ব্লগ : স্বগতোক্তি/ ১ । এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে

এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে

তড়িৎ রায় চৌধুরী


লে বড় কিছু ডুবলে একটা ঢেউ ওঠেই। ঢেউ বড় বড় বৃত্তে ছড়িয়ে পড়ে কেন্দ্র থেকে পরিধির দিকে। ছোঁয়া লেগে ছলবল করে ওঠে জলবিন্দু। ইদানিং তো আমরা করোনার জন্য পর্দানশীন। বাইরের অন্য জগতকে আরও বেশি আড়াল করেছে পর্দা। সে ছোট হোক বা বড়— মোবাইল বা টিভি। তাই পর্দার জগতের আইকন হারিয়ে গেলে উত্তেজনা জাগবেই। উত্তেজনায় মানুষ হাত-পা ছোঁড়ে বেশি। অনেকেই হাত ছুঁড়ছেন থুড়ি বাড়াচ্ছেন। ‘‘আপনি কি ডিপ্রেশানে? আমি মাত্র একটা কলের দূরত্বে।/ একটা মেসেজেই দেখো আমি তোমার পাশে আছি।’’ গোটা সোশ্যাল মিডিয়া যেন ‘আমি কান পেতে রই’—এর ভূমিকায়। এত! এত মানুষ শুনতে চায় আমার কথা! তাও কোন সাফল্যের আলো বা কেচ্ছা কাহিনি নয়; একঘেঁয়ে ঘ্যানঘ্যানে বিষন্নতার বিশ্রী সুর— সত্যি শুনতে আগ্রহী এতজন? ভারি অবাক লাগে, মনে হয় ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
বয়ঃসন্ধি পর্বের সেই কৌতুহল মুখর দমচাপা একাকীত্বে ভরে যাওয়া দিনগুলোয়? যখন জীবনকে জানতে চেয়েছি আর ভুল রাস্তায় হেঁটেছি; কেন না কেউ আমার কথা শুনতে চায় না দুদন্ড। কেউ বুঝতে চায় না আমাকে। সকলেই ব্যস্ত অথবা অন্য কিছু অন্য কোনওখানে। নিশ্চয় এখন আর সে যুগ নেই— সবাই উন্মুখ অন্যকে শুনতে। তাহলে? তাহলে প্রতিদিন এখনও ওই পুরোনো কথাগুলোই কেন শুনতে পাই ঘরে-বাইরে; বিদ্যালয়ের অফ পিরিওডে? টিফিনের খাওয়া ফেলে শুধু একটা পরামর্শ  করতে আসে কেন কেউ? ‘‘আপনি জানেন আমাদের বেশিরভাগ জন প্রেম শুরু করেছিল শুধু কথা বলার একজন সঙ্গী পাবে বলে।’’ অফুরন্ত কথা— প্রতিদিন শরীরে  মনে জেগে উঠছে যারা; কোথায় রাখব তাদের? যেখানে রাখি সেই প্রেমের পাত্র হয়ে যায়। কিন্তু সমবয়সীরা তো আমারই মতো। বেশি কিছু জানে না পৃথিবীর। কেমনে সামলাবো এই যন্ত্রণা, জটিলতা, নিত্য জায়মান নিজস্বতা কে? স্থায়ী এক দুর্বলতা বাসা বাঁধে মনের ভিতর। হায় পৃথিবী ঢেউ কি কেবল রঙিন বুদবুদেরই জন্ম দেয়? জীবনের নুন নেই তাতে?
পাশের বয়ঃসন্ধিকে যে সময় দিতে পারে না, মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে পারে না, ধৈর্য্য ধরে বোঝার চেষ্টা করতে পারে না; তারা স্পর্দ্ধা ভরে বড় মানুষের পেকে যাওয়া ঘা মানে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশান অব্দি কাটিয়ে দেবে ভাবে? শুধু হাল্কা ফুলকা আলোচনায়? দেবদূতরা যেখানে ভয় পায় মূর্খেরা সেখানে লাফিয়ে পড়ে বটে।
কিন্তু বিষন্নতাও কি কখনও কখনও আসে না দেবদূতের মতো? গাঢ় মনকেমনের গন্ধ মাঝরাতে জন্ম দেয় না কবিতা, গান, ছবির? এই সৃজনশীল মনখারাপ মরে গেলে তো হারিয়ে যাবে দুঃখবোধের অপার সৌন্দর্য। অনুভূতির বৈচিত্র্যও কি জরুরি নয় মানুষের জীবনের সম্পূর্ণ স্বাদের স্বার্থে? হ্যাঁ যখন সে আর নিয়ন্ত্রনে থাকে না, ঘাড়ে চেপে বসে মটকে দিতে চায় সমস্ত ইতিবাচকতাকে। তখন একটা বোঝাপড়ার দরকার তো থাকেই। আসলে কে আমার উপর কি প্রভাব বিস্তার করছে বোঝাটা জরুরি। না সেটা খুব সহজ নয়। ইচ্ছে করে অসুস্হ হতে কেই বা চায়? তবে নাক সড়সড়, গা ঝিমঝিম করলে আমরা তো টের পাই। পরামর্শ করি পাশের জনের সাথে; বা দরকারে যাই ডাক্তারের কাছে। বোঝার আগেই আক্রান্তও যে হই না; তা নয়,তা বলে শরীর কে বোঝার চেষ্টা; সর্তক থাকার অভ্যাস আমরা ছাড়ি না আমরণ। শুধু নিজের মনকে ভেবেনি অবোধ্য। তাই কথায়  কথায় ‘ভাল্লাগে না’, ‘বিরক্তি লাগে’, ‘অসহ্য হয়’— কিন্তু কেন? আমি জানি না, জানার চেষ্টাও করি না। শুধু মুড সুইং করতে কিছু ভুল পথে হাঁটি। জোর করে উল্লাস খুঁজি। যা আসলে স্নায়ুকে আরো ক্লান্ত করে। রোগের সঙ্গে লড়াইটাই দুর্বল হয়ে যায়। তখন ভাগ্য ভালো হলে ডাক্তারবাবুরা বাঁচান। সহজ সখ্যতার শখ কিছুই করতে পারে না।



হয়তো ঠিকই বলছিল শালতি— দেখ থিসিস অ্যান্টিথিসিসের পথেই তো সিন্থেসিস আসবে। এতদিন জনগন ভেবেছে মনের অসুখ হয় না। তাই আজ সবেতেই রোগের আভাস দেখছে। কথায় কথায় নিজেকে বলছে ডিপ্রেশনের রুগি। হয়তো দুঃখবিলাস কিছুটা। কিন্তু অসুখী মানুষ বাড়ছে এও তো সত্যি। মানুষ আজ অনেক বেশি আক্রান্ত মনে। তাকে স্বীকার করা তো সুলক্ষণ। এমনকি মানসিক আরামের চিকিৎসা এখনও যথেষ্ট অর্থ ক্ষমতার দাবী রাখে যা আমাদের দেশে সুলভ নয়। ভকেউ ডুবে গেলে জলে যে ঢেউ ওঠে তা ক্ষণস্থায়ী। আসলে সত্যিই তো কেউ কারও সঙ্গে সঙ্গে নেই আর। ভার্চুয়ালে ভারি হয়ে আছে ভবিষ্যৎ।
তাহলে?
শালতি হেসে ওঠে। ‘‘কেন তোমার কবি তো বলেছেন— সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে/ এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে/ সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ।’’
আশ্চর্য! কারা যে জীবনানন্দকে বিষাদের; বিষন্নতার কবি বলে?



Post a Comment

1 Comments

  1. অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক লেখা। যে মনের যত্ন অনেক আগে থেকেই প্রতিনিয়ত নেবার কথা, নানা অজুহাতে আমরা এড়িয়ে যাই। আমি বিস্মিত হবো না, যদি এই বন্দিদশা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আবার যদি আমরা সব বিস্মৃত হয় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ি।
    তবু যদি কজনের মনেও এই লেখা চেতনা আনে, ততটাই মঙ্গল।

    ReplyDelete