ছোটগল্প : ডায়াল ১০৯৮


ডায়াল ১০৯৮

ঈশা দেব পাল 


এক
রোল কল করতে গিয়ে আজও থেমে যেতে হল দেবারতিকে। রোল নং সাতচল্লিশ। মণি সরকার। আজও আসেনি মেয়েটা। দেবারতির চিন্তা হল বেশ। আজ নিয়ে সাতদিন মেয়েটা আসছে না। ক্লাসের কেউ বলতেও পারছে না। মণির বাড়ির কাছে থাকে কোয়েল রানি। সে তো এমনিতেই অনিয়মিত। কোয়েল থাকে তার মামার বাড়ি। মামীর মেয়েদের তাকে দেখে রাখতে হয়। যেদিন দিদিমা এবাড়ি ওবাড়ি দিনের কাজ করতে যায়, সেদিন তার ইস্কুলে আসা হয় না। তাই কোয়েলও আসছে না আজ দিন সাতেক, কিন্তু সেই নিয়ে চিন্তার কিছু নেই বলেই মনে হয় দেবারতির। প্রায় গ্রামের নিম্নবিত্ত ছাত্রীদের এই স্কুলে শুধু পড়ালেই হয় না, অন্য খেয়ালও রাখতে হয়।
ক্লাস এইটে সিলেবাসে বিভূতিভূষণের ‘পুইঁমাচা’ গল্পটা পড়তে দিয়েছে সে। সবাই প্রায় দুলে দুলে গল্প পড়ছে, শুধু লাস্টের আগের বেঞ্চে বসে নমিতা শম্পাকে খাতায় কি একটা লিখে দেখাচ্ছে। দেবারতি কটমট করে নমিতার দিকে তাকাতেই সে ভালমানুষের মেয়ের মতো বইয়ে মন দিল। কদিন আগেই অভিযোগ এসেছিল নমিতা নাকি হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করার জন্য রোজ বাড়িতে নাচ প্র্যাকটিশ করছে। বাড়ি মানে বস্তি। একটা ঘরে ঠাসাঠাসি করে মা, দাদা বোন। বাবা ছেড়ে গেছে। মা লোকের বাড়ি কাজ করে। মাঝে মাঝে হতাশ লাগে দেবারতির। চোখের সামনে দেখে নারী হয়ে ওঠার প্রবল আগ্রহে নিম্নবিত্ত মেয়েগুলো রোজ শৈশব হারাচ্ছে বুঝি! পরিবেশ পরিস্থিতি তাদের আর বাচ্ছা থাকতে দিচ্ছে না। ক্লাসরুম থেকে দেখা যায় বাইরে একটুকরো সবুজ মাঠ মেয়েদের খেলার জন্য। তার পাঁচিলে বড় করে লেখা আছে চাইল্ড লাইনের নম্বর। মণি আসছে না ভাবতে ভাবতে ওই নম্বরটাতেই চোখ চলে যায় দেবারতির।
ঘণ্টা পড়লে স্টাফরুমে এসে দেখে তিতলি, শ্রাবণীরা জমিয়ে গণটিফিন শুরু করে দিয়েছে। টিফিন টাইম অবশ্য এরপরে, কিন্তু আজ আগেই সবাই আয়োজন শুরু করে দিয়েছে। মাঝে মাঝেই তাদের একসঙ্গে খাওয়া হয়, কখনও পরিকল্পনা করে, কখনও তাছাড়াই। মধুরিমাদি সবার জন্য চিলি চিকেন এনেছে, সেটাই উপলক্ষ্য। আয়া নিভাদি এসে সবাইকে সবার বাটি দিয়ে গেল। নিজের ভাগও নিয়ে গেল নিজের বাটিতে। সবাই হৈ হৈ করে চিলি চিকেন দিয়ে ভাত বা রুটি খেতে খেতে গল্পে মেতে গেল। দেবারতি ছটফট করতে থাকল মনে মনে। মণি মেয়েটা আসছে না কেন? ক্লাস এইটের এই মেয়েটার প্রতি তার বিশেষ দুর্বলতা আছে সেই ক্লাস ফাইভ থেকেই। বাংলার টিচার হিসেবে সে দেখেছে মেয়েটির বিশেষ সাহিত্যবোধ আছে। যে কোনও প্রশ্নের উত্তর সে বলার বা লেখার সময় বাড়তি এমন কিছু বলে বা লেখে যাতে তার লেখা একদম আলাদা হয়ে যায় অন্যদের চেয়ে। মেয়েটার গানের গলাও অপূর্ব। আর সবচেয়ে বিপজ্জনক যেটা মেয়েটি যত দিন যাচ্ছে দেখতে সুন্দর হয়ে উঠছে। শ্যামলা গায়ের রং, মোটা বিনুনি, লম্বা চেহারা, পাতলা কোমরে মেয়েটার মধ্যে একটা অন্য আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে রোজ। অথচ বাড়ির অবস্থা তথৈবচ। এর বাবা থাকে সঙ্গে, কিন্তু রাতে মদ খেয়ে ফিরে বৌ, মেয়ে সবাইকে পেটায়। ছোট দুটো ভাইবোন প্রায় মণির জিম্মায়। মা লোকের বাড়ি কাজ করে। নানারকম তালেগোলে সংসার চলে। অথচ মেয়েটাকে দেখলে মনে হয় না ও এরকম এক হতদরিদ্র, অবিন্যস্ত পরিবারে বড় হচ্ছে। মেয়েটার শান্ত, সুন্দর চেহারায় একটা শৈল্পিক স্পর্শ আছে, যা হয়ত উচ্চবিত্ত পরিবারে মানায়। মেয়েটাও দেবারতিদিদিভাই বলতে অজ্ঞান। প্রায়ই তাকে এসে এটা ওটা পড়া জানতে চায়, দেবারতিরও ওকে একটু ভালবাসতে মন যেন ভরে যায়। সে বোঝেও যেন, শুধু পড়া জানার জন্যই না, মেয়েটা স্নেহেরও কাঙাল। আহা, কতটুকুই বা বয়স, গোগোলের চেয়ে বছর তিনেক বড় হবে! এই বয়সে নিজে স্নেহ ভালবাসা পাওয়া তো দূরের কথা, উলটে ছোট ভাই বোনেদের কার্যত মা হয়ে থাকতে হচ্ছে। ভাইটা পাশের স্কুলে পড়ে, আচ্ছা, ওর বোন তো ফাইভে পড়ে। আসছে কি? চকিতে দেবারতির মনে পড়ে, সে খাওয়া ফেলে রিমার খোঁজ করে। রিমা ক্লাস ফাইভের ক্লাস টিচার। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, রিমা তখন ক্লাস ফাইভেই ক্লাস নিচ্ছে। টিফিনের ঘণ্টা পড়লে আসবে।
দেবারতি ছটফট করে ভেতরে ভেতরে, তার মন উসখুস করতে থাকে, সে এই স্কুলে প্রায় বছর দশেক পড়াচ্ছে। এখানকার নিম্নবিত্ত ছাত্রীদের জীবনের নানারকম দুর্ঘটানার খবর সে জানে। কাকা জোর করে রেপ করে প্রেগন্যান্ট করে দিয়েছিল এমন ঘটনাও এই স্কুলের ছাত্রীর সঙ্গে হয়েছে। থানা পুলিশের পর মেয়েটিকে অল্প কিছুদিন পরই বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দিল। তাই অন্ধকারের এই ইতিহাসেই সে মণির প্রতি এক মাতৃত্ববোধে আছন্ন হচ্ছে। এইসব দুশ্চিন্তার মধ্যে তার শুধু একটা স্বার্থপর স্বস্তির নিঃশ্বাসের মতো মনে পড়ে যায় তার এগারো বছরের ছেলে গোগোল বড় হচ্ছে কিন্তু কোনও নারীশরীর পাওয়ার জটিলতা অন্তত পাবে না আর সে পড়ে শহরের নামী স্কুলে যেখানে তাকে যৌনতার এই বোধ অন্তত এই বয়সে তাকে স্পর্শ করবে না।

দুই
রিমার কাছে শুনল, ওর বোনও আসছে না, তখন ওদের জন্য চিন্তাটা স্টাফরুমে বলেই ফেলল দেবারতি। এমিলিদি অনেক সিনিয়র। তিনি সহসা খুব একটা আলপটকা মন্তব্য করেন না, কিন্তু তিনিও বলেই ফেললেন,
— তিনদিন কোনও মেয়ে না আসলেই কিন্তু রিপোর্ট করা উচিত। তোরা শহর থেকে এসে এসব গ্রামের ইস্কুলে পড়াস। জানিস না কী কী হয় এখানে। এখনই বড়দিকে জানা।
দেবারতিও তাই ভাবছিল। ব্যাপারটা সিরিয়াস কিছু না হয়। বড়দির ঘরে গিয়ে বলতেই বড়দি অবাক হলেন,
— মেয়েটি তো পড়াশোনায় ভালোই রে, দাঁড়া দেখছি। ক্লাস এইট বি তে ওদের একই বস্তির আরেকটি মেয়ে থাকে, তাকে ডাকছি।
আয়া নিভাদিকে ডেকে পাঠানো হল ক্লাস এইটের পম্পাকে। কিন্তু গিয়ে শোনা গেল, সেও আসছে না। তার মা যে বাড়ি কাজ করে সেই একই বাড়িতে কাজ করে এইট বির রিনার মা। রিনা এল, এসে জানালো,
— পম্পা, মনি এরা নাটক করছে। ফাংশান হবে। সিনেমার লোকেরা এসেছে। ওদের নিয়ে মুম্বই যাবে।
এই অব্দি শুনে দেবারতি তো অবাক। বড়দিদিমনি ও। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হেড ক্লার্ক জয়দেববাবুকে পাঠানো হল মণি, টুম্পার বাড়ি। ততক্ষণে স্টাফরুমেও ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ঘটনা। দেবারতি বাকি টিফিনটা খেতে এসে দেখে দিদিমণিরা সবাইই উত্তেজিত হয়ে  নিজেদের নানা মত শেয়ার করছে। একদলের ইচ্ছে এই স্কুলে একটা যৌনতার পাঠক্রম চালু করা হোক। যাতে ওরা ব্যাপারটা বোঝে এবং ওদের কেউ ব্যবহার না করতে পারে। স্কুলের দেওয়ালে ডায়াল ১০৯৮ লেখা থাকলেও এরা এসব বোঝে না, বিপদে পড়লে কী ধরণের বিপদ কিছুই ভাবে না এখানে ডায়াল করার। এমিলিদি সিনিয়র দিদি হলেও তিনিও তাই চান, অনেকদিন থেকেই চান এই মেয়েদের কাউকে ডেকে এনে বোঝানো হোক বিপদের সুলুকসালুক। তবু কেউ কেউ বলতে থাকেন, এতে এই মেয়েগুলো যাওবা শৈশব বাঁচিয়ে রেখেছে কিছুটা, সারল্য রেখেছে সেটাও হারাবে। নানা ভিন্ন মতের টানাপোড়েনে দেবারতির মনে পড়ে গোগোলদের স্কুলেও আজ নাকি এরকম একটা বড়দের ছবি দেখানোর ওয়ার্কশপ আছে শুনেছিল। তারও মনে হয়েছিল কোএড স্কুলে পড়ছে, সব কিছু শিখে বুঝে না নিলে ছেলে হয়েও সে ভুল করে ফেলতে পারে তো! বছর দুই আগে ক্লাস ফাইভের একটি ছেলে নাকি তার সহপাঠিনী মেয়েটির স্কার্ট তুলে দেখতে গিয়েছিল, সেই নিয়ে নামী স্কুলের স্ক্যান্ডালে কি উত্তাল! দেবারতি সেদিন ভয় পেয়েছিল ওই বাচ্ছা ছেলেটিকে নিয়ে। স্বাভাবিক অথচ অন্যায় কৌতূহলের মানে জানার বয়সই তো হয়নি তার! স্কুল অবশ্য ছেলেটির কাউন্সেলিং ছাড়া অন্য কোনো শাস্তি তাকে দেয়নি। ভাল আধুনিক স্কুলের এই স্বস্তিটুকু দেবারতি বারবারই টের পায় নিজের কর্মক্ষেত্রে এসে।

তিন
প্রায় সিনেমার মতো ঘটনাটা ঘটল। সাড়ে তিনটে নাগাদ মেয়েগুলো এল। সঙ্গে জয়দেববাবু প্রায় পুলিশের জেরা করে এক স্থানীয় মাঝবইয়সী মহিলাকেও নিয়ে এলেন, তিনিই নাকি নাচ শেখাচ্ছেন, তিনিই ওদের মুম্বই নিয়ে যাবেন বলেছেন। ছাত্রীরা ভয় পেয়েছে কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না। অবুঝ সারল্য ওদের সদ্য নারী হয়ে ওঠা চেহারায়। বড়দি সেই মহিলাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতেই সে রীতিমত ফুঁসে জানালো— ওদের বাবা-মা নিজে এসে তাকে বলে গেছে নাচ শেখাতে, জিজ্ঞেস করে দেখুন। আমাদের বড় গ্রুপ আছে, গোটা দেশে শো করি। মেয়েগুলো খেতে পরতে পারে না, তাই মণির বাবা আমাকে দিয়ে গেছে, আমাদের গ্রুপ এর মালিকের কাছে, টাকাও নিয়ে গেছে।
বড়দি যা বোঝার বুঝে ভদ্রমহিলাকে যেতে বলে লোকাল থানায় ফোন করলেন আর দিদিমণিদের বোঝাতে বললেন, স্কুল ওদের দুজনের পড়াশোনার দায়িত্ব নেবে, বই কিনে দেবে। সঙ্গে জলখাবারের টাকাও দেবে। ওই নাচের ভূত যেন নামে ওদের মাথা থেকে। সেদিন ট্রেন মিস করে দিদিমণিরা ছাত্রীদের বোঝালেন জীবনের প্রলোভনে পা না দিতে, ছাত্রীরা সহজেই বুঝল। শুধু দুপক্ষই জানল আসল লড়াইটা বাকি থেকে গেল, জন্মদাতাই যদি ভক্ষক হয়, সেখানে শিক্ষকের কিচ্ছু করার নেই।

চার
দুটো ট্রেন পরে ফিরে বেশ ক্লান্ত হয়ে গেছিল দেবারতি।
সে গেলেই সাধারণত ছেলে ঝাঁপ দিয়ে চলে আসে। আজকে তাকে দেখেও গম্ভীর হয়ে টিভি দেখছে দেখে আর কিছুই বলে না। হাত ধুয়ে পোশাক পালটে বিছানায় আধশোয়া হয়ে দেখে ছেলে বাবার সঙ্গেও বেশি কথা বলছে না। নিরুপম এতক্ষণ কাজ করছিল ল্যাপটপে। সে ফিরতে তাকে চা বানিয়েও দিল। তারপর একটু ছেলের পিছনে লেগে তাকে বেশি রাগানো গেল না দেখে দেবারতিকে বলে গেল,—  একটু আড্ডা মেরে আসছি। তুমি দরজা বন্ধ করে শুয়ে নাও একটু।
ফ্ল্যাটটা ফাঁকা হতেই আর একবার গোগোলকে আদর করে ডাকল দেবারতি। ছেলে বড় হচ্ছে কিন্তু মা ঘেঁষা বলে নিজেই সারাদিন রাগ করে। তাই আজকে অভিমানটা কীসের ঠিক বুঝতে পারে না সে। দেরি করে আসার জন্য? ছেলে না আসায় একটু মনখারাপ করে অন্ধকারে শুতে অল্প পরে টের পায় গোগোল তার পাশে এসে শুয়েছে, কিন্তু অন্যদিনের মতো গায়ের ওপর লাফিয়ে নয়। সে ছেলের গায়ে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে জানতে চায়,
— স্কুলে কেউ বকেছে?
ছেলে বড়দের মতো গলায় বলে— আজ একটা বড়দের সিনেমা দেখিয়েছে স্কুলে। সেখানে বলেছে কোনও মেয়ের গায়ে হাত দিতে নেই। মা, আমি তো তোমাকে কত জড়িয়ে ধরি। তাহলে? ১০৯৮ এ ডায়াল করতে বলেছে, জানো? সিনেমাটা দেখে খুব কষ্ট হয়েছে মা, আমি কি তোমাকে ইনসাল্ট করেছি?
ধরফড় করে উঠে বসে দেবারতি। ছেলেকে সজোরে আঁকড়ে ধরে কিছু বোঝাতে চায়, ছেলে কোনও কথা না শুনেই আর্তনাদের মত বলে
— এরকম ভাবে ধরতে নেই, মা, ১০৯৮ এ ডায়াল করলে পুলিশ চলে আসবে কিন্তু, আমাকে ধরে নিয়ে যাবে।
দেবারতি ছেলেকে সেই কোলের শিশুর মতো করে কোলে নেবে ভাবে, কিন্তু নিজেই সে তখন একটা ফেল করা বাচ্ছার মতো অসহায়, যেন সকালে যে অঙ্ক সে মিলিয়ে ফেলেছিল তাই খাতা খুলে দেখা গেছে ভুল হয়েছে প্রতিটা স্টেপ, ভুল হয়ে গেছে উত্তর। তবু সে গোগোলকে স্পর্শ করে হতাশা নয়, টের পেল এতক্ষ্ণ ধরে যে সবুজ মাঠটা সে খুঁজছিল তাকেই খুঁজে পেয়েছে সে। গোগোলের কান্নায়, তার ছাত্রীদের অসহায় চোখে তখনো জ্বলজ্বল করছে মাঠটা। শৈশব শুধু বাঁচতেই তো নয়, খেলতেও চায়।
শিক্ষিকা দেবারতি তখন আশ্রয় নেয় গোগোলের মায়ের কাছে। শুধু বিপদ থেকে বাঁচানোই নয়, তার সন্তানদের জন্য এই মাঠটাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও তাকে নিতে হবে। দ্রুত গোগোলকে কাছে টেনে নেয় সে।

Post a Comment

0 Comments