দ, ভিতরে সবটুকু ক্ষয় নিয়ে, নাড়িয়ে গেল।
    অভিনন্দন।

    ReplyDelete