ব্লগ : হ্যালো হান্ড্রেড/ ২ । মিগ বিমান চুরি

মিগ বিমান চুরি

দ্যুতিমান ভট্টাচার্য


ছোট্ট দেশ ইসরায়েল। কত ছোট? ১৯৪৯ সালে ইসরায়েল, লেবানন, জর্ডান ও সিরিয়ার মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল সেই চু্ক্তি অনুযায়ী দেশটির আয়তন হওয়ার কথা ২০ হাজার ৭৭০ বর্গ কিলোমিটার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির শাসক হিটলার ইহুদিদের প্রতি কঠোর হতে শুরু করেন। জাহাজে করে হাজার হাজার ইহুদি অভিবাসী ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে আসতে থাকে। তখন ফিলিস্তিনী আরবরা বুঝতে পারে যে তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। আরবরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বিদ্রোহ করে। তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল ব্রিটিশ সৈন্য এবং ইহুদি নাগরিকরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের বাহিনীর দ্বারা লাখ-লাখ ইহুদি হত্যাকাণ্ডের পর নতুন আরেক বাস্তবতা তৈরি হয়। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর যেসব ইহুদি বেঁচে ছিলেন তাদের জন্য জন্য কী করা যায় সেটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
তখন ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে ইহুদীদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা আরো জোরালো হয়। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ইসরায়েল রাষ্ট্রের পক্ষে জোরালো অবস্থান তুলে ধরেন। মি: ট্রুম্যান চেয়েছিলেন হিটলারের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া এক লক্ষ ইহুদিকে অতি দ্রুত ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে জায়গা দেওয়া হোক। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে দু'টি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। একটি ইহুদিদের জন্য এবং অন্যটি আরবদের জন্য।
জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্তের পর আরব এবং ইহুদিদের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায় ব্রিটেন। একই দিন তৎকালীন ইহুদি নেতারা ঘোষণা করেন যে সেদিন রাতেই ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম হবে। ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের এক ঘন্টার মধ্যেই আরবরা আক্রমণ শুরু করে। একসাথে পাঁচটি আরব দেশ ইসরায়েলকে আক্রমণ করে। যেসব দেশ একযোগে ইসরায়েলকে আক্রমণ করেছিল তারা হচ্ছে— মিশর, ইরাক, লেবানন, জর্ডান এবং সিরিয়া। তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ত্রিশ হাজারের মতো। অন্যদিকে ইসরায়েলের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫ হাজার।
আরব দেশগুলোর মধ্যে পারষ্পরিক আস্থা না থাকার কারণেই ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে তারা পরাজিত হয় এবং ইসরায়েল দেশটির জন্ম হয়ে সেটি স্থায়ীত্ব পায়। ১৯৪৮ সালের পর থেকে সামরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে অতি দ্রুত উন্নতি লাভ করে ইসরায়েল। সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়। ইসরায়েলের আয়তন এখন ২৭ হাজার ৭৯৯ বর্গ কিলোমিটার। এটাই একমাত্র দেশ যেখানে প্রাপ্তবয়স্ক সব নাগরিকের জন্যই সেনা প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। সুতরাং দেশটিতে যতজন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক সেনাসদস্যও এক অর্থে ততজন। সেনাপ্রশিক্ষণও স্বল্পমেয়াদি হয় না। সব প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকে ৩ বছরের এবং মেয়েকে অন্তত ২ বছরের প্রশিক্ষণ নিতে হয়।
ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থার নাম মোসাদ। সারা বিশ্বে এই গোয়েন্দা সংস্থার রয়েছে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। যার মূল লক্ষ হচ্ছে ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলন প্রতিহত করা ও মুসলমানদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা। এ গোয়েন্দা সংস্থাটি অসংখ্য গুপ্তহত্যা ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত।


১৯৪৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর মোসাদের কার্যক্রম শুরু হয়। ইসরাইলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ান মোসাদ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মনে করতেন গোয়েন্দাবৃত্তি ইসরাইলের ফার্স্ট ডিফেন্স লাইন। টার্গেট দেশ থেকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, সন্ত্রাস দমন ও অপারেশনের পর এগুলো গোপন রাখা হচ্ছে মোসাদের প্রধান কাজ। মোসাদের নীতিমালা ও কার্যক্রম অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ, যুক্তরাজ্যের এমআই সিক্স ও কানাডার সিএসআইএস এর অনুরূপ। এর হেডকোয়ার্টার তেল আবিবে।
মোসাদের বিশেষ উদ্দেশ্যে বিভাগকে মেটসাদা বলে। গুপ্তহত্যা, আধা-সামরিক অপারেশন, নাশকতামূলক কাজ, রাজনৈতিক কলহ তৈরি, মনস্তাত্বিক যুদ্ধাবস্থা তৈরি বা প্রোপাগাণ্ডা চালানো এই বিভাগের কাজ।
১৯৪৯ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন মিগ-২১ যুদ্ধ বিমান বানানো শুরু করে। মিশর, সিরিয়া, ইরাকে সেগুলি সরবরাহ করা হয়। এতে ইসরায়েলের আকাশ পথে বিপদের সংকেত ডেকে আনে।
১৯৬৩র এক বিকালে ইসরায়েলী বিমান বাহিনীর প্রধান এযের ওয়াইজম্যান আর মোসাদ প্রধান মীর অমিত বসে কফি খাচ্ছিলেন। তেল আবিবের বিকেল বেশ অন্যরকম। ভূমধ্যসাগর থেকে উড়ে আসা নোনা বাতাস শুষ্ক দিনের শেষে একটু জলীয় ভাব নিয়ে আসে। ওয়াইজম্যানের কপাল ভেজা জলীয় বাষ্প কণায় চকচক করছিল। পেয়ালায় চুমুক দিয়ে অমিতকে বললেন, “ভায়া, তুমি একখান মিগ-২১ নিয়ে আসো তো বুঝি তোমার মোসাদের কত দম।“ কথাটি মীর অমিতের আঁতে লেগেছিল।
১৯৬৪-র গোড়ায় মোসাদ একজনের খোঁজ পায়। বাগদাদে এক ইহুদি ব্যবসায়ীর। নাম যোসেফ। বছর ষাটের ভদ্রলোক আবার ডায়াবেটিক রুগী। সারাদিন বাথরুমে দৌড়োচ্ছে। সেই লোকের আবার গার্ল ফ্রেন্ড ছিল! সেই বান্ধবীর বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছিল ইরাকি বিমান বাহিনীর পাইলট মুনির রাদফার সাথে।
মোসাদের এজেন্ট আবুর সাথে যোসেফের আলাপ হয়। আলাপ থেকে খেজুর করা। তাঁর থেকে খোশগল্প। যোসেফ জানায় রাদফার দুঃখের কথা। ডেপুটি কম্যান্ডার থেকে মুনির রাদফা কিছুতেই কম্যান্ডার হতে পারছিল না। কারণ? সে খ্রীষ্টান। ক্যাথলিকদের ওদেশে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। একই কারণে তাঁকে বাগদাদ থেকে দূরে কিরকুকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। ডেপুটি কম্যান্ডারের কাজ ছিল বিমান বাহিনীর তেলবাহী উড়োজাহাজ ওড়ানো। লজ্জাজনক। তাও বিপজ্জনক কুরদিশ গেরিলাদের সাথে লড়াইয়ের বেস ক্যাম্পে।
হতাশ মুনির কয়েকবার আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিল। পরিবারের কথা ভেবে এগোতে পারেনি।
এরকম একটা পরিস্থিতিকে ব্যবহার করতে উঠে পড়ে লাগল মোসাদ। যোসেফের মাধ্যমে মুনিরকে রাজী করানো হলো। ইসরায়েলী গোয়েন্দারা মুনিরের ছুটি কাটানোর ব্যবস্থা করলেন। বান্ধবীকে নিয়ে মুনির উঠল রোমের এক হোটেলে। এখানে মোসাদের সাথে মুনিরের পাকা কথা হয়। এই অপারেশনটাকে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছিল মোসাদ যে, ওই হোটেলে মিটিং চলাকালীন খোদ গোয়েন্দা প্রধান মীর অমিত হাজির ছিলেন পাশের ঘরে। দেওয়ালের একটা ফুটো দিয়ে তিনি সবটাই পর্যবেক্ষণ করেন। সরেজমিনে।
পাইলট মুনির মিগ ২১ ইসরায়েলে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ায় রাজী হলেন। দুটো শর্তে। এক, তাঁকে এক মিলিয়ন মার্কিনী ডলার পারিশ্রমিক দিতে হবে। দুই, অপারেশনের আগে তাঁর পরিবার-পরিজনদের ইরাক থেকে বের করে নিয়ে আসতে হবে। এক কোথায় রাজী হয়ে গেল মোসাদ।
মুনির ইরাকে ফেরার পর কলকাঠি নাড়া শুরু করল মোসাদ। একদল এজেন্টকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো বাগদাদে। তাড়াহুড়ো না করে অপেক্ষা করা হলো মুনিরের বদলীর। বাগদাদের কাছে কোথাও। ১৯৬৬-র মাঝামাঝি মুনিরকে বাগদাদের কাছে রশিদ এয়ার বেসে ট্রান্সফার করা হয়। এরপর কাজে লেগে পড়ে মোসাদের এজেন্টরা। প্রথমে নিকট আত্মীয়দের। একজনকে ইউরোপে পাঠানো হয় চিকিৎসার প্রয়োজনে। একজন বেড়াতে যাওয়ার নাম করে আর ফেরে না। ধীরে ধীরে। একে একে। যাতে সন্দেহের উদ্রেক না হয়।
মুনিরের কাছে যায় এক মোটাসোটা মহিলা এজেন্ট। আত্মীয়া ছদ্মবেশে এই এজেন্ট মুনিরকে নিয়ে যায় প্যারিসে। সেখান থেকে ভুয়ো কাগজ পত্রে ইসরায়েল। সেই প্রথম সে দেশে পদার্পণ। তাঁকে দেখানো হয় যে রানওয়েতে বিমানটির অবতারণ ঘটাতে হবে।
১৯৬৬-র অগস্টের এক দিন। মুনিরকে ডিউটি শোনানো হয় মিগ-২১ ওড়ানোর। যে বিমানে ৯০০ কিমি ওড়ার তেল থাকবে। সেদিন সকালেই মোসাদ এজেন্টরা দুটো বড় ভ্যান ভাড়া করে পিকনিকের নাম করে মুনিরের বাকি পরিবারকে ইরান সীমান্তে নিয়ে যায়। সেখানে কুরদিশ গেরিলারা তাদের সাবধানে সীমান্ত পার করে দেয়। সীমান্তের ওপারেই অপেক্ষা করছিল একটি হেলিকপ্টার। ব্লেডগুলো যতক্ষণ ওড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ততক্ষণ দমবন্ধকর পরিস্থিতি। ইরান বিমান বাহিনীর বিমানবন্দরে নামে হেলিকপ্টার। একটি ছোট বিমান সেখানে অপেক্ষা করছিল মুনিরের পরিবারকে ইসরায়েলে নিয়ে যেতে। ওদিকে ততক্ষণে মুনির পাইলটের সীটে। ৩৫০০০ ফুট উচ্চতায়। শব্দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। ইরাকের আকাশে।
১৬ অগস্ট দুপুরবেলা জর্ডানের এয়ার ডিফেন্সের র‍্যাডারে ধরা পড়ে একটি জেট তীরগতিতে তাদের দেশের আকাশের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। জর্ডান যোগাযোগ করে প্রতিবেশি দেশ সিরিয়ার সাথে। তাঁরা ভুলবশত স্বীকার করে যে জেটটি তাদেরই।
এরপরেই ইসরায়েলের আকাশে প্রবেশ করে মুনির। এখানে তাঁকে ঘিরে ধরে ইসরায়েলী বিমান বাহিনীর দুটি মিরাজ বিমান। তা দেখে নিজের মিগ বিমানের চাকা নামিয়ে আত্মসমর্পণের ইশারা করে মুনির। ৯০০ কিমি যাত্রাপথের শেষ বিন্দু তেলে ইসরায়েলে নামে মিগ-২১।
কয়েকঘন্টা পরে হয় প্রেস ব্রিফিং। সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয় মুনিরকে। যে মিরাজ ফাইটার পাইলটরা ঘিরে নিয়ে এসেছিল মুনিরের বিমান, তারাও জানত না অপারেশনের ব্যাপারে। তাদের শুধু বলা হয় কোনো বিমান যদি আত্মসমর্পণের চিহ্ন দেখায় তবে তাঁর ওপর গুলি না চালাতে।
কয়েক মাস বাদে বিমানটি পাঠানো হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। পরীক্ষা নিরিক্ষার জন্য। আরবদের আকাশ পথের ক্ষমতা জানার জন্য। বিমানটি পরীক্ষা করে জানা গেল তাঁর ওড়ার ক্ষমতা, গতি, ফায়ারপাওয়ার, ইত্যাদি।
১৯৬৭-তে যে ছ’দিনের যুদ্ধে গোটা আরব বিশ্বকে ধরাশায়ী করেছিল ইসরায়েল, তাতে ৬টি মিগ-২১ কে গুলি করে নামায় ইসরায়েলি মিরাজ বিমান। ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতি ছিল শূন্য।
১৯৬৮-র স্বাধীনতা দিবসের প্যারেডে অংশগ্রহণ করে সেই মিগ বিমানটি। এক চিলতে দেশটিকে সমীহ করে গোটা দুনিয়া। তাদের বুদ্ধিমত্তা আর মোসাদের জন্য।






Post a Comment

0 Comments