ব্লগ: দেশান্তর/ ২

একলা হওয়ার বার্তা 

মৌমন মিত্র । ১৬ জুন, ২০২০ । নিউ জার্সি 


মাখন মাঝরাত। ফেসবুকে পোস্ট করলাম নিজের রচিত একটি ইংলিশ কবিতা। যার শেষ লাইনে লেখা ছিল, “Weep to the nothingness when life keep oozing in despair/ The pestilence that seeped pouring onto existence/ A truth, tangibly in layer…” আমি তারপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আজ পৃথিবীর এই প্রান্তে যখন সাত সকালে ঘুম ভাঙ্গল, দেখি জনপ্রিয় অভিনেতা সুশান্ত সিংহ আমাদের মাঝে আর নেই। তাঁর মৃত্যু আত্মহত্যা কিনা পুলিশ এখনও তদন্ত করছেন। অজান্তেই কী পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত এই পোস্ট! তাই না?
সংবাদপত্রে পড়লাম সুশান্ত সিংহ মাস ছয় ধরে অবসাদে ভুগছিলেন। অবসাদ, আত্মহত্যা— এরা আমাদের জীবনের সঙ্গে বহু শতক জুড়ে জড়িত। বরং এখন মানুষ অনেক বেশি সতর্ক হয়েছেন। এখন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অনেক ছোট বড় বেসরকারি-সরকারি স্কুলে মনের ডাক্তাররা থাকেন কাউন্সেলিং এবং নানা পরামর্শ দেওয়ার জন্য। পুরনো দিনের তুলনায় অধিকাংশ মানুষ বুঝতে শিখেছেন যে, শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক ভাবে ভালো থাকাটা নিজের জন্য ঠিক কতটা প্রয়োজন।
তবু, কেন দিন দিন বাড়ছে এই অসুখ? পৃথিবী জুড়ে টেস্টিং বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ছে করোনায় সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা। একই ভাবে মনোবিদ ডাক্তারদের চেম্বারে, রোগীর সংখ্যাই কী প্রকাশ করছে এই অসুখের পরিমান? আগেও কী ছিল না এতটা অবসাদ? হয়তো ছিল। অ্যাসিমটোমেটিক্যালি অর্থাৎ উপসর্গহীন।
তবে সেই সময় মানুষ গভীর অসুখী হলেও এতটা একা হয়ে পড়তেন না। মন খারাপ হলে খুব চাপা স্বভাবের লোকজন বাদে একে-অপরের সঙ্গে দুঃখ ভাগ করার একটা স্থান বিনিময় পরিস্থিতি ছিল। এখন দুঃখ হলে মানুষ  যাবে কোথায়?
অতি সভ্যতার গ্রাসে, আমরা দিন দিন একা হয়ে পড়ছি। লেখাপড়ার বয়েসেই মা-বাবাকে ছেড়ে আমরা অন্য শহরে চলে যাই। তারপর চাকরির জীবনে শুরু হয় এক ভিন্ন জীবন যাপন। নিজের ভাল লাগা মন্দ লাগা অনেক বেশি গুরুত্ব পেতে শুরু করে। ভুলতে শুরু করি বেশ কিছু মানুষকে এক সঙ্গে নিয়ে থাকা।


কামিউনিটি লিভিং। যে কামিউনিটি লিভিং নিয়ে আমরা পরিবারের বাইরে সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশ বড়াই করে থাকি, আদৌ কী সেটা কামিউনিটি লিভিং হয়? নাকি তা কয়েক ঘণ্টার পোজ দিয়ে কেবল ফেসবুক পোস্ট? আর ছবি ক্লিকের ঠিক পরের মুহূর্তেই একজন আরেকজনকে ঘেন্না করা? খুব পরিচিত ঠেকছে কী এইসব ঘটনা?
আমাদের ছোটবেলায় অধিকাংশ মধ্যবিত্ত বাড়িতে একটাই টিভি থাকত। চ্যানেলের অপশান কম, তাই যা পেতাম তাই দেখে বড় হয়েছি। এখন, আমাদের পরের প্রজন্ম এই লাইফস্টাইলে একেবারেই অভ্যস্ত নয়। ফ্যামিলি টিভির চ্যানেলের অনুষ্ঠান পছন্দ না হলেই তারা নিজস্ব রুমে নিজেদের পার্সোনাল টিভি দেখতে চলে যায়। সেখানেও ভাই বোন মিলে এক সঙ্গে কেউ কিছু দেখতে পারে না। রয়েছে আরও অপশান। পার্সোনাল আই প্যাড, স্মার্ট ফোন, ভিডিও গেমস— লিখতে থাকলে তালিকাও বেড়েই চলবে। এইভাবে এরাও শিখছে নিজেদের জন্যে বাঁচতে নিজেদের মতো করে। কমছে সহিষ্ণুতা। দৈনন্দিন, নাগাড়ে।
সোশ্যাল মিডিয়াতে এই যে বিপুল পরিমান চেনা - অচেনা বন্ধু বান্ধবীদের ঝাঁক তৈরী করেছি আমরা, তাঁদের মাঝে একা হওয়ার জো আছে কারোর? সেখানে নিজেকে দৈনন্দিন এক নাগাড়ে ‘ফিলিং হ্যাপি’ প্রকাশ করাটা কী খুব ম্যান্ডেটরি একটি বিষয় নয়? সেখানে  সুখী দাম্পত্য, সুখী বন্ধুত্ব, সুখী সন্তান, সুখী মা-বাবা না হলে লাইক পাওয়া যাবে? কেবল সুখী কেন, আরেকটি ক্রাইটেরিয়াও রয়েছে। সুখীর পাশাপাশি সফল হওয়া। অসফলতার কোনও উদযাপন হয় না। আর সোশ্যাল মিডিয়া সফলতা উদযাপনের একটি ঝলমলে সংস্থা। এই জগতে কেউ অসুখী হলে হয় বাতিল নয় ‘বড্ড আঁতেল’।
আমেরিকার স্কুলে প্রত্যেক বছর প্রতিটি সেকশানের ছাত্রছাত্রীদের বদলে দেওয়া হয়। মানে এই বছর আপনার সন্তান যাদের সঙ্গে ক্লাস করল সারা বছর, পরের বছর তারা আবার অন্য সেকশানে। অর্থাৎ কোনও বন্ধুত্ব যেন গাঢ় না হয়। ছোটবেলার অন্তত দু-একটা বন্ধুত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ সেখানেই এই ব্যবস্থা। বন্ধুত্ব গাঢ় না হলেই সমাজে কনসিউমেরিসম বৃদ্ধি পাবে। খুব ছোট বয়েস থেকেই তাই একলা হওয়ার বার্তা পাঠানো হয় ছোটোদের। স্বাধীন হতে বলার ফ্যান্সি মোড়কে। আগামী দিনে যা আদতে আত্মঘাতী হওয়ার মড়ক নিয়ে আসতে পারে এই দুনিয়ায়।
স্বাধীন, প্রগতিশীল মানসিকতা আসলে অত্যন্ত অর্থপূর্ণ এবং জরুরি। প্রযুক্তি আরও আবশ্যিক। কিন্তু তা ভালোবাসার মানুষকে দূরে সরিয়ে নয়। এই ব্যাল্যান্স আমাদেরই তৈরি করতে হবে। ভিড়ে একলা হওয়াটা শরমের কিছু নয়। ভালোবাসা বিদায় নিয়ে চলে গেলে আমরা কেউ আরও দৃঢ় হই, কেউ ভেঙ্গে পড়ি। যে কিংবা যাঁরা দৃঢ় হতে জানি, তাঁরা পারব না ভেঙ্গে পড়া মানুষটিকে নিজের ভরসার আশ্বাস দিতে? হ্যাঁ পারব। করোনার মতো ভালোবাসাও শুনেছি এক সংক্রামক ব্যাধি।
সেলফ কেয়ার, DIY/ ডু ইট ইউরসেফ তো অনেক হল, এবার ‘হাতে হাত রাখা থাক?’
সুশান্ত সিংহ তুমি ভাল থাকো। এই পৃথিবী-টৃথিবির এক অ-চিহ্নিত ব্যাধি তোমায় নিয়ে চলে গেল। অনেক দূরে। তুমি রয়ে যাবে আমাদের সকলে ‘ভিতর ও বাহিরে’। যেদিন সব্বাই সব উল্লাস ছাপিয়ে তোমার কষ্ট-কে ছুঁতে শিখব, সেদিন বুঝব আমরাও সেরে উঠেছি, প্রতিষেধকহীন। কোনও এক কালে। সন মনে নেই, দিন মনে নেই, অন্তরস্থ আলোয় না একশো প্রদীপ জ্বালানো— সেও মনে নেই...!


Post a Comment

0 Comments