ব্লগ : ওদের কথা/ ৯ । স্বামী নেপাল নিয়ে যাবে

স্বামী নেপাল নিয়ে যাবে

মঞ্জীরা সাহা


 ত্তর দিনাজ পুরের আমদাখালি বাস স্টপ। সেখান থেকে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক হেঁটে গিয়ে বলাইগাঁ এর মান্ডি পাড়ার কাছাকাছি চলে এলাম। মাটির দেওয়ালে মাটি দিয়েই উঁচু উঁচু ফুল লতা পাতা আর ময়ূর চোখে পড়ছিল। পাখনা তোলা পাখনা বন্ধ ময়ূর। নীল রঙ করা মাটির দেওয়ালে অন্য রঙে রঙ করা ফুল লতা পাতা আলপনা ঘোড়ানো প্যাঁচানো ফর্মের মধ্যে হঠাৎ দুটো স্ট্রেট লাইন আমার চোখে কিরকম অদ্ভুত ঠেকছিল। ওই স্ট্রেট লাইন দিয়ে প্লাস চিহ্ন করেছে। বাড়ির বারান্দায় রাখা আরেকটা জিনিস আমার প্রথম দেখা। বাড়ির মেয়ে বৌদের বানানো ইলুয়া খড়ের ঝাঁটা।
মান্ডি পাড়ার মাটির বাড়িগুলো পেরোতে পেরোতে হঠাৎ একটা বড়সড়ো প্রাচির। ওটা এলাকার চার্চ। পুস্তিকা হাঁসদা আমকে চিনিয়ে নিয়ে গেছিল জায়গাটায়। ওই চার্চেই পুস্তিকা পড়ায়। ওরকম রঙীন রঙীন ফুলের ডিসাইন কাটা এক বাড়িতে পুস্তিকা আমাকে নিয়ে গেল। যাকে ডেকে আনলো সে পুস্তিকার চেয়ে বয়সে ছোট। ষোল সতের হবে। সালোয়ার কামিজ পরা। এক গাল হাসতে হাসতে বুকের উপর গামছাটা আরও একটু ঢেকে জড়িয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল আমার সামনে। নাম বলেছিল তারা কিস্কু। এলোমেলো চুল। সিঁথিতে সিঁদুর নেই। গায়ে কোনও গয়না নেই। সালোয়ার কামিজের জামা আর পাজামা আলাদা আলাদা। রোগা হাতদুটোতে ঢল ঢল করছে শুধু দু খানা মোটা মোটা শাঁখা পলা। হাসিটা আর একটু বেড়ে গেল বিয়ে কবে হয়েছে জিজ্ঞাসা করায়। মাটির দিকে তাকিয়ে লজ্জায় চোখ দুটো নীচে নামিয়ে নিয়ে বলল, ছয় সাত মাস হবে। গাজলের ঝন্টু মাহালির সাথে তারার কিস্কুর বিয়ে হয়েছিল প্রেম করে। ঝন্টুর এদিকে কোথাও নেমন্তন্ন খতে আসার পরেই ওদের সেই প্রেমের গল্পের শুরু। তারা তখন এখানে ভুট্টা ভাঙার কাজ করে। তারা কিস্কুর চোখে মুখে হাসি লেগেই ছিল গল্পগুলো করতে করতে। ঝন্টু আর তারার নেপাল যাওয়া বিয়ের দেড় দুই মাসের মধ্যেই। ভুট্টা ক্ষেতের কাজ আর ঝন্টুর কিছু টুকটাক কাজে এই নতুন সংসার চলেনি। তাই এখানকার দলবলের সাথে রওনা হয়ে গেছিল কাজের খোঁজে।
তারার পিছন দিয়ে তখন সাদা পরতে ঢাকা গুঁড়ির খুব উঁচু উঁচু গাছ দেখা যাচ্ছে। ইউ ক্যালেপ্টাস আকাশমনি শাল। টিনের শেডে টিপ টিপ বৃষ্টির আওয়াজ হচ্ছে। উত্তর বঙ্গের এই সীমান্ত ঘেঁষা জায়গাটায় বসে বসে ঠান্ডা ঠাণ্ডা ভেজা ভেজা হাওয়া লাগছে গায়ে। এসবের সামনে দাঁড়িয়ে এই নব বিবাহিত মেয়েটি বলছে, বিয়ার পরই আমি আর আমার বর নেপাল গেছি।
নেপাল নামটা শুনেই মনে পড়ে গেল সাদা সাদা বরফে ঢাকা পাহাড়, সুন্দর শহর কাঠমান্ডু, পশুপতি মার্কেট, পোখরা লেক, সাদা পাহাড়ের উপর সানরাইজ, প্যাগোডা স্টাইলের মন্দির বাড়ি, পাহারের চূড়া দেখা যাওয়া সুন্দর সুন্দর হোটেল, সাদা সাদা চাদর পাতা বিছানা। নিউলি ম্যারেড কাপলের জন্য কত কত ট্যুর কোম্পানি কত কত সব হানিমুন প্যকেজের অফার সাজিয়ে রেখেছে। শিলিগুড়িতে গেলেই ঘুপচি ঘুপচি দোকানের বাইরে নেপালের মন্দির পাহাড়ের ছবির উপর অফার লেখা প্রাইজ লিস্ট চোখে পড়ে। সেই মান্ডি পাড়া থেকে রায়গঞ্জ স্টেশন। সেখান থেকে বাসে চেপে শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ির ওই ট্যুর ট্র্যাভেলসের বোর্ড গুলো পাশ কাটিয়ে আবার বাসে উঠে পড়ে বাস বদলে বদলে ওরা দুজন নেপাল চলে যেত দলবলের সাথে।
— খুব গরম না ওখানে! আমার জন্ডিস হল তো তাই ফিরে এসেছি এই দুই সপ্তাহ হল।
চমকে উঠলাম। আমার সামনে এই রোগা হাড় বার করা চেহারার মেয়েটি বলে কি, গরম!
— তুমি নেপালে যেতে বললে না!
ভাবলাম ও রাজস্থান বা তেলেঙ্গানার কাজের জায়গাটাকে ভুল করে নেপাল বলে ফেলেনি তো!
— হ্যাঁ। নেপাল তো। ভদ্রপুরে আমাদের কারখানা ছিল। ওই যে ফ্যাক্টরিতে যেখানে কাজ করতাম সেখানে সারা ঘরে ওই মালগুলো থাকত। জানলাগুলো মালে সব ঢাকা। বড় বড় মেশিন চলে ওই ঘরে। আর চেড়াই কাঠে পাতায় ভর্তি থাকত ঘর। হাওয়া বাতাস ঢুকবে কোথা দিয়ে?



কারখানাটা ছিল প্লাইউডের। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা অবধি ছিল ওর কাজের টাইম। বাইরে বরফের উপর দিয়ে সূর্য লাল কমলা হয়ে উঠুক না উঠুক এভারেস্টের চূড়া দেখা যাক আর না হোক আবহাওয়া মেঘলা থাকুক আর ঝলমলে তারা রোজ ভোর পাঁচটায় উঠে কাঠ জ্বালিয়ে রান্না চাপাতো। আবার রাত আটটার পর ফ্যাক্টরি লাগোয়া ছোট্ট ছোট্ট কুঠরি ঘরে এসে ঢুকে পড়ত। রাত কেটে যেত। নব দাম্পত্যের পাঁচ মাস ওর এভাবেই কাটে। শুনেছিলাম যে দম্পতি সাথে বাচ্চা নিয়ে ওখানে কাজে যায় সারাদিন সে বাচ্চারা ওই কুঠরি ঘরের বাইরে মা বাবাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন কাটিয়ে দেয় একলা বা অন্য বাচ্চাদের সাথে।
নেপাল দেশ না বিদেশ ওর কথায় বুঝতে পেরেছিলাম ও সেটা জানে না। ওর দাম্পত্য জীবনে নেপালে থেকেও এভারেস্ট পোখরা লেক কাঠমান্ডু না দেখলেও ও অন্য কিছু অবাক করা দৃশ্য দেখে ফেলেছে। তৈরি হওয়া প্লাইউডের টুকড়ো মেশিন থেকে বেরোনোর সময় ওদের দু হাতে ধরতে হত। ও ওই প্লাইউড হাত ফস্কাতে দেখেছে। ওই পাতলা প্লাইউড হাত ফস্কে গলা কেটে যেতে দেখেছে। লেবারের পুরো গলাটা চোখের সামনে কাটতে দেখেনি কিন্তু কেটেছিল অনেকটাই। হাতের উপর প্লাইউডের গোছ পড়তে দেখেছে। হাতের ছাল চামড়া উঠে যেতে দেখেছে, সেই হাতে কাজ করতে গিয়ে ঘা হতে দেখেছে। প্লাইউড ছিটকে গিয়ে বেশি করে গলাটা কাটতে দেখেছে আশপাশের কারখানার লোকের দেওয়া ফেসবুক পোস্টে।
এই হাত পা গলা কেটে যাওয়া মানুষদের এরকম ক্ষতিতে কারখানার মালিক ক্ষতি পূরণ দেয় কিনা জানতে চেয়েছিলাম।
ও হাসতে হাসতে উল্টে আমাকে প্রশ্ন করেছিল, ক্ষতিপূরন দেবে কেন? যতক্ষণ কাজ করবে মালিক হপ্তা দেবে। কাজ থামিয়ে দিলে আর দেবে কেন?

— থাকতেও দেয় না আর অসুস্থ হলে?
— সেটা দেবে। কিন্তু টাকা না পেলে ওই ঘরে বসে বসে থেকে কি হবে? খাওয়াবে কে?
তারার কিছুদিন ধরেই খুব শীত করছিল। ওর ওই শুকনো শরীরখানার ছোট্ট ঘরের ভেতর শুয়ে থেকে কেটে যাচ্ছিল। হপ্তা বন্ধ হয়েছিল। ওর আর ওর বরকে একসাথে ছুটি দেবে না মালিক। একসাথে ওখানে ছুটি দেয় না এটাই নিয়ম ওখানকার। তাই ফিরতে পারছিল না এই মান্ডি পাড়ার বলাই গাঁ এর বাপের বাড়িতে। শেষে বাপের বাড়ির পাড়ার আর কেউ কেউ ফিরছিল কারখানার ছুটিতে। তাদের সাথে ও ফিরে এসেছে।
তারা অপেক্ষায় আছে কারখানা থেকে ছুটি নিয়ে ওর স্বামী আসার। ওকে নিয়ে যাবে আবার নেপালের সেই প্লাইউড কারখানায়।
এই ষোড়শী হাসি মুখে অপেক্ষায় আছে ওই কারখানায় ঘরে আবার নতুন করে সংসার শুরু করার। তারার ভাবী সন্তানেরা অপেক্ষায় আছে ওই কুঠুরী ঘরে আর সব লেবার দম্পতির বাচ্চাদের মতোই শৈশব কাটিয়ে দেওয়ার।

Post a Comment

0 Comments