ব্লগ : দেশান্তর/ ৩ । পিতৃদিবস, প্রত্যয়ের দিন


দেশান্তর/ ২

পিতৃদিবস, প্রত্যয়ের দিন

মৌমন মিত্র । ২১ জুন, ২০২০ । নিউজার্সি 



মার মায়ের মৃত্যুর সেই ভয়ানক রাতে, আমি বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই, বাবা বলেছিল, ‘পারলাম না, পারলাম না রে বাঁচাতে...।’
আচ্ছা, বাবাদের কী চিরকাল সব কিছু পারতেই হয়? তাঁরা চোখের জল ফেলেন কার কাছে? ক্লান্ত হলে কার আশ্রয় নিতে যান? আমার জানা নেই। কেবল ছোট্ট বেলা থেকে দেখতাম বাবার ক্লান্ত হওয়ার জো নেই। বাড়ির রাঙা পিসিও তার মুখ চেয়ে, ঠাকুমাও তাই, আর আমি তো অশ্রান্ত ভাবে বাবাকে শ্রান্ত হতে দেখিইনি কোনওদিন।
আমি বলি, সেই ‘পারতেই হয়’ একটি বিশেষ ধরণের প্রত্যয়। প্রত্যয় আমার অসফল বন্ধুদের নাম। শুনেছি তার মধ্যে একজন ঝড়-জল-ঝাপ্টা পার হয়ে প্রতি অল্টারনেট শনিবার তার সন্তানের সঙ্গে দেখা করতে যায়। তার বিবাহবিচ্ছেদের দশ বছর বাদেও। একই ভাবে। তার জন্য তার স্ত্রী সম্ভবত তাকে উপেক্ষাই করে। বিচ্ছেদের পরে যেমন হয়। বিচ্ছেদটা যেভাবে সইতে হয়। এই দেশে এই প্রত্যয়, আমার প্রথম গ্রন্থাগারের বন্ধু।
আমার পাশের বাড়ির প্রত্যয়কে আমি বিগত তিন বছর যাবৎ তার পুত্রকে নিয়ে একাই সংসার করতে দেখি। ওর বাড়ির হেঁশেলের জানলা আমার পার্কিং লট থেকে দেখা যায়। লকডাউনের আগে আমি রোজ সন্ধেবেলা আমার সন্তানদের অ্যাকটিভিটি ক্লাস করিয়ে যখন বাড়ি ফিরতাম, দেখতাম ও রান্না করতে করতে পুত্রকে হোমওয়ার্ক-হেল্প করছে। আরেকদিকে পুত্রের পোশাক আয়রণ করছে। দিব্যি গোছানো সংসার-যাপন তার।
হার্ভার্ড স্কুল অফ এডুকেশনের একটি প্রোগ্রামের সমীক্ষা অনুসারে ২৮৪ জন পিতার মধ্যে ৭০ শতাংশ পিতা করোনা কালে তাদের সন্তানদের আরও কাছে এসেছে। সম্পর্ক আগের তুলনায় অনেক বেশি প্রগাঢ় হয়েছে।


এই প্রত্যয়ের বেশ জটিল জীবন-বিষয়। একদিন রাইটার’স ফোরামে বসে আমায় বলল, ‘ছেলে বুঝলে উচ্ছন্নে যাচ্ছে।ওর মা সময় দিতে পারছে না। চাকরিটাই ছেড়ে বসলাম !’ আমি তো শুনে হাঁ! সন্তান বড় করতে চাকরি কেউ আবার ছাড়ে নাকি? অনেক দিন পর প্রত্যয়ের ছেলে বলল ও নাকি বাবার মতো স্বপ্ন তৈরি করতে চায়। কী স্বপ্ন তা ওরা জানে না। তবে কিছু একটা। আধ-খেঁচড়া।
আমার বাড়িতে একজন প্রত্যয় বাস করে। লকডাউনে যে ছটফট করেছে সন্তানদের কথা ভেবে। ‘অনলাইন সব পারব তো?’ সে ভাবে। আসলে তাকে অনলাইন সমস্ত সামলাতে হচ্ছে। কন্যার সুতির মুখোশ জোগাড় করা থেকে ছেলের ডিউস বল। অফিসের কাজ থেকে অনলাইন গ্রোসারি!
প্রত্যয় বলে তার সব চাইতে বেশি কষ্ট হয় ‘কন্যাদান’ করতে। আচ্ছা, বর পক্ষ কী এতই দরিদ্র যে দান করতে হয়? আরও কষ্ট হয়, তার দেনা ও পাওনার ভার দেখে। এই প্রত্যয়ের দুই কন্যা। শ্যামবর্ণা।ভারী মিষ্টি দেখতে। প্রত্যয় যদি ওদের সঠিক শিক্ষা বোধবুদ্ধি দিয়ে গড়ে তোলে, তবুও কী ওর কন্যাদের দান করতে হবে? দেনা ও পাওনার মাধ্যমে?
এই প্রত্যয়েরা কেউ মিস্টার অ্যাডম, কেউ সুরেশ, কেউ রবার্ট, কেউ অচেনা। কারোর হাতে বাজেরর থলে, কেউ বিগত তিন মাস ধরে টানা একাই মুখোশ পরে গ্রোসারি ডিসিনফেক্ট্যান্ট করছে, কেউ ছেলেকে রাতে ঘুম পাড়াচ্ছে, কেউ আবার একদা তার সন্তানের মায়ের মৃত্যু আটকাতে পারেনি। এরা সকলে কন্যার প্রথম ঋতুস্রাব অনুভব করে, পুত্রের ক্রিকেটের প্রথম ছয়, আবার নিজের পিতার জীবনের আনকাট ভার্শন দেখে একটু একটু শিক্ষা কুড়িয়ে নেয়।
তখন অনেক রাত। আমার ঝিমুনি আসছে। সামনে বাংলা পরীক্ষা। পড়াশুনোয় এক ফোঁটা মন নেই। বাবা কয়েকটা উত্তর লিখতে দিয়ে গিয়েছে। কোনওমতে মানে-বই থেকে টুকে দায়সারা গোছের উত্তর লিখে রেখেছি। বাবা পড়ে খাতা ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘আর কোনওদিন মানে-বই দেখে লিখবে না। নিজের চিন্তা শক্তিতে জোর দাও।’ ভয়ে হাত-পা কাঁপছে। এরপর কপালকুণ্ডলা নিয়ে বসল বাবা। আমি মনে মনে বলছি, ‘কনভেন্টে পড়ে কপালকুন্ডলার ওই বিষম শব্দগুচ্ছ জেনে হবেটা কী!’ অন্যমনস্ক দেখে চিৎকার করে উঠেছিল বাবা। এখন তেমন কাঁপি না ভয়ে। ভাবি, বাবার মতো কেউ চেঁচামেচি করে না।
নানা বিতর্কের স্তর পেরিয়ে আগামী দিনে জন বোল্টনের বই প্রকাশ হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বাধা অতিক্রম করেই। এই সপ্তাহে এল.জি.বি.টি সম্প্রদায়ের কোনও মানুষকে কর্মক্ষেত্রে সে কেবল গে বলে, তাঁকে বরখাস্ত করতে পারবে না জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। এরই ফাঁকে পথের প্রান্তে কোনও এক কৃষ্ণাঙ্গ শিশু তার মায়ের কাছে মুখোশ পরে এখনো জানতে চাইছে, ‘ওরা আমায় মারবে না তো?’ তার হাতে বড় ফেস্টুন, যাতে এখনও লেখা ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার। DACA পলিসি বন্ধ করার আবেদনকে সরাসরি নাকচ করল সুপ্রিম কোর্ট। এই সপ্তাহান্তে বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে গ্র্যাজুয়েশন পার্টি পালিত হল সোশ্যাল ডিস্টেসিং মেনে। কলেজ রি-ওপেন, নতুন বছরের ভর্তি নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষকরা অনিশ্চিত সিদ্ধান্তে থাকলেও, প্রশাসন নির্লিপ্ত। কারণ এ সমস্ত কলেজের ভর্তি বাবদ যে পয়সার অংক থাকে তা নিতান্ত কম নয়।
এই সব কিছুর মধ্য দিয়েই সাধারণ দৈনন্দিন জীবনের সৌষ্ঠব বজায় রাখে নানা ধরণের অনুষ্ঠান। একটু নষ্টালজিয়া, একটু ভাল লাগা। নানা রঙের দিবস। আজ পিতৃদিবস। প্রত্যয়ের দিন। আচ্ছা, মাতৃদিবস পিতৃদিবসের কোনো লড়াই আছে কী? মা-বাবার একত্রিত প্রয়াসেই কত প্রজন্ম গড়ে ওঠে। ছোপ ছোপ আদরে। অনেক ব্যর্থতায়। কোনও কিছু ‘পারতেই হবে না।’ প্রত্যয় তুমি ভাল থেকো। অসফল হয়ে নিজেকে সফল ভেবে নিও...!



Post a Comment

0 Comments