আয়লায় মরি নাই, এইবারও বাঁচব


শ্যামল চক্রবর্তী  ।  ৬ জুন, ২০২০


বিভাস বৈরাগ্য মলিন মুখে হাসলেন। ‘আয়লায় মরি নাই, এইবারও বাঁচব!’
পাশে এসে দাড়ালেন অমলকান্তি, ‘কী বুঝলেন ডাক্তারভাই! জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ নিয়ে বাঁচতে হয় আমাদের। বাঁধ ভেঙে যায়, নোনা জল ঢুকে পতিত হয় জমি। তারপরও আমরা বেঁচে থাকি। আমরা না বাঁচলে কলকাতার বাবুরা লঞ্চে করে, নদীতে প্লাস্টিক আর বিয়ারের ক্যান ফেলতে ফেলতে সুন্দরবনের বাদাবনে পিকনিকে আসবেন কি করে!’
বিদ্ধ করছে শিক্ষক অমলকান্তির হাসি।
গিয়েছিলাম ঘূর্ণি ঝড়-ধ্বস্ত সুন্দরবনে মেডিকেল ক্যাম্প করতে। লকডাউনের দিনগুলোতে চিকিৎসা না পেয়ে কষ্টে আছেন মানুষ। সুন্দরবন শ্রমজীবী হাসপাতালের উদ্যোগে কমিউনিটি কিচেন চলছে আজ চোদ্দদিন। এবার শুরু হল মেডিকেল ক্যাম্প। আমরাই প্রথম এলাম এই জায়গাটায়। প্রথমদিকে সমস্যা হয়। আমাদের হল না। প্রায় নিরানব্বই ভাগ রোগীকে ওষুধ দেওয়া গেল। তৈরি হল সপ্তাহে দুটো ক্যাম্পের রস্টার।
বিদ্যধরী নদী আজ ভোরের মতো শান্ত। আম্পানের দিন এই নদীই রাক্ষসী হয়ে দুমড়ে মুচড়ে মুছে দিয়েছে কত মানুষের ঘর। একেকটা রাস্তা ধুয়ে গেছে জলের তোড়ে। উড়ে গেছে কত বনস্পতি, উপড়েছে কয়েক লক্ষ গাছ। ভটভটিতে নদী পেরোতে পেরোতে হাসান মোল্লা হাত বোলাচ্ছেন সাদা দাড়িতে, ‘আকাল আসতেছে ভাবিছিলাম। অখন দেখতিছি, মানুষ হাতে হাত রেইখে লইরে আকাল রুখি দিল।’

বিদ্যাধরী নদীর জলে তখন প্রদোষকালের রঙের খেলা। দিনমণি চলে যাচ্ছেন দিনান্তের বিশ্রামে। হাসানচাচা দু’হাত মেলে ধরছেন পশ্চিম আকাশে। আল্লার দোয়া মাঙছেন, না সূর্যদেবের, নাকি প্রকৃতি আর পরমশক্তিমান একাকার হয়ে গেছে বৃদ্ধ হাসান মোল্লার চেতনায়, নদীর দিকে তাকিয়ে মনে ভেসে উঠেই আবার ডুবে গেল প্রশ্নটা।
রোগী দেখলাম অনেক। দেখলাম ভাঙা ঘর আবার নতুন করে বসবাসের মতো করে তুলছেন মানুষ। সরকারের দেওয়া ত্রিপল, কালো পলিথিন আর দড়ি দিয়ে। ঘাটে ঘাটে, রাস্তার ধারে ধারে কাটা বাঁশের স্তুপ। নদীর ধারে ভেঙে যাওয়া বাঁধে মাটি পড়ছে আবার। কিছু মানুষ পেয়েছেন একশো দিনের কাজের ভাগ। ঝুড়ি কোদাল নিয়ে চড়া রোদে নেমে পড়েছেন বাঁধ সারানোর কাজে। ন্যাজাট, বাউনিয়াতে নদীসংলগ্ন রাস্তাতেও মাটি আর বালির বস্তার বাঁধ।  সামনে পূর্ণিমা। লড়ে যাচ্ছে সুন্দরবন।
বিকেলবেলা কমিউনিটি কিচেনে ভাত ডাল আর কুমড়ো-পুঁইডাটার তরকারি পরিবেশন করে খাওয়াচ্ছে টগরী মুন্ডা। কোমরে ব্যথার আর প্রেসারের ওষুধ পেয়ে ডাক্তারের মাথায় হাত রাখছেন বাহাত্তুরে জহুরা বিবি। ভেড়ির ধারে রাস্তার ওপর গ্রামের মহিলাদের জড়ো করে এক অসরকারি সংস্থার পাঠানো স্যানিটারি ন্যাপকিন বিলি করছে শ্রমজীবীর বড় মামনি। দ্রুত হাতে রোগীদের রক্তচাপ মাপছে শঙ্কর। প্রেসক্রিপশন দেখে মানুষকে ওষুধ দিচ্ছে ছোট মামনি। ‘আবার কবে আসবেন আপনারা’— প্রশ্ন করছে ভিড়। শ্রমজীবী হাসপাতালের দক্ষ কর্ণধার অরুনদা ক্যাম্পের পাশের গাছতলায় মিটিং করছেন স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধানের সঙ্গে। আরও দুটো গ্রামে রান্না করা খাবার পৌঁছে দেবে পঞ্চায়েত।
সুন্দর মুন্ডা মোটরভ্যানে অনেকটা করে পথ টেনে নিয়ে গেছে আমাদের। টাকার কথা বলতেই রেগে টঙ। ‘আপনারা কলকাতার মানুষ, তাই আর কিছু বলছি না। আমরা গরীব হতে পারি, অমানুষ হতে পারব না।’
বুকের মধ্যে পাথর গড়াচ্ছে দিন আনা দিন খাওয়া সুন্দরের কথা শুনে!
এই ভারতবর্ষে জন্মেছি বলে গর্ব না করে পারা যায়, হে  পাঠক, আপনিই বলুন...। ফিরে আসছি। গোটা গ্রাম এসে দাঁড়িয়েছে রাস্তায়। ছিন্ন শাড়ির খুট দিয়ে চোখ মুছছে জহুরা। টগরী কাঁদছে। অনেক... অনেককাল বাদে চোখের কোণ ভিজে উঠছে আমার। গাল বেয়ে নেমে আসছে ভেড়ির নোনা জল।


(লেখক আর জি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক)


Post a Comment

0 Comments