স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল

সৌরভ চক্রবর্তী ।  ৬ জুন, ২০২০


ড়িয়া রাঁধুনি বা রান্নার ঠাকুরদের হাতের রান্নার স্বাদ সত্যি ভোলার নয়। ছোটবেলায় বাঁকুড়াতে গ্রামে থাকার সুবাদে তার স্বাদ পেয়েছি সে ধরুণ শীতের রাতে কাঁপতে কাঁপতে কোনও বনভোজনে দেশি মুরগির ঝোল। আর ধোঁয়া উঠতে থাকা ঝরঝরে সাদা ভাত, খুব সরু চাল নয় বরং একটু মোটা চাল। বা ধরুণ এই শীতের সময় কাঁকড়া পিঠে আর ঝাল ঝাল বাঁধাকপির তরকারি তাতে কখনও মাছের তেল বা মাংসর মেটে দিলে সে স্বাদ বাড়ে বহি কমে না !
আমাদের বাঁকুড়াতে কোনও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের বাড়িতে বিয়ে, পৈতে, অন্নপ্রাসন মানেই গরম ভাত, ঝোল ঝোল আলু পোস্ত, ডিংলার ঝাল বা ছ্যাঁচড়া আর মাছ বা মাংস। তবে যাই বলুন শেষ পাতে পেপের চাটনি আর পাতলা করে কাজু, কিসমিস আর দুধের পায়েস ছিলো মাস্ট! বাবা বকবে বলে আমরা কোনও শীতের নেমতন্নগুলোতে যাবো সেই আশা করে সকাল থেকেই খুব করে পড়তাম আর সন্ধ্যে এলেই মায়ের কাছে রান্নাঘরে গিয়ে ওই একটু আধটু কাঁইকুই “ওমা আমিও যাবো”!
বাড়িতে খাবারের সেই অর্থে অভাব ছিল না তবুও শীতের রাতে মাফলার, সোয়েটারে এক্কেবারে গুম্ফসুম্ফ হয়ে চুপটি করে ভোজবাড়িতে বাবার পাশে বসতাম। সাত চড়েও মুখে রা কাটতাম না। শুধু ভুবনমোহিনী সেই শব্দ শুনে মন ভাল হয়ে যেতো যখন সবাই মিলে একসাথে হাপুস হুপুস করে পায়েস খেতো আর একসাথে “কচমচ” করে পাঁপড় চিবোতো। বিশ্বাস করুন এখনও মনে আছে কদমাতে এক বিয়েবাড়িতে রাত্রি বেলায় গরম গরম পাঁঠার মাংস আর ভাত— আহা উৎকল প্রধান গ্রামের খাওয়া দাওয়া আর ঠাকুরের রান্না আমাদের মতোন বাঙালি ঘটিদেরও লজ্জা দেয়!
আমার মুরগির মাংস খাওয়া শুরু হয় রশিদ মামার বাড়িতে শনিবারের রাত্রিগুলোতে! মামা বলতেন “কি বাবু আজ একটু ঝাল ঝাল করে হবে নাকি” আমি বলতাম “চলো হোক” …আমাদের বাড়িতে আমার ঠাকুরদা বেঁচে থাকার সময় অবধি মুরগির মাংস হয়নি। অগত্যা ভরসা সেই রশিদ মামা। আমরা সারি বেঁধে বসতাম সবাই খেতাম টকটকে লাল ঝোল (যেটি মূলত তেজপাতা আর লং এর ঝাল) সঙ্গে আলুমাখা কাঁচা পেঁয়াজ সহযোগে! আহা সে স্বাদ ভোলার নয়! স্বর্গীয় বললেও কম বলা হয়। মাঝে মাঝে শীতকালে আমরা খেতুম চালের রুটি আর হাঁস মাংস। মুখে দিলেই তুলতুলে নরম ব্যাপারটা যেন মস্তিষ্ক অবধি নাড়িয়ে দিত!
আমার বড় হয়ে ওঠার সঙ্গী ছিলো সুনীল দাদু, গুন্ডা আর সব্য কাকা। কোনও ভোজবাড়ি মানে আমরা একসাথে দলবেঁধে যেতাম সেখানে! ধরুন কোনও শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সেখানে আমারা খেতাম মানে যেটা আমাদের অঞ্চলের খাওয়ার চল ছিল তা হল লুচি, ছোলার ডাল, ডিংলার ঝাল আর বোঁদে! একবার মনে আছে ঘোষের গ্রামে কারও বাড়িতে গিয়ে সে কি খাওয়া মনেই হচ্ছে না শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, আসলে যিনি মারা গিয়েছিলেন তাঁর বয়স কম করে একশোর কাছাকাছি সুতরাং তাঁর দীর্ঘরোগ ভোগ করার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি যেন পাতে পড়া মুচমুচে ময়ামের লুচির মতোন টপাটপ শেষ!
তখন অতো শক্তিগড় চিনতুম না গ্রামের মহাদেবের দোকানের ল্যাংচা, সিঙ্গারা আর নামোপাড়ার চপ ছিলো পৃথিবীর চরমতম সুখ! বিশ্বাস করুন তালডাংড়াতে খাওয়া ছানার জিলাপি কলকাতার অনেক সেরা দোকানকে হার মানাবে মানে একদম নাকামি চোবানি খাওয়াবে! বা ধরুন যে পিসি আমাদের বাড়িতে কাজ করতেন সে যখন জঙ্গল থেকে ছাতু এনে দিতো তাতে রসুন, পেঁয়াজ আর আলু কুচো দিয়ে তরকারি অনেককিছুকে আনায়াসে হার মানাবে! আর অবশ্যই আমাদের টানা নাড়ু আর কড়াকানালির ছানার রসগোল্লা!
এসবে আমাদের দিন কেটে যেতো, আজ অফিস ফেরত এক সিনিয়র দাদা কল করে বললেন “ভাই তুই ওই স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেলটাতে খেতিস না? আজ আমিও যাবো ভাবছি” আমি এক লহমায় ডাউন দ্য মেমারি লেন এক বার ঘুরে এলাম সেই উৎকলীয় রান্না, শীতকাল, ফেলে আসা দিন, আর আমাদের বড়ো হয়ে ওঠা … বিশ্ববিদ্যালয় এর ক্লাসের ফাঁকেই কলেজ স্ট্রীটের প্রায় শতাব্দী প্রাচীন পাইস হোটেল ‘স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেলে’ খাওয়া! প্রায় ছ বছর আগের ছবি! তখন ওখানে দুপুরে খাওয়া ছিল রোজকার ব্যাপার। এবার একটু ইতিহাসে আসি— কলেজ স্ট্রীট এলাকার অন্যতম পুরাতন (শতাব্দী প্রাচীন) ভাতের হোটেলের(pice hotel) কর্ণধার স্বর্গীয় প্রহ্লাদ পণ্ডা। হোটেলটির নাম স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল। তাঁর কাছ থেকে শুনেছি যে এখানে নাকি সুভাষ চন্দ্র বোস থেকে শুরু করে আরো অনেকে খেয়েছেন। ’৫০ এর দশক থেকে ’৭০ এর দশক বিভিন্ন সময়ের ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন করে সহজেই তার উত্তর মিলে যেত। আসলে এই হোটেলে খাওয়া তো আছেই তার সাথে ওই ভদ্রলোকের কাছে শুনেছিলাম
বিভিন্ন আন্দোলনের সময় অনেক কমবয়সী মেধাবি ছেলে এখানে বিনে পয়সায় খেয়ে পালিয়ে যেত। আগে এটির নাম ছিল হিন্দু হোটেল। যেদিন দেশ স্বাধীন হয় সেদিন নাম পাল্টে হয় স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল! তা কি মেলে এখানে?
খাবারের পদের মধ্যে যেদিন আপনি আসবেন সেদিনের চড়চড়িটা আর পাঁঠার মাংস অবশ্যই চেখে দেখবেন! আসলে আমি নিজেও যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম এখানে নিয়মিত খেতাম। এই হোটেলগুলো শুধু পুরোনো কলকাতার ধারক বাহক নয়, অনেক ইতিহাসের, সমাজ পরিবর্তনের সাক্ষীও বটে!

Post a Comment

0 Comments