গানের পাখি : তোমাদের এই হেমন্ত/ ১

তোমাদের এই হেমন্ত/ ১

আবীর মুখোপাধ্যায়


বাল্যের একটি দৃশ্য খুব মনে পড়ে। দৃশ্যটি এইরকম— সাদাকালো টেলিভিশনে ইন্টারভিউ দেখানো হচ্ছে। দর্শক সহোদরা জয়া আর আমি। দু’জনেই স্কুলের চৌকাঠ পার হয়নি তখনও।
আমরা দেখছি, দাদুর মতো হাতা গোটানো সাদা বাংলা শার্ট আর ধুতি পরে একজন লোক হারমোনিয়ম বাজিয়ে গাইছেন— ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি পিছু ডাকে’। লোকটার গলাটা যখন চড়ায় উঠছে, ডান কাঁধটা একটু উঠে নেমে যাচ্ছে। ‘ভেঙে গেছে আজ সেই হাসি আর রঙের খেলা’— এই জায়গাটা গাইবার সময়, চড়ায় পৌঁছে ডান দিকে মাথাটা একটু ঝোঁকালেন যেন, কালো সেলুলয়েড ফ্রেমের মধ্যে দিয়ে চোখদুটো কী যে মায়াময়! চোখ, চোখের কোণ, পাতা— ভিজে এল! কেন এল?
কেন কাঁদছি আমরা দুই ভাই-বোন?
জানি না। হৃদয়ের কোন গোপন-গহন সুর স্পর্শ করল জানি না। সেদিনও জানতাম না, আজও জানি না। সেই শুরু হল আমাদের হেমন্তের গানের অরণ্যে প্রবেশ।
এমনি করেই সেদিনই শোনা হয়ে গেল— ‘কথা ক’য়ো নাকো শুধু শোনো’, ‘আমার আর হবে না দেরি’, ‘রানার’, ‘বসে আছি পথ চেয়ে’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’। কী যে নম্র-নিবেদন মানুষটির কথা ও সুরে— মেলাতে পারি না— ইদানিং সময়ের কোনও শিল্পীর বরফট্টাইয়ের সঙ্গে। দূরদর্শনের সুবীর ঘোষের সেই ইন্টারভিউয়ের প্রতিটা ফ্রেম যেন এখনও মনে করতে পারি!
এখনও কান পেতে আছি, তাঁর গানের মীড়ে। একে একে বাড়িতে এল তাঁর গানের বিপুল সংকলন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে বইপত্তর। পত্রিকা। ছবি। সেই সংগ্রহ ফিরে ফিরে দেখছি ফের। পড়ছি তাঁর জীবনের নানা গল্প, মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছি কালজয়ী শিল্পীর সুধাকণ্ঠ!

সেটা ১৯৪৫। ডিসেম্বরে বিয়ে করলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। মায়ের অনুমতি নিয়ে বেলাদেবীর সঙ্গে ইন্দিরা সিনেমার পাশে ইন্দ্র রায় রোডে বাড়ি ভাড়া করে, নতুন সংসার পাতলেন। ততদিনে ক্রমে আলাপ জমছে সলিল চৌধুরীর সঙ্গে।
সেই আলাপ-পর্বের স্মৃতিতে সলিল লিখছেন, ‘‘সেটা ১৯৪৫-৪৬ সালের কথা। তখন থেকেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে চিনতাম, বেশ কয়েকবার দেখা সাক্ষাৎও হয়েছে। কিন্তু, তেমনভাবে ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ হয়নি। সেই সময়, ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের পাশে জর্জদার (দেবব্রত বিশ্বাস) বাড়িতে আমি প্রায় যেতাম। সেখানেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। মনে পড়ছে, সামান্য একটু আলাপ এবং দু’চারটে কথাবার্তাও হয়েছিল। তারপর এল সেই ১৯৪৮ সাল। কমিউনিস্ট পার্টিকে তখন নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছে ভারত সরকার। আমি আত্মগোপন করে। সুন্দরবনে কৃষকদের মধ্যে কাজ করছি। ... গোপনে মাঝে মধ্যে কলকাতায় এসে গোলপার্কে ‘যশোদাভবন’-এ উঠতাম। আমার নামে তিন তিনটে গ্রেফতারি পরোয়ানা ঝুলছে। ওই বাড়িরই ছেলে, দুই ভাই, ভূপতি এবং সুরপতি নন্দী ছিল আমার শুধু বন্ধুই নয়, বলতে গেলে আপন ভাইয়ের মতনই। ওখানেই তখন আমাদের একটা গোপন আড্ডা বসত। ওখানে ভূপতিদা, সুরপতি তো থাকতই। তাছাড়া, আমাদের সেই গোপন আড্ডায় এসে যোগ দিতেন। সাধনা রায়চৌধুরী, কলিম শরাফী (রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন, এখন বাংলাদেশের বাসিন্দা), বিনয় রায় এবং রেবা রায়চৌধুরী প্রমুখ। ওই ‘যশোদাভবন’-এ একদিন এসে হাজির হলেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের ছাত্র কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়। কৃষ্ণবাবুর সঙ্গে আমার আগে। থেকেই আলাপ পরিচয় ছিল। আমি যে গান লিখি, গানের সুর দিতে পারি, গান গাই —এসবই তিনি জানতেন। আর জানবেন না কেন? তিনিও তো নিয়মিত যশোদাভবন’ -এ আমাদের আসরে আসতেন। আর সেই সময়ের বেশির ভাগ গানই আমার এই বাড়িতে বসেই লেখা। যাই হোক, কৃষ্ণবাবু একদিন ভূপতিকে বললেন, ‘ভূপতি, সলিলকে তুমি হেমন্তর কাছে নিয়ে যাও। আমি চাই সলিলের গান ওঁর কণ্ঠে গাওয়া হোক! ইতিমধ্যেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র আই পি.টি.এ-র গান গাইতে শুরু করে দিয়েছেন। বলতে গেলে বিনয়দার (বিনয় রায়) নেতৃত্বে এবং জর্জদার টানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সুচিত্রা মিত্র গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছেন।’’
ইন্দ্র রায় রোডের বাড়িতে অনেকেই নতুন সংসার দেখতে আসতে আহ্বান জানাচ্ছেন মুখোপাধ্যায় দম্পতি। সলিলকেও বললেন। গানের খাতা নিয়ে এক সকালে সলিল চলে এলেন। হারমোনিয়মে মুখোমুখি দু’জন। নানা কথা ও সুরে সলিলের কাছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হয়ে উঠলেন ‘হেমন্তদা’। পর পর বেশ কয়েকটি গণনাট্যের জনপ্রিয় গান শোনালেন সলিল। মানুষ শুনতে চায়। হেমন্তও শুনলেন— ‘বিচারপতি তোমার বিচার’, ‘আলোর পথযাত্রী’, ‘ঢেউ উঠছে কারা টুটছে’। খুব প্রশংসা করলেন। কিন্তু রেকর্ড করতে রাজি হলেন না! চিন্তায় পড়লেন সলিল চৌধুরী। ভাবছেন, এখন...!
হেমন্ত বললেন, ‘‘সবই যে প্রোগ্রেসিভ গান। এসব গান কোরাস ভালো হয়। কিন্তু সোলো রেকর্ড করা মুশকিল। এসব গান তো রেকর্ড করা যাবে না। তুমি বরং অন্য গান থাকে তো দাও।’’
তখনও সলিল চৌধুরী বিখ্যাত হননি। বছর কুড়ি-একুশ বয়স। পার্টির কাজ আর নতুন নতুন সুর করেন। সেই সুরের গান আই. পি. টি. এ.-র ফাংশান স্কোয়ার্ড এখানে ওখানে গেয়ে বেড়ান। গ্রামাফোন কোম্পানিতে তখনও তেমন নাম করে উঠতে পারেননি। তাঁর সেই মুর্হূতে অন্য গানের কথা ঠিক মনে পড়ছিল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে, পরে কখনও নতুন গান নিয়ে আসবেন— বলে ফিরে যাবার জন্য উঠে পড়লেন সলিল।
তিনি লিখছেন, ‘‘সিড়ি দিয়ে নীচে নামছি। রাস্তা পর্যন্ত আমাদের এগিয়ে দেবার জন্য হেমন্তদাও নামছেন আমাদের সঙ্গে সঙ্গে। হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল। তাই তো একটা গানের আধখানা লেখা হয়ে পড়ে আছে সেই আধখানার সুরও করে ফেলেছি। হেমন্তদাকে কথাটা বললাম এবং জিজ্ঞেস করলাম, সেটা কি আপনি শুনবেন?’ হেমন্তদা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজি হয়ে গেলেন। আমরা আবার ফিরে এলাম। সেই আধখানা গানটা গেয়ে শোনালাম হেমন্তদাকে।’’
কোন গান? খুবই জনপ্রিয়— পরে ইতিহাস হল সেই গান— ‘কোন এক গাঁয়ের বধুর কথা তোমায় শোনাই শোন।’ গান শুনেই রাজি হয়ে গেলেন হেমন্ত! বললেন, ‘‘রেকর্ড করার পক্ষে এটাই তো ঠিক গান। তুমি এটা তাড়াতাড়ি শেষ করে নিয়ে এসো। কাহিনি-সংগীত যখন, রেকর্ডের দু’পিঠের মতো কথা বাড়াও। তাহলে খুব ভালো হবে।’’
সেদিন বাড়ি ফিরে রাত্তিরে ঘুমোতে পারেননি সলিল চৌধুরী। ফিরে এসেই বাকি অংশটা লিখে ফেলেছিলেন। ‘ডাকিনী যোগিনী এল শত নাগিনী/এলো পিশাচেরা এলো রে’।
সলিল স্মৃতি— ‘‘পরের অংশটা শেষ হতেই সুর করতে বসে গেলাম। এবং দিন দুয়েকের মধ্যেই পুরো গানটা হেমন্তদার হাতে তুলে দিয়ে এলাম। গানের সুরটাও তিনি রপ্ত করে নিলেন। সেই রাত্রেই ‘যশোদাভবন’ পুলিশ রেড করে। দুই ভাই ভূপতিদা এবং সুরপতি পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন। কিন্তু, ভূপতিদার মায়ের জন্যেই আমি বেঁচে গেলাম। ওঁর মা আমাকে দেখিয়ে পুলিশকে, বললেন, ‘ও আমার ছেলে। ওর নাম নৃপতি। আজই ও নবদ্বীপ থেকে এসেছে। ওখানেই ও থাকে।’ কিছু বেআইনি কাগজপত্রও পুলিশ বাড়ি থেকে নিয়ে গেল। আর, পরের দিন ভোরেই আমি চলে গেলাম সন্দেশখালির ভাঙড় অঞ্চলে। শুরু হল আবার আত্মগোপনের পালা। সেই বছরই, অর্থাৎ ১৯৪৯ সালের আগস্ট মাসই হবে—হঠাৎ একদিন শুনলাম, আমার ওই ‘গাঁয়ের বধূ’ গানটা হেমন্তদা ‘পূজার গান' হিসেবে রেকর্ড করে ফেলেছেন। এবং একটা আশ্চর্যের ব্যাপার, ওই গানের অর্কেস্ট্রেশনও করেছেন হেমন্তদা নিজে। ওই বছরই রেকর্ডটা প্রকাশিত হয়ে বাজারে বেরুল। এবং বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে হৈচৈ পড়ে গেল গানটা নিয়ে। আজকের ভাষায় যাকে বলে ‘সুপার ডুপার হিট’, ঠিক তাই। কিংবা বলা যেতে পারে, তার চেয়ে কিছু বেশি!’’

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments