ব্লগ : দেশান্তর/ ৪ । মন ওই জানে

মন ওই জানে

মৌমন মিত্র । ২৯ জুন, ২০২০ । নিউজার্সি 


ছর পাঁচেক আগে, বন্ধু বাসবের সঙ্গে আমার আলাপ স্টারবাক্স কফি শপে। সেদিন তাঁর হাতে এক খানা শ্রীজাতর কবিতার বই। চুল অবিন্যাস্ত। সারা মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। চেহারাও বেশ খোয়াটে। চোখে মুখে সামান্য হা-হুতাশ মনে হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর সঙ্গে আলাপ জমে ওঠে। বাসব এই দেশের নামী এক বৈজ্ঞানিক। শুনলাম ওঁর স্ত্রী আমার পাশের একটি শহরে নামী ডাক্তার। ওঁদের একমাত্র সন্তান, ঋজু। এক বছর পর ঋজু কলেজে যাবে। স্ত্রীর অঢেল স্বপ্ন এই ঋজুকে নিয়ে। অথচ ঋজুর কোনও কিছুতেই মন নেই। সে লাগামছাড়া জীবন যাপন করতে চায়। এই নিয়ে তার স্কুল থেকে মাঝে মধ্যেই নালিশ আসে। সেই নালিশ অতিক্রম করে তাকে অসামান্য স্টুডেন্ট প্রমান করতে, তাঁরা বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে তাঁদের সন্তানকে কখনও মনোরোগ বিশেষজ্ঞর কাছে নিয়ে যান, কখনও উকিল নিয়ে হাজির হন স্কুল চত্বরে। বাসব ও তাঁর স্ত্রী সকলকে ব্যাখ্যা করতে চান তাঁদের সন্তান মানসিক ভাবে পিয়ার প্রেশার নিতে পারছে না।
আসলে, ঋজু এত কিছু বোঝে না। সে বোধহয় একটা সাধারণ যাপন চেয়েছে। কোনও অজ্ঞাত কারণে সে ডাক্তার, বিজ্ঞানী, অথবা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বিপুল অর্থ রোজগার করে, তার মা কিংবা বাবার মতো সফল এবং বিদ্যান হতে চায়নি। প্রকৃত সফলতার খোঁজ তাকে ক্রমশ তার বাবা এবং মায়ের থেকে বহু ক্রোশ দূরে ঠেলে দিয়েছে। বাসব এবং তাঁর স্ত্রী এক মুহূর্তের জন্য সন্তানের এই ভাবগতি মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা ভেবেছেন ঋজু ঠিক হয়ে যাবে। আসলে ঋজু ঠিকই আছে যা তাঁদের ভাবনাকরণের পরিপ্রেক্ষিতে ঠিক নয়।
দয়িতার কন্যা নাচে গানে লেখাপড়ায় সমান ভাবে পারদর্শী। শহরের নামী স্কুল, কলেজে, কন্যার শিক্ষা দিয়েছে দয়িতা। কলকাতায় তার জন্মদিনে কেক আসে মুম্বাই শহর থেকে। নামী ব্র্যান্ডসের পোশাক, রেস্তরাঁ, গাড়ি— সবই মজুত ছিল তার এই এক মাত্র কন্যার জন্য। খুবই সাধারণ দেখতে ঐশীকে দামী পোশাক পরিয়ে দয়িতা সমাজে তাকে রাজকন্যা করে রাখতে চেয়েছে। ঐশী প্রেমে পড়ে খুব সাধারণ একজন পুরুষের। সাধারণ বলতে দয়িতার চোখে যে সাধারণ। যার দামী গাড়ি নেই, যার ব্র্যান্ডেড পোশাক নেই, যে দামী রেস্তরাঁয় যায় না। কন্যা যখন প্রেম করেছে, দয়িতা মনে মনে সবটা বুঝেও ভেবে নিয়েছে ঐশী ঠিক হয়ে যাবে। অবশেষে, সেদিন এক সন্ধেবেলায় ঐশী তার অতি সাধারণ স্বামীকে নিয়ে হাজির হয় মা-বাবার সামনে। দয়িতা সেদিনও মেনে নিতে পারেনি। মাঝে অনেকগুলি বছর কেটে গিয়েছে। ঐশী এখন দয়িতার ত্যাজ্য কন্যা। দয়িতা এখনও স্বপ্ন দেখে তার এক মাত্র রাজকন্যাকে কোনও দামী সুপাত্রের সঙ্গে সে বিয়ে দেবে। আগের স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে নয়। দয়িতা জামাইয়ের মৃত্যু কামনা করে। ভাবে, ঐশী তারপরই ঠিক হয়ে যাবে। ভুলে যাবে তার আগের স্বামীকে। আসলে ঐশী তো ঠিকই আছে। দয়িতা এই ঠিকটুকু মেনে নিতে অস্বীকার করে।
ওপরের দুটি ঘটনা কোনও আষাঢ়ে গল্প নয়। আমার নিজের জীবনে খুব খুঁটিয়ে ঘনিষ্ট ভাবে দেখা কিছু জটিল মানসিক অবস্থান। যা আমার মনে দাগ কাটে আজ থেকে বহু বছর পূর্বে। আমাদের মননের সঙ্গে বাস্তবিকতার অমিলের নানা স্তরে বৈপরীত্য ঘটে। আমরা কেউ কেউ এই বৈপরীত্য কাটিয়ে সেই বাস্তবকে মেনে নিই। কেউ মেনে নিতে পারি না। মনের দেশে, এই মানসিক অবস্থানের নাম cognitive dissonance/কগ্নিটিভ ডিসনেন্স। আমাদের মনের মধ্যে একাধিক ভাবনা জমে থাকে, বিভিন্ন ধরনের বিশ্বাস জমে থাকে। এই ভাবনার দ্বারা চালিত হয়ে, আমাদের মনোভাব বদলে যায়। বাস্তবকে এড়িয়ে আমরা মন যা বলছে তাই প্রকৃত সত্য বলে ভেবে নিই। যুদ্ধ আসছে জেনেও যুদ্ধ মঞ্জুর করে নিতে পারি না। বাসব এবং তাঁর স্ত্রী মেনে নিতে পারেননি তাঁদের প্রোফাইলে বেড়ে ওঠা ঋজু তাঁদের মতো বড় হতে চায়নি। দয়িতাও বোঝেনি তার কন্যা আসলে তার কন্যা, ঐশী নিজেকে কোনও রুপসাগরের রাজকন্যা ভাবতে চায় না।


আমেরিকা তথা আমেরিকাবাসী এখন এই কগ্নিটিভ ডিসনেন্স এর কবলে। তাঁরা জানেন যে বাইরে মহামারী থাবা বসিয়েছে। অথচ তা মেনে নিতে পারছেন না। টেক্সাস এখন সংক্রমণের শিরোনামে। টেক্সাস বাদে, অ্যারিজ়োনা ও ফ্লরিডার পরিস্থিতিও বেসামাল। এই সানবেল্ট রাজ্য টেক্সাসের গভার্নার গ্রেগ অ্যাবট লকডাউন শিথিল করা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গ্রীষ্মের আনন্দে নিজেদের ভাসাতে গিয়ে বিভিন্ন রাজ্যে দ্বিতীয় ঢেউ দেখা দিতে শুরু করেছে। অর্থনৈতিক মৃত্যু, দৈহিক মৃত্যু— কাকে ছাপিয়ে কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
এই সপ্তাহের শুরুর দিকে বুব্বা ওয়েলেসের (ন্যাসকারের কৃতি রেস কার ড্রাইভার) গ্যারাজে একটি ফাঁস ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। তাহলে, প্রায় তিন সপ্তাহ ব্যাপী ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ নামক প্রতিবাদের ঢল কী বৃথা গেল? না বর্ণবৈষম্যতা আরও গাঢ় দাগ কেটে দিয়ে গেল আসন্ন মৃতকল্পের। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে।
অবাক হই— নিউ জার্সির বাঙালিদের সাধারণ জীবন যাপনে ফিরতে দেখে। এখানে দৈহিক দূরত্ব ভালবাসার আলিঙ্গনে কেউ থামিয়ে রাখতে পারছেন না। ঘরে ঘরে সপ্তাহান্তের ভুরিভোজ দেখে মন কেমন যেন প্রি-কোভিড যুগে ফিরে যায়! সত্যিই এই কয়েক মাসের বন্ধু বিচ্ছেদে সকলের বন্ধুতায় যে বৃহৎ পরিমান ঘাটতি ঘটিয়েছে, তা খুবই স্পষ্ট ভাবে ফুটে ওঠে মিডিয়া চিত্রে। মহামারীর কেন্দ্রস্থলে মুখোশহীন বিবাহবার্ষিকী উদযাপন মনকে সত্যিই প্লুত করে। ফেসবুক প্রেম, এই আন্তরিকতাই মড়কের হার্ড ইম্মিউনিটি আনবে আশা রাখি। প্রগাঢ়ভাবে। কেবল এখন মুখোশ সরিয়ে রেখে অন্তর খোঁজার পালা।


আজ আসি। বাইরে সন্ধে ঘনিয়ে এল। এই সময় আমেরিকার এই উপশহরে বাড়িতে বসে সময় কাটানো যে কী নিদারুণ কষ্টের! এখানে এখন গ্রীষ্ম। পুরোদমে। চারদিকে যতদূর চোখ যায় মহিরুহুর ছায়া। এতটাই ছায়া যে, সেই ফিকে আলোয় নিজের ছায়ার সঙ্গে অমিতর বেহিসেবি ছায়া মিলেমিশে একাকার করে দেওয়া যায়। মুখোশটা পরি। এই গ্রীষ্মের ছুটিতে প্রতি বছর আমি কলকাতায় থাকি। তাই মন বোঝাই হয়ে আছে মন কেমনের বোঝায়। অমিত, আমি জেগে থাকব। আমার সেরা শহরের ডাকের অপেক্ষায়। যদি নিজের কগ্নিটিভ ডিসনেন্স অতিক্রম করতে পারি, পরের বছর গিয়ে এই ব্যাথার আঙুল ছোঁয়াবো শহর, তোমার ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না কপালে...!   

Post a Comment

0 Comments