তর্ক সরিয়ে তাঁর ছবি দেখি

তর্ক সরিয়ে তাঁর ছবি দেখি

কুশল ভট্টাচার্য

যে কোনও সৃষ্টিশীল মানুষের মনের গভীরে একটি বিপন্নতা থাকে, একটা প্রবল রকম অসোয়াস্তি!
প্রায় রক্তের অন্তর্গত বিপন্ন বিস্ময়ের মতোই, খেলা করে চেতনে, অনেকটাই অবচেতনে। মনোবিদের ভাষায় একে বাইপোলার ডিসঅর্ডার বলুন, কিংবা অন্যান্য কিছু এটা এমন একটা তীব্র মানসিক অরাজকতা কিংবা অস্বাভাবিক ভাবে জীবনের বিপ্রতীপ হয়ে ওঠা, যখন সাধারণ দুঃখবোধ কখনও দুঃখবিলাসে পরিণত হয় আমরা জানতে পারি না। অস্তিত্বের মূলগত বিষন্নতা কখন মনের ভিতরে গুঁড়ি মেরে আত্মঘাতী হয়ে বসে, অনেকেই তা বুঝতে পারি না। একটা মুলতুবি রাখা বিনবিনে মনখারাপ কখনই বা অচেতন অবসাদে ক্লিনিক্যাল অসুখে পর্যবসিত হয়, সেটা বুঝে ওঠার আগেই একদিন মানুষ হঠাৎ করে এসে যায়, সেই কালো দরজাটার খুব কাছাকাছি।
“আমাকে টান মারে রাত্রি জাগানো দিন/ আমাকে টানে গুঢ় অন্ধকার/ আমার ঘুম ভেঙ্গে হটাৎ খুলে যায় মধ্য রাত্রির বন্ধ দ্বার।/ এ যেন নিশিডাক মৃতের হাতছানি, এ যেন কুহকের অজানা বীজ।/ এমন মোহময় কিছুই কিছু নয় হৃদয় খুঁড়ে তোলা মায়া খনিজ।’’
একটা অদ্ভুত মিথ্যে তৃপ্তি কিংবা আরামবোধ তাকে ফিসফিসিয়ে ডাক দেয়, এক অন্য অমরায়। সকলেরই অল্প বিস্তর হয়, কিন্তু শিল্পী, সাহিত্যিক, কিংবা সৃজনশীল মানুষদের ক্ষেত্রে সেই মৃত্যুর অনুরণন ছড়িয়ে পরে অনেকখানি, তাঁদেরই সৃষ্টির নরম নমনীয়তাকে ছিন্নভিন্ন করে সেই খবর দুরারোগ্য অসুখের মতো ছড়িয়ে পরে জনমানসে। তাঁদের শেষ লেখা, শেষ আঁকা ছবি, শেষ অভিনীত ফিল্ম মানুষ খুঁটে খুঁটে দেখেন, বোঝার চেষ্টা করেন, ঠিক কেন, ঠিক কখন মরণ ডাক দিয়ে গেলো, কোন পঞ্চমীর চাঁদ ডুবে যাওয়া শেষরাতে?


সুশান্ত সিং রাজপূত একজন ইয়ুথ আইকন, একজন সেলিব্রিটি। তিনি তারকার ঘরে জন্মাননি। দস্তুরমতো পড়াশোনা করেছেন, ফিজিক্স, এস্ট্রোনমি ও ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে এন্ট্রান্স পাশ করে খেলাধুলো দিয়েও নজর কেড়েছেন। প্রথম টিভির পর্দায় এসেছেন প্যাস্টেল শেডের ময়লা জামাকাপড়, গলায় কালো কার আর গমের মতো ময়লা রং নিয়ে, চেহারা তো নয়ই এমনকি, গলার স্বর ও একেবারে নায়কোচিত, ওজনদার, গমগমে নয় বরং ফ্যাসফ্যাসে, নরম। কিন্তু ওই পাশের বাড়ির ছেলের সাধারণ চরিত্র দিয়েই বাজিমাত করে টেলিভিশনের পর্দা থেকে ষোলো এম এমের রুপোলি পর্দায় আসতে সময় লাগেনি একটুও। আত্মবিশ্বাসে ছটফটে, প্রাণশক্তিতে ভরপুর, হাসির ছটায় মানুষের মনকে ছুঁয়ে আত্মপ্রকাশ করেছেন একগুচ্ছ ছবিতে। অবিসংবাদিত নায়ক, ব্যোমকেশ বক্সি’র মতো আইকনিক চরিত্র থেকে মাহি, কেদারনাথের ঘোড়াওয়ালা থেকে ছিঁছরে ছবির আত্মহত্যাপ্রবণ পুত্রের বাবা—, এই অল্প সময়ের মধ্যেই জার্নিটা নেহাতই কম ছিলোনা সুশান্তের! হাতে কাজ ছিল, অর্থ ছিল, একের পর এক গড়পড়তা প্রেমের ভাঙ্গন ও পুনর্নির্মাণ ছিল, শুধু সময় ছিল না! যখন এ লেখা লিখছি, ততক্ষণে আত্মহত্যা বনাম খুনের গল্পে ভেসে যাচ্ছে সাইবার দুনিয়া!
আসলে সমস্যাটা গভীরে এবং মূলগত। সেলিব্রিটি শব্দটার একটা বিশেষরকম আদর, একটা অদ্ভুতরকম নক্ষত্রখচিত স্বপ্নময় উপস্থিতি, এই শব্দের আড়ালে থাকা মুখগুলোকে আমাদের আমজনতার দরবারে এমন একটা উচ্চতায় তুলে দেয় যেখান থেকে তাকে বাস্তবের, উচিত, অনুচিতের এবড়োখেবড়ো জমিতে টেনে নামানো ভারী কষ্টের। তাই বেপরোয়া জীবনযাপন করা, স্বার্থপর জীবনযাপন করা, এমনকি স্বাভাবিক জীবনযাপন করা একজন সেলিব্রিটির আত্মহনন বারবার যে প্রশ্নের সামনে আমাদের দাঁড় করায় সেটা হল, এই স্বেচ্ছা মৃত্যুতে সেই সেলিব্রিটি যতখানি দায়ী, কাঁটায় কাঁটায় সমপরিমাণ দায়ী কিন্তু আপনি এবং আমি, কারণ আমরাই তিলে তিলে তৈরি করেছি একটা বিপুল মিথ্যে দিয়ে তাদের মুখ, তাদের না দেখতে পাওয়া দুটো বিরাট বিরাট ডানা, আমরাই আমাদের অযাচিত, অসভ্য, অনাকাঙ্খিত এবং অশিক্ষিত কৌতূহল দিয়ে তাদের বানিয়েছি স্বপ্নের ফেরেশতা! আর কাল যখন তারা সেই কাল্পনিক স্বপ্নসিংহাসনের খোয়াবে মজে গিয়ে, একটা অদ্ভুত মিথ্যে ইগোর বশবর্তী হয়ে, এমন একটা কিছু করে বসছেন, তখন তাঁর ঠিক, ভুল, জীবন, মৃত্যুর চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে বসছি সেই আমরাই!
ভেবে দেখার মতো জিনিস, সেলিব্রিটি জীবনকে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে মেপে তাকে সেলিব্রেটেড করেছি আমরাই। শুধু জীবনযাত্রার আলগা চটকটুকু বাদ দিলে, দৈন্দদিন জীবনের হয়রানি যেমন আমাদের আছে, মনখারাপ আছে, সমস্যা আছে, অর্থকষ্ট আছে, শারীরিক অসুখ আছে, ওদেরও আছে, হয়তো আমাদের থেকে বেশিই। এরই মধ্যে আমাদের প্রেম, অপ্রেম আছে, ওদেরও। কিন্তু ওদের মধ্যে অনেকেই (ঠিক আমাদেরই মতো) যেটা ভুলে যান, সেটা হলো জীবন শুধুমাত্রই পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো ফুরফুরে, মজাদার, খ্যাতি লোটার আর সেলাম গোনার জায়গা নয়, জীবন মানে, দায়িত্ববোধের সাথে জীবন থেকে যা পেয়েছি, সেটাকে ফিরিয়ে দেওয়াও। তাই বলিউডি তারকাদের মৃত্যু কোনও আলাদা ঘটনা নয় বরং একটা গোটা প্রজন্মের ওয়ার্নিং, যারা জীবনে সাফল্য মানে বোঝেন অনেক টাকা, দেদার লাইক, আগলখোলা সামাজিক ভ্যালিডেশন, আকাশছোঁয়া খ্যাতি। তাই সেই খ্যাতির স্বপ্নে সামান্য আঁচড় পড়লেও এরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন! অবসাদগ্রস্ত হয়ে ওঠেন। জীবনকে ভুল ইন্টারপ্রেট করে বসেন।
মৃত্যুর কারণ যাইহোক— সুশান্তের এভাবে চলে যাওয়া বোধহয় আরো একবার শেখায়, তারাদের দূর থেকে দেখতে ভালো, কাছে এলে অনেক খানাখন্দ চোখে পড়বে। ঠিক যেমন সোশ্যাল মিডিয়ার হাসিখুশি ঝলমলে ছবির আড়ালে লুকিয়ে আছে আমার আপনার অজস্র অন্ধকারের দলিল। তাই সৃজনশীলতা নাকি খ্যাতির বিড়ম্বনা, বিষণ্নতা ডেকে আনলো কে? খুন নাকি, আত্মহনন— নাকি এর পেছনে গোপন রইল আরও কোনও না-বলা-কাহিনি— কেই বা তা বলবে! আমরা বরং শিল্পীর ছবিগুলি দেখব। শোক ভুলতে ফিরে ফিরে তাঁর শিল্পে নিমগ্ন হব!



Post a Comment

0 Comments